সেদিন আমার এক ফেসবুক বন্ধু তার আর এক ফেসবুক বন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। সেই বন্ধু বিদেশে আসতে আগ্রহী। কি করতে হবে জানতে চায়। বাংলাদেশে মানবপাচারকারীর অভাব নাই। বাংলাদেশে প্রতারকের অভাব নাই। বাংলাদেশে ধোকাবাজের অভাব নাই। বাংলাদেশে মিথ্যাবাদীর অভাব নাই। বাংলাদেশে সুবিধাবাদী মানুষের অভাব নাই। বাংলাদেশে স্বার্থপর মানুষের অভাব নাই। বাংলাদশে হিংসুকের অভাব নাই। বাংলাদেশে কেউ কারু ভাল চায়না । তিন বছর আগে আমি একজন বাংলাদেশীর দ্বারা প্রতারিত হই। এর পরে আমি বাংলাদেশীদের আর বিশ্বাস করিনা। ধীরে ধীরে আমি ফেসবুকে বন্ধু গ্রহণ করা বন্ধ করে দিয়েছি। এই ফেসবুক বন্ধুকে গ্রহণ করার পরে সে আমাকে প্রতিদিন বিরক্ত করতো সেজন্য আমি তাকেও ব্লক করে দিয়েছি।
বিদেশে আসার জন্য যা লাগে তাহলো – টাকা।
দেশে যদি আপনার টাকা থাকে তাহলে সেই টাকা দিয়ে বিদেশে এসে আপনি মনে করেন সেই টাকা থেকে আরো টাকা বানিয়ে আবার দেশে ফিরে যাবেন এবং সেখানে যেয়ে কিছু একটা করবেন অথবা বিদেশেই স্থায়ীভাবে থেকে যাবেন। মধ্যপ্রাচ্যে যারা যায় তাদের জন্য স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়া সম্ভব হয়না। বিদেশে যারা ছাত্র বা ছাত্রী হিসাবে পড়তে আসে তাদের অনেকেই ভাবে তারা বিদেশে এসে কাজ করে অনেক টাকা উপার্জন করে দেশে ফিরে যেয়ে ব্যবসা করবে বা স্বচ্ছল হবে।
বাংলাদেশে যেমন সবাই তিনবেলা খাবার খেতে চায়, মাথার উপরে ছাদ চায়, পড়নের কাপড় চায় তেমনি বিদেশে যারা বসবাস করে তারাও মানুষ সুতারাং বিদেশে থাকার জন্য একটি চাকুরী দরকার, সেই চাকুরীর আয় থেকে খাবার কিনে খাওয়া দরকার, বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকা দরকার ও সেই দেশে চলাফেরা করার জন্য জুতাজামা দরকার, অসুস্থ হলে ডাক্তারের ফি দরকার, ওষুধ কেনার টাকা দরকার। এত দরকার পূরণ করে যদি কিছু টাকা বাঁচে তাহলে দেশে পাঠানো সম্ভব। অন্যদিকে দেশে যারা বসে থাকে তারা ভাবে বিদেশে গেছে সুতারাং ওরা খায়না, থাকেনা, পড়েনা শুধু টাকা কামায় আর সেটা দেশে পাঠায় যাতে দেশে যারা বসে আছে তারা ফ্লাট স্ক্রিন টিভি কিনতে পারবে, টিভিতে সিরিয়ালের মহিলাদের মত শাড়ী কিনতে পারবে, গহনা কিনতে পারবে, মেয়ের জন্য জুতাজামাফিতা ভিডিও গেম কিনতে পারবে এইভাবে বিদেশে থাকা স্বামী, বা ভাই বা বাবার টাকাগুলো সবই বাজারে উড়িয়ে দিতে পারবে যাতে বাজারের ব্যবসায়ীরা মুনাফা করতে পারে। বাজারের ব্যবসায়ীরা মুনাফা করবে বলেই তাদের পন্যের বিজ্ঞাপণ দিয়েছিল যে বিজ্ঞাপণ দেখে প্রবাসীরা বাজারে এই পন্য কেনার জন্য পাগল হয়ে ছুটে। জমিজমা বিক্রি করে বাংলাদেশীরা যায় প্রবাসে । অনেক টাকা আয় করে পরিবারের সবার স্বপ্ন পূরণ করে, আরো অনেক জমিজমা ক্রয় করে বিশাল বাড়ী বানিয়ে গাড়ী কিনে দেশের অন্যান্য সম্পদশালী ব্যক্তিদের সাথে প্রতিযোগীতা দিতে পারবে সেজন্য। সমাজে সবার সাথে উঠাবসা করতে পারবে। কিন্তু অনেক সময় সেটা সম্ভব হয়না।
ইউরোপ বা আমেরিকাতে ছাত্র ভিসা নিয়ে আসার জন্য কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া লাগে। সেজন্য প্রচুর টাকা লাগে। গরীবের ছেলেমেয়েরা সেটা পারেনা। বাংলাদেশে যারা সম্পদশালী তারা এই সম্পদ যোগার করার জন্য কোন না কোন পথ অবলম্বন করেছে যা সৎ না হবার সম্ভাবনা বেশী। সততার সাথে অর্থ উপার্জন করা স্কুল মাস্টার, পুলিশ, আমলা, এমন কি ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তারেরাও কোন দিন এত টাকা জমা করতে পারেনা যা দিয়ে ছেলেমেয়েকে বিদেশে পাঠাবে। এইসব করার জন্য হয় পূর্ব পুরুষের প্রচুর সম্পত্তি থাকতে হবে যা দিয়ে আরো সম্পদ একত্রিত করা হয়েছে নয়তো চুরি বা দুর্নীতি করেই এই টাকা যোগার করতে হবে । বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় দুর্নীতিবাজ বা চোরদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়তে আসে এবং বিদেশেই থেকে যায় কারণ দেশ থেকে বাবামা টাকা পাঠায় ওরা উড়ায়। যারা বিদেশে কাজ করে পড়া করে তারা টাকা জমাতে পারেনা। কাজ করে সেই টাকা দিয়ে টিউশন ফি দিয়ে, বাড়ী ভাড়া দিয়ে, খাওয়া খরচা করে জমানোর জন্য হাতে টাকা বাঁচে না তখন আবার এক বা দুইজন ছাত্র প্রতারণা বিবাহের আশ্রয় নিয়ে বউকে দিয়ে ঋন করিয়ে সেই টাকা মেরে দিয়ে দেশ পালিয়ে যায়। আশা করে দেশে যেয়ে ব্যবসা করে সম্পদশালী হবে। তখন আরো কোন সম্পদশালীর মেয়েকে বিয়ে করে আরো টাকা কামাই করতে পারবে। অথবা বিদেশে বসে দেশের মানুষকে বিদেশে আনার স্বপ্ন দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে প্রতারণা করে। পরে আর তাদের বিদেশে আসা হয়না। প্রতারক নিজেই দেশে ফিরে এসে প্রতারণা করে মারা টাকা উপভোগ করে।
লিটন বেশ কিছুদিন বিদেশে ছিল। তাদের প্রথম সন্তানকে স্বাগত জানাতে লিটন স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। দেশে এসে সে একটি টাইলসের ব্যবসা শুরু করেছে। সেটাই করা উচিৎ বলে আমি মনে করি। নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে বিদেশে যেয়ে কঠিন পরিশ্রম করে সেই পৈত্রিক সম্পত্তি হয়তো ফিরে পাওয়া সম্ভব হয়না। বাজারে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির সাথে প্রতিযোগীতা করে টিকে থাকা সম্ভব নয়। প্রবাসীদের দেশে ফেলে আসা পরিবারের সদস্যদের চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে উপার্জন বৃদ্ধি করাও সম্ভব নয়। যে টাকা বিনিয়োগ করে বিদেশে গেছিল সেই টাকা ফিরে আসতে, সব খরচা মিটিয়ে কিছু টাকা সঞ্চয় করা হয়তো সম্ভব হয়না তাই প্রতিটি প্রবাসী শ্রমিকের উচিৎ আয় বুঝে ব্যয় করা।
সংসারে অনেক খরচা আছে যেসব খরচা করা জরুরী নয়। যেমন টিভি দেখা, ভারতীয় টিভি সিরিয়াল দেখা, আমি বিদেশে থাকি ২৭ বছর আমি টিভি দেখিনা বললেই চলে। টিভি দেখার সময় পাইনা। সারাদিন কাজ, বাজারহাট, রান্না, তারপর ফেসবুকিং করে আর টিভি দেখার সময় হয়না। বাংলাদেশের অনেক মহিলা ঘরে থাকেন, টিভি দেখা ছাড়া ঘরেই অনেক কাজ করা যায়, ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা, তাদের পড়ালেখাতে সাহায্য করা, বাগান করা, রান্না করা, কাপড় ধোয়া, ঘুমানো, ব্যায়াম করা, প্রতিবেশীদের নানাভাবে সাহায্য করা, অনেক কাজ করা যেতে পারে – ফালতু খরচা বন্ধ করা এবং অন্যকে ফালতু খরচা বন্ধ করার উপদেশ দেওয়া। বাংলাদেশে আমি বাজার থেকে সবজী কিনে খেতাম না। সব্জী লাগাতাম। যারা ফ্লাটে থাকে্ন তারাও ঘরে জানালার কাছে সবজী লাগাতে পারেন। ইচ্ছা থাকলে সব কিছুই সম্ভব। প্রবাসীদের সবার পরিবার ঢাকাতে থাকেনা। তাদের কাজের অভাব নাই। সঞ্চয় করার জন্য পরিবারের সকলের সহযোগীতা দরকার। পরিবার গঠন করা হয় শক্তি বৃদ্ধির জন্য, সঞ্চয় করার জন্য, সাশ্রয়ের জন্য – অপচয় করার জন্য নয়।
লিটনের উদাহরণ প্রবাসীদের সঞ্চয়ী হতে উৎসাহিত করবে। অন্যের ব্যবসাতে কস্ট করে উপার্জন করে কিছু সঞ্চয় করে দেশে ফিরে এসে নিজেই কিছু করুন। ব্যক্তিগত সঞ্চয় বৃদ্ধি মানেই দেশের পূঁজি বৃদ্ধি। টিভি সিরিয়ালের পাত্রপাত্রীদের মত আপনিও বাড়ী, গাড়ী, গহনাগাটি সবই কিনতে পারবেন নিজের মুনাফার টাকা দিয়ে দেশেরই অন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। লিটনের মত প্রবাসীরা দেশে ফিরে এসে যদি ব্যবসা শুরু করে তাহলে একে অন্যের ব্যবসায়ের ক্রেতা বা বিক্রেতাও হতে পারবে। উদাহরণ লিটন এখন টাইলসের ব্যবসা দিয়েছে অন্য একজন যদি প্রবাসী যদি দেশে ফিরে এসে বিল্ডার্সের ব্যবসা দেয় তাহলে লিটন তাকে টাইলস সরবরাহ করতে পারবে। লিটনের যদি বিল্ডার্সের দরকার হয় বা অন্য কোন বন্ধুর যদি তার জমি বিল্ডার্সের কাছে দিতে চায় তাহলে লিটন রেফারেন্স দিতে পারবে। এইভাবে প্রবাসী বাংলাদেশীরা দেশে ফিরে এসে একে অন্যের সাথে তাদের নিজ নিজ ব্যবসা প্রতিষ্টানের মাধ্যমেই নিজ নিজ ব্যক্তি স্বার্থের কারনেই বিশ্বস্থতার সাথে ও গ্রহনযোগ্য মুনাফার সাথে সফলভাবে ব্যবসা প্রতিষ্টান চালিয়ে নিতে পারবে ।
যেকোন সিদ্ধান্ত নেবার আগে ভেবে দেখতে হবে আপনার বিনিয়োগ থেকে মুনাফা হবে কি হবেনা। মুনাফা করার পেছনে কি কি বাঁধা আসতে পারে। প্রবাসে চাকুরীর নিশ্চয়তা যদি না থাকে তাহলে দেশের বিষয় সম্পত্তি বিক্রি করে বিদেশে যাবার কোন যুক্তি আছে কিনা ভেবে দেখা দরকার। অনেকেই বলে দেশে কিছু করার নাই। আবার অনেকেই ছবি পোস্ট করে দুবাইয়ের গলিতে ইটের উপরে মাথা দিয়ে বাংলাদেশীরা ঘুমাচ্ছে। অথবা জাহাজে ভাসছে। অথবা কবর থেকে লাশ উঠছে। এই অবস্থায় যাবার জন্য নিশ্চয় অনেক টাকা খরচা করতে হয়েছে। জাহাজে উঠার আগে বা প্লেনে উঠার আগে নিশ্চয় দালালকে বা মানব পাচারকারীকে টাকা দিতে হয়েছে। এই টাকা কোথা থেকে এসেছে? মানব পাচারকারীর হাতে এই টাকাগুলো তুলে দেবার আগে ভাবতে হবে এই টাকা দিয়ে দেশে কিছু করা যায় কিনা।
অনেকেই ফেসবুকে অনেক ভুয়া আইডি করে তারপর প্রবাসীদের সাথে যোগাযোগ করে টাকা চায়। এটা একটা প্রতারণা ব্যবসা । নানা রকমের ছবি দেখিয়ে (ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য টাকা চায়, রাজনৈতিক হত্যার পরে বিধবা ও এতিমের জন্য টাকা চায়, একবার দেখা গেছে একটা ছবি পাঁচ বছর আগের এক মহিলার ছবি। যা এখন ব্যবহার করা হচ্ছে টাকা আদায়ের জন্য, এই মহিলার ছবি নেওয়া হয়েছে ভারতের একটি পত্রিকা থেকে । নিয়ে নিজের মা বলে চালিয়ে দিচ্ছে আর একজন মহিলার ছবি ফেসবুকের প্রফাইলে দিয়ে। এখানে একজন প্রতারক প্রতারণার কাজে দুইজন মহিলার ছবি ব্যবহার করছে। অনেকটা নাটকের চরিত্রের মত চরিত্র সৃষ্টি করেছে। মায়ের ক্যান্সারের জন্য মেয়ে সাহায্য চাচ্ছে। মা ও মেয়ে একজন আর একজনকে চিনেনা। তারা জানেনা তাদের ছবি কে ব্যবহার করছে। )অনেক প্রবাসী এইসব প্রতারকের খপ্পড়ে পড়ে টাকা পাঠিয়ে দেয়। প্রতারকেরা বাংলাদেশে বসে “নারিকেল চিংড়ী” রান্না করে রেসিপি ও ছবি পোস্ট করে অন্য একজন সম্পদশালী বিধবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আরো একটি ফাঁদ রচনা করে।
প্রবাসীরা জনপ্রিয় হতে চায়, সমাজসেবক হতে চায়, লাইক পেতে চায় আর এইভাবে নিজেদের কস্টার্জিত টাকা প্রতারকের হাতে তুলে দেয়। তিন বছর আগে আমি প্রতারিত হবার পর থেকে ক্রমাগত লিখছি। মানুষকে সাবধান করার চেস্টা করছি। অনেকেই ভাবে তারা স্মার্ট এবং তাদের মত বাংলাদেশের সব মানুষ স্মার্ট। সেটা যদি সত্য হতো তাহলে বাংলাদেশে এত প্রতারকের জন্ম হতোনা। প্রতারণার ব্যবসা ভাল বলেই বাংলাদেশে প্রতারক বেশী। বাজারে প্রতারকের চাহিদা আছে, বাজারে প্রতারকের প্রতারণা করার সুযোগ আছে, সমাজে নিঃসঙ্গ মহিলা আছে, সমাজে বিধবা আছে, সমাজে সহজ সরল কোমল প্রান মা আছেন, বোন আছেন, এরা সবাইকে সাহায্য করতে চায় একে অন্যকে তারপর প্রতারকের খপ্পড়ে পড়ে নিজেদের টাকা হারায়। প্রতিটি প্রতারিতের উচিৎ তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করা। বাজারের প্রতারকদের মুখোশ উন্মোচিত করে প্রতারণার বাজারকে সংকুচিত করা। প্রতারণার বাজার সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে সৎ মানুষকে কেউ বিশ্বাস করতে চায়না। প্রতারকেরা মিস্টি কথা বলে, পিঠে ছুরি ভুকে দিয়ে টাকাকড়ি নিয়ে বদনাম করে পালিয়ে যায়। প্রতারিত শুধু টাকা হারায় না, সাথে বিশ্বাস ও আস্থাও হারিয়ে ফ্যালে।
লিটনের টাইলসের ব্যবসাতে ফিরে আসি । নীচে লিটনের টাইলস ব্যবসার ফেসুবক পেজ এর লিঙ্ক দেওয়া হলো । সবাই এই পেজ এ ভিজিট করুন। লিটনের মত ব্যবসা শুরু করুন। লিটনকে আপনাদের মডেল হিসাবে গ্রহণ করুন। সবার হয়তো টাইলসের দরকার নেই কিন্তু লিটনের অভিজ্ঞতা থেকে জানার দরকার আছে।
Zain Enterprise A house of Tiles