ডানপন্থিরা যেভাবে মুসলিমদের নিয়ে আতঙ্ক তৈরি করে

ইসলামোফোবিয়ার যে জোয়ার ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে তা স্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়। ন্যাথান লিনের লেখা ‘ইসলামোফোবিয়া ইন্ডাস্ট্রি- হাও দ্য রাইটস ম্যানুফ্যাকচার্স ফিয়ার অব মুসলিম’ বইটির উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব। অনুবাদ করেছেন হাসনাইন মেহেদী।
২০১০ সালের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে ঘৃণা প্রকাশের তীব্র আবহ ছিল। ২০১১ সালের ৯/১১-এর ৯ বছর পরও মুসলিমবিরোধী মনোভাব ছিল অনেক বেশি। অনেকের প্রত্যাশা ছিল এটা হয়তো এতদিনে কমে যাবে। কিন্তু তেমনটা হয়নি। বরং এটা আগের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। এমনকি ভয়াবহ ওই হামলা পরবর্তী দিন, সপ্তাহ, মাসের তুলনায়ও বেশি। টুইন টাওয়ার হামলার দুই মাস পর পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে দেখা যায় মুসলিমদের নিয়ে ইতিবাচক অভিমত পোষণ করেন ৫৯ শতাংশ মার্কিনি। কিন্তু দ্রুতই দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে। মুসলিমদের সংশ্লিষ্টতায় সহিংসতার ঘটনা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কম থাকলেও ২০০২ সালে এফবিআইএর একটি বার্ষিক রিপোর্টে ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে। এতে দেখা যায়, মুসলিমদের বিরুদ্ধে ‘হেট ক্রাইম’ বেড়েছে ১৬০০ শতাংশ। ২০০০ সালে এমন ২৮টি ঘটনার রিপোর্ট এসেছিল। এর দুই বছর পর তা ৪৮১-তে গিয়ে দাঁড়ায়। ২০০৪ সালে প্রতি চারজনে মাত্র একজন মার্কিনি ইসলাম নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন। পিউ রিসার্চ জরিপ অনুযায়ী ৪৬ শতাংশ মানুষ তখন বিশ্বাস করতো অন্য যে কোন ধর্মের তুলনায় সহিংসতায় উৎসাহ দেয়ার সম্ভাবনা বেশি ইসলামের। পিউ একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয় যাদের গবেষণায় এ চিত্র ফুটে ওঠে। পরের বছর এবিসি নিউজ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ৪৩ শতাংশ মার্কিনি বিশ্বাস করেন, অন্য ধর্মের মানুষদের প্রতি মুসলিমদের সামান্যই সম্মান রয়েছে। ২০০৫ হতে ১০ জনের প্রায় ৬ জন মার্কিনি চিন্তা করতেন ইসলাম সহিংসতাপ্রবণ ধর্ম। জরিপে অংশগ্রহণকারী অর্ধেক মানুষের মুসলিমদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নিম্নমানের। অর্থাৎ ৫ বছরে সংখ্যা পুরোটা উল্টে গেছে। যে সংখ্য মার্কিনিরা একসময় ইসলামকে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতো, ৫ বছরের ব্যবধানে তাদের অভিমত সম্পূর্ণ বিপরীত। ২০০৬ সালেও মুসলিমদের নিয়ে মার্কিনিদের অস্বস্তির মনোভাবে তেমনটা পরিবর্তন আসেনি। ওয়াশিংটন পোস্টের এক জরিপে দেখা যায়, ইরাকযুদ্ধ তার ৪ বছরে প্রবেশ করার সময় নাগাদ অর্ধেক মার্কিনি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইসলামকে দেখেন। ২০০৮-এর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের যে প্রার্থী তার নির্বাচনী প্রচারণায় যুদ্ধ বন্ধ করাটাকে জোর দিয়েছিলেন তিনি মুসলিমবিরোধী মনোভাবের তাপদাহ অনুভব করেছেন। ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী বারাক ওবামার নামটা ছিল অচেনা। আর তার অতীত ইতিহাস ইন্দোনেশিয়া থেকে শুরু করে তার মুসলিম পিতার মাতৃভূমি কেনিয়া পর্যন্ত আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে। যারা মুসলিমবিরোধী অবস্থান আরও জোরদার করতে সচেষ্ট ছিলেন তাদের জন্য সহজ টার্গেটে পরিণত হন ওবামা। ৪৭ বছর বয়সী ওই প্রার্থী যিনি কিনা হতে চলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান প্রেসিডেন্ট, তাকে বিরোধীদের অনেকে মুসলিম হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। এতে করে ভোটারদের যে অংশ ইতিমধ্যে মুসলিমদের নিয়ে আতঙ্কিত ছিলেন তাদের ক্লেশ উসকে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক পরিবেশ এতটাই সংবেদনশীল ছিল যে, খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী প্রার্থী বারাক ওবামা ইসলামের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করার সুযোগ থাকে এমন কোন পরিস্থিতি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে চলেছেন। মিশিগ্যানের ডিয়ারবর্নে ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে জনসাধারণের ছবি তোলার সময় উপস্থিত হিজাব পরা দুই মুসলিম নারীকে সরিয়ে দেন প্রচারণা কর্মীরা। জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির  ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ক প্রফেসর জন এসপোসিটো বলেন, এ ইস্যুতে নির্বাচনী প্রচারণায় ছিল অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা। তৎকালীন ভাবী প্রেসিডেন্ট মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি মুসলিম নই, কোন সময় ছিলামও না।’ ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত এ বক্তব্যের অর্থ এটাই ছিল যেন মুসলিম হওয়া খারাপ কোন কিছু। ইসলামোফোবিয়ার (ইসলাম নিয়ে অহেতুক ভয়-ভীতি) প্রভাব ওই বছরই ইউরোপের উপকূলে পৌঁছায়। পিউ রিসার্চের এক গবেষণায় দেখা যায় ইউরোপজুড়েও একই চিত্র। জরিপে অংশগ্রহণকারী জার্মান ও স্প্যানিশদের অর্ধেকসংখ্যক ইসলাম নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে বলে জানায়। আর পোলিশ ও  ফরাসি নাগরিকদের মধ্যে যথাক্রমে ৪৬ ও ৩৮ শতাংশ ওই দলে।
বিদ্বেষ আর যে কোন কিছুর বিরুদ্ধে বৈষম্যের রীতি অনেক পুরনো। ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকার সমাজ তাদের অতীত ইতিহাসে যেসব সম্প্রদায়কে নিজেদের জাতীয় কাঠামো বহির্ভূত বলে বিবেচনা করেছে, সেসব সম্প্রদায়ের সঙ্গে তারা আচরণ করেছে কুৎসিতভাবে। এসব অসহিষ্ণুতার অনেকাংশের মূলে রয়েছে ‘জেনোফোবিয়া’ (বিদেশীদের নিয়ে অহেতুক ভয় বা ঘৃণা)। বিদেশী শব্দটা বেশিরভাগ ব্যবহৃত হতো সেসব সম্প্রদায়ের জন্য যারা ওই শব্দটি ব্যবহারকারীদের দলের অংশ নয়। তাদের বহিরাগত বিবেচনা করা হয়, যারা অন্য দেশ থেকে এসেছে। যাদের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ মুসলিমদের নিয়ে অনেক ডানপন্থি আমেরিকানদের ধ্যানধারণা প্রধানত হলো- ‘তারা’ আমাদের দেশে স্বাগত নয়। এমন আগ্রাসী এবং একরোখা জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হলো এই ধারণা যে মুসলিমরা অভিবাসী। আর ইসলাম ধর্ম সীমান্তবিহীন কোন বিশ্বাস পদ্ধতি নয়। বরং এর সূত্রপাত অনেক দূরে। আর মরক্কো থেকে বাহরাইনে জনসংখ্যার স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে তা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক মুসলিম অন্য স্থান থেকে এসেছেন সেটা ঠিক। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৫ সালে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে অনেক বেশি মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী নাগরিক হয়েছেন। প্রায় ৯৬ হাজার। আগের দুই দশকের যেকোন দেশের তুলনায় যা বেশি। পিউ রিসার্চের রিপোর্ট থেকে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ৬৪.৫ শতাংশ মুসলিমদের প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী। ফ্রান্সে ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী নতুন অভিবাসীদের দুই-তৃতীয়াংশ মুসলিম বলে ধারণা করা হয়েছিল। আর যুক্তরাজ্যে তা ছিল এক-চতুর্থাংশ। এ সংখ্যাগুলো কিছু মানুষের কাছে উদ্বেগজনক। যারা মাইকেল এনরাইটের মতো মুসলিমদের নেতিবাচক ও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে। অভিবাসী জনসংখ্যার প্রতি তাদের আতঙ্ক স্পষ্ট বর্ণবৈষম্যে রূপ নেয়। রক্ষণশীল একজন মার্কিন রাজনৈতিক ভাস্যকার ড্যানিয়েল পাইপসকে অনেকে যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামোফোবিয়ার গ্রান্ডফাদার বলে বিবেচনা করেন। তিনি বেশ স্পষ্টভাবেই অভিবাসনবিরোধী বর্ণবৈষম্য এবং ইসলামোফোবিয়ার যোগসূত্র তুলে ধরেছেন একটি প্রবন্ধে। ন্যাশনাল রিভিউতে ১৯৯০ সালে লেখাটি ছাপা হয়। তিনি লিখেছিলেন, ‘ব্যাপকহারে বাদামি রঙের মানুষদের অভিবাসনের জন্য পশ্চিমা ইউরোপীয় সমাজগুলো প্রস্তুত নয়। তারা অদ্ভুত খাবার রান্না করে। তারা ঠিক জার্মান মানের স্বাস্থ্যবিধি, পরিচ্ছন্নতা মেনে চলে না। সকল অভিবাসীরা বিদেশী সংস্কৃতি আর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসছে। কিন্তু সব থেকে বেশি সমস্যাযুক্ত হলো মুসলিমদের রীতিনীতি। আর সামাজিক আচারের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে সব থেকে প্রতিরোধী’।
পাইপস যে কারণগুলো তুলে ধরেছেন অনেক মানুষ এসব কারণে ইসলাম ও মুসলিমদের নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। তারা বিশ্বাস করেন অভিবাসীরা যে দেশে পাড়ি দিচ্ছে সেখানকার সংস্কৃতি আপন করে নিতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক। এর ভিত্তি একটি ভ্রান্ত ধারণার ওপর, তা হলো যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহাসিকভাবে প্রধান একটি দলের, যাদের একটি নির্দিষ্ট মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি রয়েছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের কোন রাষ্ট্র ধর্ম নেই। শ্রেণী পদ্ধতি নেই। বা সর্বোচ্চ নৈতিক মতবাদের কোন তালিকা নেই। কাজেই মুসলিম বা অন্য কোন গোষ্ঠী তেমন একটি বিষয় অস্বীকার করছে এমন কল্পনা করা অসম্ভব। তারপরও যেসব পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক মূল্যবোধ সামাজিত আদর্শকে ছাপিয়ে যায় তা সন্দেহের জন্ম দেয় যে জাতিহত, বর্ণগত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সমৃদ্ধির স্বাধীনতা ও সুবিধার সুযোগ নিতে চায়। আর সমৃদ্ধির স্বাধীনতা আর সুবিধাকে মনে করা হয় এককভাবে আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান। বিদেশীদের প্রতি ভয়ভীতি ভৌগোলিক অবস্থানের ওপরও নির্ভর করে। আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান মুসলিমরাও ইসলামোফোবিয়ার আক্রান্তদের কাছে অভিবাসীদের মতোই বিদেশী। তারা জন্মগতভাবে ইউরোপ, আমেরিকার নাগরিক হলেও তাদের অদ্ভুতুড়ে এক গোষ্ঠীর মধ্যে বিবেচনা করা হয়, যেখানে ধর্মবিশ্বাসের কারণে যেন তারা সমাজ বা গোত্রচ্যুত। আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান মুসলিমদের দেখা হয় শুধু মুসলিম হিসেবে। তারা বিদেশী যাদের ধর্মীয় পরিচয়ই প্রাথমিক পরিচয়। ফলে তাদেরকে অমুসলিম আমেরিকান ও ইউরোপীয়ানদের তুলনায় খাটো করে দেখা হয়।  এভাবে একজন মানুষের পরিচয় খ-িত করার অর্থ হলো একজন মানুষের সত্তার একটি দিককে অন্য দিকগুলো থেকে জোর করে আলাদা করা। এ চর্চার ধরন স্পষ্টতই রাজনৈতিক। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভিড়িয়ে দিয়ে এবং দুই গোষ্ঠীর পার্থক্যগুলোকে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করে বিশ্বের কিছু নেতা নৃশংস এজেন্ডা চরিতার্থ করতে সক্ষম হয়েছে। এমন বহু নজির রয়েছে ইতিহাসের পাতায়।

২২ thoughts on “ডানপন্থিরা যেভাবে মুসলিমদের নিয়ে আতঙ্ক তৈরি করে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *