‘খালি খালি চারিপাশ এ আমার দেশ না’

কামরুল হাসান জনি

এক.
এক ভদ্রলোক একটি রেস্টুরেন্টের পাশে দাঁড়িয়ে মোবাইলে বাংলা গান শুনছিলেন। গানের আওয়াজটা এ পথে চলাচলে পথিকদের কানেও পৌঁছে যাচ্ছে। তেমনি আমারও কানে পৌঁছলো- ‘কথা ছিলো সাথে তোর/ বলা হোলো শেষ না, খালি খালি চারিপাশ / এ আমার দেশ না।’ বুঝতে পারলাম, এটি ভারতের অরিজিৎ সিং এর গাওয়া গান। গান নিয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই। মন্তব্যের জায়গা ভিন্ন কোথাও! ভদ্রলোক যেখানে এবং যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে গানটি শুনছিলেন তখন গানের কথার সাথে বাস্তবতা মিলিয়ে দেখছিলাম আমি। সত্যিই তো … এ আমার দেশ না! কিন্তু তিনি এমন ভাবে গানে মগ্ন, হয়তো ভুলেই গেছেন বাস্তবেই এ আমার দেশ না।

দুই.
কিছুদিন আগে এক সুপার মার্কেটের দরজায় একটি কাগজ সাঁটানো দেখলাম। সামনে গিয়ে দেখি, সচেতন নাগরিক বাংলাদেশ কর্তৃক প্রবাসীদের জন্য এটি সচেতনমূলক প্রচারণার অংশ বিশেষ। যাতে লিখা ছিলো – ‘প্রিয় প্রবাসী বাংলাদেশি বন্ধুরা, আজ আমাদের কিছু অসচেতনতার জন্য আমরা মানুষের হাসির পাত্র হচ্ছি! আমরা যারা লুঙ্গি পড়ে মসজিদে, সুপার মার্কেটে, রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করছি, আমরা কি একটু ভেবে দেখেছি এই অসচেতনমূলক পোশাক আমাদের কতটা নিচু করছে। অনুরোধ রইল, যখন ঘর থেকে বের হবেন দয়া করে পায়জমা / প্যান্ট /টাওজার পড়ে বের হবেন। সবার সুস্থ্যতা কামনা করি, খোদা হাফেজ।’

তিন.
আমাদের এক সহকর্মী সম্প্রতি তার ফেসবুক স্ট্যাটাস আপলোড করেছে ঠিক এ রকম করে – ‘হায়রে বাঙ্গালী ! আমরা মানুষ হব কখন ? এতো প্রচারণার পরও যদি লুঙ্গি পড়ে রাস্তায়, সুপার মার্কেটে, সরকারি বেসরকারি অফিস আদালতে ঘোরাঘুরি করি অন্যান্য দেশের লোকেরাতো আমাদের খারাপ বলবেই। আমরা দেশে যেমন আইনের তোয়াক্কা করিনা, তেমনি দেশের বাইরে এসেও অভ্যাসটা ছাড়তে পারি না।’

প্রিয় পাঠক, এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন পরবাসে কিছু প্রবাসীর বাঙ্গালীয়ানা ও লুঙ্গির ব্যবহার নিয়েই কথা বলছি। আসুন প্রথমে একটু লুঙ্গি বন্দনা করি। লুঙ্গি আমাদের প্রিয় পোষাকের একটি। এতো রিলাক্সড পোশাক বিশ্বে দ্বিতীয়টি রয়েছে কিনা তা বিশেষজ্ঞদেরও সন্দেহ থাকতে পারে! বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা ও মিয়ানমারে লুঙ্গি অতি সাধারণ দৃশ্য। মিয়ানমারে এটি জাতীয় পোশাক হিসেবেও স্বীকৃত। আবার লুঙ্গিকে দক্ষিণ ভারতের আদি পোশাক ধরা হলেও দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকাসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে লুঙ্গির প্রচলন রয়েছে। কারণ লুঙ্গি কটন বা সিল্কের এমন একটি টিউব যাতে কোনো জিপার লাগে না। এটি গিট্টু মেরে কোমর থেকে নিমিষেই পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢেকে রাখা যায়। এটি যেমন হাইজেনিক তেমনি দেহের উপযোগী। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে তাকালে লুঙ্গিকে যেকোনো বিবেচনায় একটি স্বাস্থ্যসম্মত অ্যাঙ্কেল-লেনথ স্কার্ট বলা যায়। বাংলা চলচ্চিত্রের খলনায়ক ডিপজল ও এটিএম শামসুজ্জামান অনেক মুভিতে লুঙ্গি পরেই অভিনয় করেছেন। আর ছোট পর্দার স্টার আবুল হায়াত হয়েছেন লুঙ্গির মডেল। তামিল স্টার বিক্রম তার মুভি মাজা-তে লুঙ্গি পরে অভিনয় করেছেন। প্রসাদ বিধপা তো লুঙ্গিতেই সবচেয়ে বেশি স্বস্তি পান। এছাড়াও বলিউড কিং শাহরুখ খানের চেন্নাই এক্সপ্রেস মুভিতে লুঙ্গি ডান্স ও হানি সিং এর লুঙ্গির ব্যবহার সবার নজর কেড়েছে। বিশ্ব জুড়ে লুঙ্গির জ্ঞাতিগোষ্ঠী আর ব্যবহারকারীর সংখ্যাটি জানা থাকলে হয়তো কবি আসাদ চৌধুরী আফসোস করে লিখতেন না ‘লুঙ্গি পরার পুরুষ কই’!

