বিড়ি খাবার পয়সা বাঁচিয়ে ভালো কাজ, বিনিময়ে পুলিশী রিমান্ড!

রাজধানীর রামপুরার বনশ্রী এলাকার একটি বাসায় ১০ ছিন্নমূল শিশুকে আশ্রয় দিয়ে, খাইয়ে, পরিয়ে অবশেষে দু’দিনের রিমান্ডে গেলেন ‘অদম্য বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থার চার কর্মকর্তা।

রোববার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জাকির হোসেন টিপু সাতদিনের রিমান্ড আবেদনের শুনানি শেষে দু’দিন আদেশ দেন। রিমান্ডকৃতরা হলেন- আরিফুর রহমান (২৪), হাসিবুল হাসান সবুজ (১৯), জাকিয়া সুলতানা (২২) ও ফিরোজ আলম খান শুভ (২১)।

এদিন মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা রামপুরা থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আসাদুজ্জামান আসামিদেরকে আদালতে হাজির করে সাতদিনের রিমান্ডের আবেদন করেন।

শুনানিকালে ম্যাজিস্ট্রেট এক নম্বর আসামি আরিফুর রহমানের সাথে কথা বলেন। ম্যাজিস্ট্রেট জানতে চান, কীভাবে তারা শিশুদের সংগ্রহ করতেন? জবাবে আসামি আরিফুর বলেন, ‘ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে যেমন- সদরঘাট, কমলাপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা কমপক্ষে ২ থেকে সর্বোচ্চ ৩ মাস বিভিন্ন ছিন্নমূল বাচ্চাদেরকে পর্যবেক্ষণ করে। যদি দেখা যায় একই বাচ্চা দিনের পর দিন একই স্থানে থাকছে এবং অন্য কোথাও যাচ্ছে না, তখন আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা তাদেরকে আমাদের শেল্টারে আসার জন্য বলতো। যারা আগ্রহী হতো তাদেরকে নিয়ে আসা হতো।’

এরপর বিচারক ওইসব আসামিদের আর কোনো বক্তব্য শুনতে চাননি। আদালতের বাইরে এসে ওই চার আসামির আত্মীয়-স্বজন এবং উদ্ধারকৃত ১০ শিশুর মধ্যে ছয় শিশুর অভিভাবকদের সাথে কথা বললে বেরিয়ে আসে নিঃস্বার্থভাবে সমাজসেবা করতে গিয়ে ফেঁসে যাওয়া ওই চার তরুণের ভাগ্য বিড়ম্বনার কথা।

প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও মামলার এক নম্বর আসামি আরিফুর রহমানের বড় বোন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, গত প্রায় তিন বছর ধরে তার একমাত্র ভাই ছিন্নমূল বাচ্চাদের উন্নত জীবনদানের জন্য অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সে তাদের পরিবারকে কোনো সময় দিত না। আমরাও তার কাছে সময় চাইনি। আমরা চেয়েছি তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হউক। কিন্তু আজ এটা কি হচ্ছে? বলেই তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন।

received_984534451609944

তার সাথে থাকা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ করা আরো প্রায় ৭/৮ জন তরুণীও কাঁদতে শুরু করেন। এছাড়া পাশে থাকা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া অন্ততঃ ২০-২৫ যুবকও তাদের ওই চার কর্মকর্তার নিঃস্বার্থ সমাজসেবার কথা এবং এর সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা জানান। টিভিতে এই সম্পর্কিত সংবাদ দেখে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও ছুটে এসেছেন অনেক যুবক।

ভৈরব থেকে আসা সুব্রত সাহা নামে এক কলেজ পড়ুয়া যুবক জানান, তারা ফেসবুকের প্রায় শতাধিক বন্ধু নিজেদের সিগারেট খাওয়ার টাকা জমিয়ে প্রতি মাসে দেড়শ টাকা করে এখানে দেন।

উদ্ধারকৃত বাচ্চারা হলো- মোবারক হোসেন (১৪), আবদুল্লাহ আল মামুন (১১), বাবুল (১০), আব্বাস (১০), স্বপন (১১), ইব্রাহিম আলী (১০), রাসেল (১০), ফরহাদ হোসেন (৯), আকাশ (৯), ও রফিক (১৪)।

এরপর উদ্ধারকৃত ওই ১০ শিশুর মধ্যে নয়জনের সাথে কথা বললে সবাই একবাক্যে রিমান্ডকৃত কর্মকর্তাদের প্রশংসা করে। ওইসব বাচ্চাদের মধ্যে স্বপন, বাবলু, আকাশ, রফিক, রাসেলকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তোমরা সেখানে কেমন আছো? উত্তরে জানায়, সেখানে বেশ ভালো আছে তারা। তোমরা আবারো সেখানে ফিরে যেতে চাও কি না। শিশুরা বলে, হ্যাঁ আমরা ফিরে যেতে চাই।

তখনই পাশে থাকা এক পুলিশ কনস্টেবল বলে, কিসের ফিরবে? ওইখানে কোনো পড়ালেখার ব্যবস্থা, চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা নেই, কোথায় যাবে এরা?’ সাথে সাথেই ওই পুলিশের মুখের উপর কড়া প্রতিবাদ জানায় ওই শিশুরা। তারা বলে, হেয় তো দেহি কিচ্ছুই জানে না।

এরপর পক্ষ হতে শিশুদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তোমাদের সেখানে টিভি আছে কি না? জবাবে ওরা বলে, আমাদের টিভি আছে, আমাদের খেলার জন্য ছোট ছোট বল আছে। এদের মধ্যে কয়েকজনকে কম্পিউটার কম্পোজ শিখানো হচ্ছে বলেও জানায় ওইসব শিশুরা।

তবে উদ্ধারকৃত শিশুদের মধ্যে কুমিল্লার মোবারক হোসেনকে অন্যসবার কাছ থেকে আলাদা রাখা হয়েছে। নয় শিশুকে রাখা হয়েছে সিএমএম আদালতের নীচে বিচারপ্রার্থীদের ওয়েটিং রুমে। আর মোবারককে রাখা হয়েছে গারদখানার ভেতর কোনো একটা রুমে। অনেক চেষ্টা করে তার সাথে কথা বলা যায়নি। মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ওই শিশুর চাচা মো. মনির হোসেনের মামলার ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালায় পুলিশ।

এজাহারে বর্ণিত বাদীর বক্তব্য মতে, গত ছয়মাস ধরে মোবারককে সেখানে আটকে রাখা হয়েছিল। এ ব্যাপারে উপস্থিত প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবীদেরকে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন, ওই ছেলেটি কখনোই তার সঠিক কোনো ঠিকানা বলতে পারেনি। সে কখনোই কোথাও যেতেও চায়নি। হঠাৎ করে পুলিশের অভিযান এবং ওই বাচ্চার বক্তব্যে আমরাও বিস্মিত।

উদ্ধারকৃত শিশু রাসেলের বাড়ি ময়মনসিংহে। তার বাবা মো. জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমি স্যারদের মুক্তি চাই। এরা খুব ভালো মানুষ। আরিফ স্যার ও জাকিয়া ম্যাডাম আমার ছেলেরে নিয়া গত নয় মাসে দুইবার আমার বাড়িতে গেছে। আপনারা দেখেন তাদের লাগি কিছু করতে পারেন কি না।’

উদ্ধারকৃত শিশুদের বক্তব্য এবং রিমান্ডকৃতদের আত্মীয়-স্বজন, শুভানুধ্যায়ী এবং স্বেচ্ছাসেবীদের চোখের পানি ও আকূতি দেখে এই কথা বলা যায় যে, নিঃস্বার্থ সমাজ সেবা করতে গিয়ে আজ রিমান্ডে যেতে হলো অদম্য বংলাদেশ ফাউন্ডেশনের অদম্য চার কর্মীকে।

১৫ thoughts on “বিড়ি খাবার পয়সা বাঁচিয়ে ভালো কাজ, বিনিময়ে পুলিশী রিমান্ড!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *