বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি। লেসফিতাওয়ালারা, ছিটকাপড়ওয়ালারা এখন আর কাধে বোঁচকা বেঁধে বিভিন্ন মহল্লার অলিগলিতে ফেরী করেনা সম্ভবত। এখন ভারতীয় সাংস্কৃতি থেকে বিজ্ঞাপন বা কাটালগ দেখে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের পন্য বিক্রি হয় বাংলাদেশের সুপার মার্কেটগুলোতে। ১৯৮৬ সালে আমি একটা শাড়ী কিনেছিলাম বাসায় বসে। দাম ৫০ টাকা। সবুজ তাঁতের শাড়ী। বাংলাদেশে তৈরি। ভারতীয় মুভি আমিও দেখেছি । ১৯৮০-৯০ পর্যন্ত মুক্তিপ্রাপ্ত বা ১৯৫০-৮০ সালে নির্মিত প্রায় সব ভারতীয় মুভি আমি দেখেছি। ভারতের টিভি সিরিয়াল আমিও দেখেছি। আমার মনে হয়েছে ভারতের যেকোন তারকার চাইতে আমি দেখতে ভাল। আমি সাজগোজ না করলেও আমাকে সুন্দর দেখা যায়। কারণ আমার মন সুন্দর । যার মন সুন্দর তার চেহারাতে তার মনের ছায়া ফ্যালে। আমি বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের একজন প্রেমিকা। আমি বাংলাদেশকে ভালবাসি। বাংলাদেশের শ্রমিকদের ভালবাসি। আমি মনে করি বাংলাদেশের শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বাংলাদেশের সবাইকে সহযোগীতা করতে হবে। বাংলাদেশের শিল্প বাঁচলে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা বাঁচবে। বাংলাদেশের শ্রমিকেরা বাঁচলে বাংলাদেশের অর্থনীতি বাঁচবে। শাড়ী বাংলাদেশীদের পোশাক। বাংলাদেশীরা এখন আর শাড়ী পরিধান করেনা। তাই বাংলাদেশের তাঁতশিল্প ধীরে ধীরে মরে গেছে। ভারতের পন্য বাংলাদেশের বাজার দখল করে ফেলেছে। এখন বাংলাদেশী নারী মানেই ছিটের সেলোয়ার কামিজ পরিহিতা মহিলা বা মেয়ে বা বৃদ্ধা । ভারতের মুভি, টিভি সিরিয়াল ভারতের পুঁজিপতিদের তৈরি পন্যের বিজ্ঞাপন দেয়। দর্শকের মগজে এখন সেলোয়ার কামিজ ঢুকে গেছে। আমি প্রায় দশ বছর পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের ঢাকা ও টরেন্টোর হিসাব বিভাগে কাজ করেছি। সেই সুবাদে পাকিস্তান যেতে হয়েছিল বেশ কয়েকবার। দেখেছি পাকিস্তানের মহিলারা সেলোয়ার কামিজ পরিধান করে।
ফেসবুকে দেখি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের তর্কে প্রায়ই “পাকিস্তানে যাও” বলে অনেকেই মন্তব্য করে। পাকিস্তানে যাবার কি দরকার? বাংলাদেশের মহিলারা এখন পাকিস্তানীদের মত পোষাক পরিধান করে। সবাই দেখি সেলোয়ার কামিজ পরিধান করে। বাংলাদেশেই পাকিস্তান আর ভারতের পাঞ্জাব এসে বসে আছে। ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের মহিলারা সেলোয়ার কামিজ পরিধান করে। সেলোয়ার, কামিজ, ওড়না এই সব কাপড়কে যদি জোড়া লাগানো যায় তাহলেই একটা শাড়ীর ৭৫% হয়ে যায়। মাত্র আর ২৫% কাপড় কাচার ভয়ে নিশ্চয় বাংলাদেশীরা শাড়ি বয়কট করেনি। সেলোয়ার কামিজ পরিধান করলে বাংলাদেশীদের বিশ্রী দেখা যায়। বিশেষ করে যাদের পেটে চর্বি আছে। ছিটের সেলোয়ার কামিজ ওরনা পরিধান করে অনেকেই ভাবে তাদের বাচ্চা বাচ্চা দেখা যায়। অনেক কম বয়সী মেয়েকে মনে হয় বৃদ্ধা। এর কারন হলো মনের ভাব চেহারাতে প্রকাশ পায়। নিজেকে কম বয়সী দেখানোর জন্য শরির ও মনের যত্ন নিতে হবে। সেলোয়ার কামিজ এই সমস্যার সমাধান নয়।
সবার আগে মনের যত্ন নিতে হবে। ক্ষমতা ও চাহিদার মধ্য ভারসাম্য আনতে হবে। উদাহরণ – আমি যত আয় করি তার থেকে বেশী ব্যয় করার কথা চিন্তা করিনা। যখনই মানুষ তার আয়ের বেশী ব্যয় করার চিন্তা করবে তখনই সে অপরাধের দিকে ঝুঁকে যাবার ঝুঁকি নেবে। অনেক মেয়েই ভারতের টিভি সিরিয়াল বা মুভির মত করে সাজতে চায়। বাজারে সব কিছুরই দাম বেশী। সব চাইতে দাম বেশী খাদ্যের । থাকা, খাবার খরচা যোগার করতেই অনেকে হিমশিম খেয়ে যায় তখন আর মুভি স্টাইলে সাজ করার ক্ষমতা থাকেনা। তখনই তাদের উপার্জনের উৎসগুলো বদল হয়ে যায়। বাংলাদেশের ক্রেতারা বাংলাদেশের বাজারের মূল্য নির্ধারণ করেনা। বাংলাদেশের বাজারে পন্যের মূল্য নির্ধারণ করে পন্য বিক্রেতারা, ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশের জনগনের যেমন কোন মতামত প্রকাশের অধিকার নেই তেমনি বাংলাদেশের ক্রেতাদের বাংলাদেশের বাজারের পন্যের মূল্য নির্ধারণ করা বা মুল্য নিয়ন্ত্রন করার কোন ক্ষমতা নেই। ভারতীয় মুভি বা টিভি সিরিয়ালে বা ভারতের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের বিজ্ঞাপনের পন্য কেনার জন্য বাংলাদেশের ক্রতারা অস্থির হয়ে যায়। মহিলাদের মধ্য রীতিমত প্রতিযোগিতা লেগে যায়। টাকা কোথা থেকে আসবে সেটা চিন্তা করার দরকার মনে করেনা কেউ। আয় বুঝে ব্যয় করার চিন্তা করার তো প্রশ্নই উঠেনা। অনেকেই তাদের বাবা, ভাই, স্বামী বা ছেলে বন্ধুদের উপরে চাপ সৃষ্টি করে। যখন এইসব উৎসগুলো থাকেনা তখন অনেক মেয়েই দেহ ব্যবসা করে।
ভারতীয় মুভি দেখে ভারতীয় মুভিস্টারদের মত সাজার জন্য টাকার দরকার। ভাত, কাপড়, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার জন্য যদি কেউ চাকুরী না পেয়ে দেহ ব্যবসা করে তাহলে আমি তাকে বেশ্যা বলিনা। বেশ্যা হলো তারা যারা জনগনের মৌলিক অধিকার থেকে জনগনকে বঞ্চিত করে নিজেরা সম্পদের পাহাড়ে বসে আছে। বেশ্যা হলো তারা যারা জনগনকে তাদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্টা করার পথে বাধার সৃষ্টি করছে। যারা ভারতের মুভির স্টাইলে সাজসজ্বা করার জন্য দেহ ব্যবসা করে তারাও বেশ্যা না তারা হলো নির্বোধ। ভারতীয় পুঁজিপতিদের শিকার। বেশ্যা হলো তারা যারা বাংলাদেশের শিল্পকে ধ্বংস করেছে, ভারতের পন্যে বাজার ভর্তি করে ফেলেছে । যারা ভারতের পন্য বিক্রি করে তারাই হলো আসল পতিতা।
বাজারে চাহিদা না থাকলে সেই পন্য কেউ তৈরি করবেনা। সেই পন্য দ্রুত বাজার ত্যাগ করতে বাধ্য হবে। বাংলাদেশে বাংলাদেশের শাড়ীর কোন চাহিদা নাই। সেজন্য বাংলাদেশের তাঁতশিল্প মৃত্যুবরণ করেছে। ভারতের মুভিগুলোতে সবাই সেলোয়ার কামিজ পরিধান করে তাই বাংলাদেশের নারীরা সবাই ছিটের সেলোয়ার কামিজ পরিধান করে । ভারত থেকে আসা ছিটের সেলোয়ার কামিজের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। ক্রেতারা কিনছে। ব্যবসায়ীরা সরবরাহ করছে। মহিলারা সবাই তৃপ্ত। আমার চোখে ওদের কুৎসিত দেখালেও ওরা পরিতৃপ্ত। কামিজ ফেটে বিশাল ভুড়ি ঠেলে বেরুচ্ছে ফেসবুকে গ্রুপ সেলফি দেখে আমার ১৯৭১ সালের হানাদার বাহিনির বউদের কথা মনে পড়ে গেলো – পাঞ্জাব, সিন্ধ, বেলুচিস্তান, থেকে আসা হানাদার বাহিনীর বউগুলাকে এমনই দেখতে লাগত। ওদের কামিজ ঠেলে ওদের ভুড়ি বের হয়ে আসতো।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলের নেত্রী, প্রধানমন্ত্রীর মহিলা মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যারা কেউ সেলোয়ার কামিজ পরিধান করেননা। তাই উনাদের ভুড়ি দৃষ্টিগোচর হয়না। উনাদের ভালবেসে বাংলাদেশের নারীদের উচিৎ সেলোয়ার কামিজ পরিধান করা থেকে বিরত থাকা ও শাড়ী পরিধানের প্রচলণ পুনরায় চালু করা। গান্ধীজী ইংরেজদের পন্য জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। জ্বালাও, পোড়াও যদিও হিংস্র কর্মকান্ড তবুও তিনি চড়কাতে বসে সুতা কাটতেন নেঙটি পরিধান করে। বাংলাদেশীরা ভারতের তৈরি সেলোয়ার কামিজ জ্বালিয়ে দিয়ে বাংলাদেশে তৈরি শাড়ী পরিধান করা চালু করতে পারে।
আয় বুঝে ব্যয় করুন। শাড়িতে আপনাকে সুন্দর লাগবে। একজন বাংলাদেশী হিসাবে বাংলাদেশে তৈরি শাড়ী পড়ুন। বাংলাদেশের তাঁতশিল্পকে হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে আনুন। দেশের পন্য ব্যবহার করে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করুন । বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার দায়িত্ব বাংলাদেশের জনগনের। বাংলাদেশের শাড়িকে যার যার শরীরে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব বাংলাদেশের নারীদের।
আপনার স্বামী যদি আপানাকে ভারতের মুভিস্টার হিসাবে দেখতে চায় তাহলে উনাকে বলুন ভারতের মুভিকে বিয়া করতে।
Zahidul Islam Shahin liked this on Facebook.