এবার আসুন, একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হই। লুঙ্গি পরলে মানুষ কি মানুষের পর্যায় থেকে নিচে নেমে যায়? অনেকক্ষণ ভেবে চিন্তে উত্তর দিলেও বলবেন – ‘না’। আমারও উত্তর তাই। কিন্তু দেশের গন্ডি ফেরিয়ে যেখানে আমরা বসবাস করছি, সেই দেশের নিয়ম মেনেই তো আমাদের চলতে হবে। এজন্যে সচেতন হওয়াটাও অতি জরুরী। যতই আমরা লুঙ্গি বন্দনা করি না কেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে লুঙ্গি পড়ে ঘোরাঘুরি করাটা বেশ বেমানান মনে করেন দেশটির দায়িত্বে থাকা নাগরিকরা। তাই হয়তো পোষাকটি পড়ে জনসম্মুখে আসাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন তারা। সকলেরই জানা আছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে লুঙ্গি ব্যবহারের চিত্রটা একটু ভিন্ন। শারজায় একজন দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিককে জনসম্মুখে লুঙ্গি পড়ে চলাচলের দায়ে পুলিশ আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ করে। পুলিশ অফিসার ওই ব্যক্তিকে লুঙ্গি পড়ে বাইরে ঘুরতে বারণ করেন। পুলিশ অফিসার বলেন, ‘লুঙ্গি পড়ে জনসম্মুখে ঘোরাঘুরির অনুমতি নেই। আমিরাতের ডিসেন্সি ল অনুযায়ী দশ বছর যাবৎ এ আইন বাস্তবায়িত হয়ে আসছে।’ ২০১০ সালের ৭ এপ্রিল এ খরব প্রকাশ করে গালফ নিউজ। দুবাইয়ের আল কুজ শিল্প এলাকায় একটি খিয়েটারে ২০১১ সালে প্রথম নোটিশ লাগানো হয় প্লিজ, লুঙ্গি পড়ে থিয়েটারে আসবেন না। এ পোশাকে থিয়েটারে প্রবেশের অনুমতি নেই। খবরটি আমিরাতের স্থানীয় নিউজ পোর্টাল এমিরেটস টোয়েন্টি ফোর সেভেন প্রকাশ করে ২৯ অক্টোবর ২০১১ সালে। একই খবরে উল্লেখ করা হয় শারজাতে লুঙ্গি নিষিদ্ধের কথাও। এতিসালাত মেট্রো স্টেশনে মেট্রোতে প্রবেশের আগে ৬৭ বছর বয়সী ভারতীয় এক দর্শনার্থী ধুতি(লুঙ্গি) পরিহিত থাকায় পুলিশ দরজার কাছাকাছি তাকে থামিয়ে দেন। পুলিশ বলেন, ‘এই পোষাকে (ধুতি) মেট্রোতে যাবার অনুমতি নেই’। এ খবরটি গালফ নিউজ প্রকাশ করেছে ৩ আগস্ট ২০১৩ সালে। জনসম্মুখে এ পোষাকে ঘোরাঘুরিতে বারণ করা ছাড়াও গ্রেফতার ও জরিমানার খবর বেশ জনশ্রুতি আছে। তার চেয়ে অধিক প্রচার আছে বাংলাদেশিরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মসজিদ, মার্কেট ও বাজারে লূঙ্গি পড়ে ঘোরাঘুরি করেন। উপরের তিনটি দৃশ্যই তার প্রমাণ করে।

 

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এসব ছোট ছোট অসচেতনতার জন্য ভিনদেশিদের কাছে আমাদের নাক কাটা যাচ্ছে। এমনিতেই বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ! হারানো ইমেজে ফিরে পেতে প্রয়োজন নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। অনেকে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখালিখিও করেন। ওসব লিখা হয়তো সবার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। তাই কাজের কাজও হচ্ছে খুব কম। অথচ আমাদের সামান্য সচেতনতা এ দৃশ্যের পরিবর্তন এনে দিতে পারে। আচ্ছা, আয়নায় দাঁড়িয়ে দেখেছেন- প্যান্ট বা পায়জামা পড়লে আপনাকে কত সুন্দর দেখায়। সুন্দর ও পরিপাটি করে মসজিদে যাওয়া বা মার্কেটে ঘুরতে বের হলে বন্ধুদের কাছেও আপনার মর্যাদা কতটুকু বেড়ে যায়! ভেবেছেন কখনো? যদি না ভেবে থাকেন আজ থেকে একবার চেষ্টা করে দেখুন। দেখবেন, মনেও বেশ তৃপ্তি পাবেন। নিজে সচেতন হয়ে, পাশের বন্ধুটিকেও একই পরামর্শ দিন। এতে নিজেদের দেখতে যেমন সুন্দর দেখাবে তেমনি আমিরাতে পুরো বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারবেন আপনি নিজেই। পরিশেষে বলবো না লুঙ্গি ছাড়ুন। লুঙ্গি পড়ুন, অবশ্যই পড়ুন, তবে জনসম্মুখে নয়। বলবো, রাস্তায় দাঁড়িয়ে শুধু গান শুনলে হবে না – খালি খালি চারিপাশ/এ আমার দেশ না। অন্তর থেকে মনে রাখতে হবে সত্যিই এই আমার দেশ না। সেহেতু দেশের সম্মান রক্ষায় সচেতনতা বাড়ান আজ থেকেই ।

 

লেখক : সাংবাদিক

news.jony@gmail.com

৩ thoughts on “‘খালি খালি চারিপাশ এ আমার দেশ না’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *