বহুতি গুচ্ছ গ্রামের তায়রন বেগম। স্বামী নজরুল পায়ের সমস্যার কারণে কাজই করতে পারে না। তায়রন-নজরুল দম্পতির সংসারে ৩ মেয়ে। সংসারের খরচ তায়রনকেই বহন করতে হয়। অভাবের সংসার চালাতে স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নেন। এছাড়া ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক, আশা, আইআরডিপি, ব্যুরো বাংলা নামক ৫টি এনজিওতে ঋণ হয়ে যায় ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। পাওনাদারদের কাছ থেকে চাপ আসতে থাকে। বাধ্য হয়ে কিডনি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকায় এসে কাজ নেন গার্মেন্টসে। পরিচয় হয় এক দালালের সঙ্গে। দালাল নিয়ে যান কিডনি ত্রুেতার কাছে। পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয়। টিস্যু এবং রক্তের গ্রুপ মিলে যায়। জানান স্বামীকে। তিনি তায়রনকে নিয়ে পালিয়ে বাড়ি চলে যান। পরে মামলা দেন ক্রেতা। শর্ত দেন, কিডনি দিলে মামলা তুলে নিবেন। পরে বাধ্য হয়ে কিডনি দিতে রাজি হয় তায়রন। আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে ব্যাঙ্গালোরের একটি হাসপাতালে খালাত বোনের সম্পর্ক দেখিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। দাদন ও এনজিও ঋণ পরিশোধ করেন। এখন কোনোভাবে চলছে তার দিন। ভবিষ্যতে কি হবে তার কিছুই জানেন না তায়রন।
তেলিহার গ্রামের মুক্তি বেগমের গল্প আরও করুণ। এ বছরের ২৩ জুন কিডনি বিক্রি করেছেন তিনি। বাবা নাপিত। অভাবের কারণে ছোট বোনকে বিয়ে দেয়া যাচ্ছিল না। কিছু দেনাও হয়েছিল। ছোট বোনের মুখে হাসি ফোটাতে ঢাকা যায় মুক্তি। পরিচয় হয় গার্মেন্টসের সুপারভাইজার মাশফিকুর রহমানের সাথে। তার বাবার কিডনির প্রয়োজন। রাজি হয়ে যায় মুক্তি। ৪ লাখ টাকায় বিক্রি করেন একটি কিডনি। পরীক্ষায় ম্যাচিং হওয়ায় কলকাতার ৭০৩ আনন্দপুরের ফোরটিস হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়।
কেবল তায়রন ও মুক্তি নয় গত ৮ মাসে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলায় আকলাপাড়ার আনোয়ার হোসেন, করমকার হেলাল উদ্দিন, রাঘবপুরের শুকুর আলী ও হাফিজার, দুদাল নয়াপাড়ার রানী, মরি, হেলাল ও সোবহান, তেলিহারের মুক্তি, তোফেলা, মিনা ও মনোয়ার হোসেন মুন্নু, কাউরাল আবাসনের বায়েজিদ, বাগইলের তোফেল, সাহারুল ও জুয়েল, সিমরাইলের নূরনবী ওরফে হুন্ডিল, এনামুল ও মাফু, বহুতির মামুন ও আব্দুল হামিদ, জয়পুর বহুতির শুকরা, হানজেলা, মাজেদা, মোশার্রফ ও তার ছেলে, বহুতি আবাসনের ছারভানুসহ অন্তত ৪০ জন কিডনি বিক্রি করেছেন।
এভাবে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলায় অভাবীদের কিডনি বিক্রির ঘটনা চলছেই। অনেক হইচই সত্ত্বেও এ অপকর্ম বন্ধ হয়নি। দালালচক্র সেখানে সক্রিয় রয়েছে। এই চক্রের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য স্থানেও কিডনি ব্যবসা ছড়াচ্ছে বলেও অভিযোগ আছে।
কালাইয়ের ২০ গ্রামের কমপক্ষে ৪০ জন ঋণগ্রস্ত ও অভাবী মানুষের কিডনি বিক্রির তথ্য মিলেছে। এসব অস্ত্রোপচারের অধিকাংশই হয়েছে বিদেশে। কিডনি বিক্রির কারণ হিসেবে অনেকেই বলেছেন, দাদন এবং এনজিওর ঋণের কিস্তি পরিশোধের কথা। ঋণের টাকা শোধ দিতে না পেরে বাধ্য হয়ে তারা কিডনি বিক্রি করেছেন। কেউ দালালচক্রের চটকদার কথায় বিভ্রান্ত হয়েছেন। কিডনি বেচাকেনায় কড়াকড়ি আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে এখন কাগজপত্র জাল করাসহ নিত্যনতুন কৌশলে এই ব্যবসা চালাচ্ছে দালাল চক্র।
শুরুতে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হতো ঢাকার নামিদামি বিভিন্ন হাসপাতালে। কিন্তু বিভিন্ন গণমাধ্যমের সুবাদে ২০১১ সালের ৩০ আগস্ট এ সংক্রান্ত সংবাদ জানাজানি হলে কিডনি বিক্রেতারাও পরিবর্তন করে তাদের কৌশল। পুরনো দালালরা নতুন নতুন দালালের মাধ্যমে নতুন কিডনি বিক্রেতাদের ঢাকায় এনে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেই রিপোর্টগুলো সংরক্ষণ করেন। যে রোগীর সাথে যে বিক্রেতার পূর্ব পরীক্ষিত ওই রিপোর্ট ম্যাচিং হয়, তার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে বিদেশে যাওয়ার যাবতীয় কাগজপত্র তৈরি করা হয়। তারপর সুযোগ মতো বিদেশে গিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, নতুন কৌশলে এখন কিডনি বিক্রেতাদের নাম ঠিক রেখে পরিবর্তন করা হচ্ছে মূল ঠিকানা। ব্যবহার করা হচ্ছে ভুয়া বাবা-মায়ের নাম। কিডনি গ্রহীতার সঙ্গে বিক্রেতার রক্তের সম্পর্ক দেখিয়ে কিডনি গ্রহীতাদের স্ব-স্ব এলাকার ইউনিয়ন/পৌরসভা থেকে সনদ নেয়া হচ্ছে। জাল করা হচ্ছে কিডনি বিক্রেতার জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন ও নাগরিকত্ব সনদ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া ডাক্তারি ব্যবস্থাপত্রও তৈরি করার খবর পাওয়া গেছে। পাসপোর্ট তৈরির সময় পুলিশ পরিদর্শন প্রতিবেদন দাখিলের আগে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে কিডনি বিক্রেতাদের পরিবর্তিত নতুন ঠিকানায় সশরীরে উপস্থিত দেখানো হয়।
সম্প্রতি কিডনি বিক্রি করেছেন এমন কয়েকজনের কাগজপত্র ঘেঁটে নানারকম অসঙ্গতি দেখা গেছে। কালাই উপজেলার বোড়াই গ্রামের বাসিন্দা মোকাররমের জন্মনিবন্ধন ও নাগরিকত্ব সনদ এবং পাসপোর্টে দেখা যায়, কেবল নাম ঠিক রেখে কিডনি গ্রহীতার সঙ্গে আপন ভাইয়ের সম্পর্ক দেখিয়ে তাকে কুমিল্লা সদরের স্থায়ী বাসিন্দা দেখানো হয়েছে। সপক্ষে ইউনিয়ন পরিষদের সনদও আছে। দেশের বিদ্যমান আইনে রক্ত সম্পর্কীয় পিতামাতা, ভাইবোন, চাচা, ফুফু এবং খালা ছাড়া অন্যদের মধ্যে কিডনি আদান-প্রদান করা অবৈধ। তবে স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে কিডনি দিতে পারবেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জয়পুরহাট জেলায় ১৫ সদস্যের একটি দালালচক্র এখনো কিডনি ও শরীরের অঙ্গপতঙ্গ বিক্রির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত। আন্তর্জাতিক চক্রের ঢাকায় মূল নিয়ন্ত্রক তারেক আযম ওরফে বাবুল চৌধুরী, সাইফুল ইসলাম দাউদ এবং কুড়িগ্রামের রাজা নামে তিন প্রভাবশালী দালাল। স্থানীয় দালাল চক্রের প্রধান বহুতি গ্রামের আব্দুস সাত্তার। এছাড়া রয়েছে একই গ্রামের গোলাম মোস্তফা ও বোরহান আব্দুল করিম ফোরকান। ভেরেন্ডি গ্রামের আখতার আলম, জাহান আলম, ফারুক হোসেন, আব্দুর ওয়াহাব, জাহিদুল ইসলাম ও রেজাউল ইসলাম, সাতার গ্রামের সৈয়দ আলী, নওয়ানা বহুতি গ্রামের মোকাররম হোসেন, জয়পুর বহুতি গ্রামের আব্দুল মান্নান, রুহুল আমিন, মোকাররম হোসেন ও উলিপুরের তোজাম।
বিদেশে বেশিরভাগ অস্ত্রোপচার: ২০১১ সালে দেশজুড়ে হইচই শুরু হয়। পূর্বে যারা কিডনি বিক্রি করেছিল, তাদের অধিকাংশেরই কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল ঢাকায় বিভিন্ন হাসপাতালে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এখন যাদের দালালচক্র নিয়ে যাচ্ছে তাদের অস্ত্রোপচার হচ্ছে বিশেষত ভারতের ব্যাঙ্গালোরে অবস্থিত কলম্বো-এশিয়া হাসপাতাল, মেডিকা হাসপাতাল এবং সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন হাসপাতালে।
আরও ৬ জেলায় বেচাকেনা: অনুসন্ধানে জানা গেছে, কিডনি বিক্রির এ প্রবণতা এখন আর কেবল জয়পুরহাটের কালাইয়ে সীমাবদ্ধ নেই। দেশের আরও অন্তত ৬টি জেলা- ঢাকা, মাগুরা, রাজশাহী, সিলেট, সিরাজগঞ্জ ও বরিশালেও ঋণগ্রস্ত অভাবী মানুষ কিডনি বিক্রি করেছেন। জড়িত চক্রগুলোর সঙ্গে আলাপকালে এমন তথ্যের আভাস পাওয়া গেছে।
প্রশাসন নির্বিকার: পুলিশের হিসাব মতে, ২০১১ সালে এই উপজেলার ৪টি ইউনিয়নে কিডনি বিক্রেতার সংখ্যা ছিল ৭৩ জন। এখন এ সংখ্যা বেড়ে দু’শর ঘর ছেড়েছে। সে সময় দেশের ৩১ জন কিডনি বিক্রি চক্রের দালালের নামে ৪টি মামলা দায়েরের পর অনেক দালালকেই গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই সব মামলায় সব আসামিরা জামিনে রয়েছে বলেও জানা গেছে। ২০১১ সালে কিডনি কেলেংকারির ঘটনা ফাঁসের পর সক্রিয় হয়েছিল স্থানীয় প্রশাসন। এখন তা ঝিমিয়ে পড়েছে। জানা গেছে, পুনরায় কিডনি বেচাকেনা শুরু হওয়ায় দালালচক্রের বিরুদ্ধে গত বছরের ৫ ও ১৩ সেপ্টেম্বর এবং চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি কালাই থানায় মোট ৫টি মামলা করা হয়েছে।
Arif Ahmed liked this on Facebook.
Moin Ahmed liked this on Facebook.
Md Abdullah All Fahad liked this on Facebook.
Sadat Khan liked this on Facebook.