প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট আন্দোলন

১৬-১২-১৯৭১ থেকে ১৩/০৯/২০১৫ – তা প্রায় ৪৪ বছর। এই ৪৪ বছরে পূর্ব বাংলা এখনও আন্ডার ডেভেলপড বা উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। কেনো? উন্নত দেশ এর সংজ্ঞা কি? যে দেশের কোন মানুষ না খেয়ে থাকেনা বা রাস্তায় ঘুমায়না বা ক্রসফায়ারে মরেনা বা ধর্ষিতা হয়ে মাঠের মাঝখানে পড়ে থাকেনা। ভাত, কাপড়, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, শিক্ষা সব কিছুই যখন দেশের আপামর জনগনের নাগালের মধ্য থাকে তখন সেই দেশকে উন্নত দেশ বলা হয়। তবে শান্তনা মিলেছে সেদিন যখন কে জানি বাংলাদেশকে “মধ্যম আয়ের” দেশ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। সবাই মোটামুটি খুশী। মধ্যম আয়ের দেশে মাছের বদলে নদীতে গলায় গামছা লাগানো লাশ ভাসে। বৃষ্টি হলেই মধ্যম আয়ের দেশ ভেনিসের মত হয়ে যায় । রাজপথে নৌকার মত রিকশা চলে। গাড়িগুলো সব পথচারীদের গোসল করিয়ে দিয়ে যায়। সবাই মোটামুটি সুইমিং পুলেই দিন কাটিয়ে দেয়। বাংলাদেশের ময়লা নিস্কাষনের ব্যবস্থাও আন্ডার ডেভেলপড ফলে মানুষ আর ময়লা সব কিছুই একসাথে বৃষ্টির পানির সুইমিং পুলে ভাসে।

তাহলে ভ্যালু এডেড ট্যাক্স বা VAT আদায় করে সেই খাজনার টাকা কোন কাজে ব্যয় হয়?
দেশ যদি আন্ডারডেভেলপড হয় তাহলে এই খাজনা দেশের মানুষ দেবে কোথা থেকে?
জনগনের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা হয় সেই খাজনার টাকা দিয়ে জনগনের চলাচলের জন্য রাস্তা, ব্রিজ, জনগনের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল, জনগনের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ, জনগনের শিক্ষার জন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, জনগনের বেকার সমস্যা দূর করার জন্য ব্যবসায়ীদের উৎপাদনে উৎসাহিত করার জন্য কম সুদে ঋন, ইত্যাদি নানাকাজে ব্যবহার করা হয়। যারা অনেক বেশী আয় করে তাদের কাছ থেকে বেশী হারে খাজনা আদায় করা হয় যাদের আয় কম তাদেরকে খাজনা মওকুফ করে দেওয়া হয়। যারা জনগনের প্রতিনিধি ও জনগনের সেবক তারা জনগনের জন্য এইসব কাজ করার পারিশ্রমিকও এই খাজনার টাকা থেকেই পেয়ে থাকে।

বাংলাদেশে খাজনা আদায় করা হয় কিন্তু এই খাজনার টাকা কিভাবে ব্যয় হয় সেটা জনগনের কাছে সুস্পষ্ট নয়। বাংলাদেশের রাস্তাঘাট ভাঙ্গা, সাড়া বাংলাদেশে যখন তখন পুলিশে গুলি করে মানুষ হত্যা করে, বাংলাদেশের হাসপাতালে ভুয়া ডাক্তারে মানুষ হত্যা করে, বাংলাদেশের আদালতে ভুয়া উকিলে অসহায় মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রতারণা করে, বাংলাদেশের সরকার জনগনের দ্বারা নির্বাচিত সরকার না হবার কারণে জনগনের জন্য সরকারের কোন দায় দায়িত্ব নেই। খাজনা আদায় চলে কিন্তু খাজনার টাকা স্বনির্বাচিত সরকারের স্বৈরশাসনে ব্যয় হয়ে যায়। খাদ্যের উপরে খাজনা আদায় করে সেই টাকা দিয়ে বুলেট কেনা হয়। মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্টার প্রশ্ন এখন একটি ভীতিকর স্বপ্নের মতো।

এখন বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন করছে। ওরা পোস্টারে লিখেছে – গুলি কর, ভ্যাট দিমুনা।

বাংলাদেশে যারা না খেয়ে থাকে তাদের ভাত কেনার টাকা নাই তাই না খেয়ে থাকে। তারা কেউ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েনা। বাংলাদেশের যারা শ্রমিক তারা কেউ বা তাদের ছেলেমেয়েরা কেউ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েনা। প্রশ্নই উঠেনা। বাংলাদেশের দরিদ্র ও কম আয়ের কর্মজীবি মানুষ যারা বাজার থেকে যা কিছু কেনে তার উপরেই ভ্যাট প্রদান করে শূন্য হাতে ঘরে ফেরে তাদের ছেলেমেয়েরা কেউ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েনা। বাংলাদেশের সম্পদশালী পরিবারের ছেলেমেয়েরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বাংলাদেশে সম্পদশালী কারা ?? বাংলাদেশে আমি যে বাসাতে ভাড়া থাকতাম সেই বাসার পাশে একটি পাঁচতলা ভবন ছিল। সেই ভবনের মালিককে দেখতে যেকোন রিকশাওয়ালার মত। মানুষের চেহারা আল্লাহ্র দান। আমি রিকশাওয়ালাদের মত দেখতে বলার কারণ হলো রিকশাওয়ালারা কম আয় করে এবং বাজার থেকে লুঙ্গি আর শার্ট কিনে পরিধান করে, ভাল ভাল ব্রান্ড নামের কাপড় পরিধান করেনা ফলে সব রিকশাওয়ালার পোষাকে এক ধরনের মিল থেকে যায়। সেই পাঁচতলা ভবনের মালিক সকালে বেড়িয়ে যেতেন আর দুপুরের আগেই বাসায় ফিরে আসতেন। একদিন আমি আমাদের বাবার বাসার জমি রেজিস্ট্রি করার জন্য মিনিস্ট্রিতে গেলাম দেখি আমার প্রতিবেশী পাঁচতলা ভবনের মালিক একটি দরজার সামনের চারপা সিটে বসে আছে।

মিনিষ্ট্রির সেক্রেটারিদের দরজার সামনের চারপেয়েতে যারা বসে থাকে তাদের ইংরেজের আমলে আর্দালী বলা হতো। ORDERLY — আর্দালীরা আমলার হুকুমে ফাইলপত্র বহন করতো, চায়ের কেতলি, এখন ওরা আমলার জন্য ঘুষ গ্রহণ করে। নিজের ভাগেও রাখে। এইভাবে পাঁচতলা ভবনের মালিক হয় এবং ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করতে পারে।

ঘুষ না দিলে বাংলাদেশের কোথাও কোন কাজ হয়না। যারা বিভিন্ন জাগাতে কাজ করে যেখানে ঘুষ দেওয়া ও নেওয়া বাধ্যতামূলক তাদের আয় ভাল এবং তারা তাদের ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করতে পারে। যারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করতে পারে তাদের এই ভর্তির ফি’র উপরে খাজনা দিতে অসুবিধা কোথায়?

সরকারের যুক্তি হলো – দুর্নীতি করে সম্পদশালী হয়ে তোমার ছেলেমেয়েদের যদি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করতে পারো তাহলে এইসব ছাত্রছাত্রীরা বিদ্যান হয়ে দুর্নীতির ধারা অব্যাহত রাখবে ফলে দুর্নীতিতে ভ্যালু সংযোজিত হবে অথবা দুর্নীতি বা অপরাধ ভিত্তিক সমাজ শক্তিশালী হবে, দুর্নীতি বা অপরাধে মূল্য সংযোজিত হবার কারনেই এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সবাইকে ভ্যাট দিতে হবে।

এই ভ্যাটের টাকা ব্যবহার করা হবে তাদের জন্য যারা বাংলাদেশের সমাজকে অপরাধভিত্তিক সমাজ হিসাবে গড়ে তুলেছে ও টিকিয়ে রেখেছে। বাপের চুরির টাকা থেকে ৭.৫% ভ্যাট চাহিয়া জাতির ভবিষ্যত দুর্নীতিবাজদের লজ্বায় ফেলে দিয়েছে সরকার। বাংলাদেশের হাজারো অপরাধের বিরুদ্ধে, সরকারের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে, ভুয়া মামলা, জেল, জুলুম, গুলির বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কখনও আন্দোলন করেনি, করলে সেটা স্ববিরোধী হতো। নিরীহের উপরে হওয়া অপরাধের বিরুদ্ধে অপরাধী বা অপরাধীদের ছেলেমেয়েরা বিদ্রোহ ঘোষনা করেনা। অপরাধীদের উপরে লাগানো ট্যাক্সের বিরুদ্ধে অপরাধীদের ছেলেমেয়েরা এখন আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছে এই শ্লোগানে NO VAT on Education

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশের জনগনের জন্য কোন কাজে লাগেনি
খাজনার টাকাও বাংলাদেশের আপামর জনগনের কল্যানে ব্যবহৃত হয়না
বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট বিরোধী আন্দোলনও তাই প্রাইভেট আন্দোলন।



৫ thoughts on “প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট আন্দোলন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *