প্রবাসের গল্প ৭

কিছু মানুষের ভেতরে অন্যকে নিয়ন্ত্রন করার প্রবণতা আছে। যেমন তারা চায় অন্যেরা তাদের কথা মত চলুক। তাদের কথা মতো কথা বলুক। তাদের কথা মত পোষাক পরিধান করুক। ওরা মনে করে ওরা যেটা করছে সেটাই ঠিক এবং এই ঠিক কাজটি সবার করা উচিৎ ।

সেদিন আমার বান্ধবী আমাকে বাংলাদেশী পিকনিকে দাওয়াত দিয়েছিল। অনুরোধ করেছিল আমি যেন সেলোয়ার কামিজ পরিধান করে পিকনিকে যায়। সেদিন আমার আর এক বান্ধবীর মেয়ে বলেছে – আন্টি আপনি কেনো ব্যায়াম করেন? এত বুড়া বয়সে আপনি কেনো এত রং ঢং করেন? সেই বান্ধবী আমাকে একটা ঢিলা ঢালা পাজামা কামিজ উপহার দিয়েছে যাতে আমি তার মত পোষাক পড়ে তাদের বাসাতে যায়।

বাংলাদেশে আমি শাড়ী পরিধান করতাম। জীবনে আমি একটাই সেলোয়ার কামিজ কিনেছিলাম। কানাডাতে আসার পরে আমি কোন দিন গাড়ি কিনিনি। পাবলিক বাসে চলাফেরা করি। কানাডাতে প্রায় সাত আট মাস খুব শীত থাকে। শীতের জন্য শীতের পোষাক পড়তে হয়। কানাডার অফিসে সেলোয়ার কামিজ বা শাড়ী পরিধান করে যাওয়া যায়না। কানাডাতে আমি বাংলাদেশী কমিউনিটির সাথে মিশিনা। না মেশার কারণ অনেক। এত প্রচন্ড শীতে শাড়ী পড়ে দৌড়ে বাস ধরতে গেলে রাস্তায় পড়ে মারা যেতে পারি সেজন্য শাড়ী পরিধান করার চেস্টাও করিনি কোন দিন। শাড়ী কানাডার পোষাক নয়। সেলোয়ার কামিজ বাংলাদেশের পোষাক নয়। এখন আমার ফেসবুকের প্রফাইল ফটো একটা কুড়াল । আমার বন্ধু বলেছে এই কুড়ালের ছবি নামিয়ে ফেলতে। একবার আমার এক বন্ধু বাংলাদেশ থেকে কানাডাতে আসে ইমিগ্রেশন নিয়ে তখন আমি তাদের বাসাতে যায়। ওরা দুইজন ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু কানাডাতে এসে ফ্যাক্টরীতে কাজ করতো পরে লেখাপড়া আরো করে ভাল কাজ করছে এখন। আমার বন্ধুর বউ একবার তার মেহমানদের জন্য আমাকে রান্না করতে সাহায্য করতে বলেছিল তারপর বলেছিল – লিলু আপা, মেহমানরা যখন আসবে তখন আপনি এসেন না।

এই কারনেই আমি কানাডার বাংলাদেশীদের সাথে মিশিনা। শাড়ী বা সেলোয়ার কামিজ পড়ার দরকার হয়না আমার। তিন বছর আগে একজন বাংলাদেশী প্রতারকের সাথে বিয়ে করে নিজের খরচায় কিছু শাড়ী কিনেছিলাম। প্রতারকের সাথে ছিলাম মাত্র বিশ দিন তাই এইসব শাড়ী আর পড়া হয়নি।

এখন আমার ফেসবুকের প্রফাইল ফটো একটা কুড়াল । আমার বন্ধু বলেছে এই কুড়ালের ছবি নামিয়ে ফেলতে।

বাংলাদেশীরা দেখি মাঝে মাঝেই গনতন্ত্র পাইবার জন্য সংগ্রাম করে। ওরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা চায়। বাংলাদেশে বা কানাডাতে আমি কোনদিন উলঙ্গ হয়ে হাটিনি । যদি হাটতাম তাহলে এই দুই দেশেই আমাকে গ্রেফতার করা হতো বা পত্রিকাতে ছবি প্রকাশ করা হতো। আমি সব সময় শালিনতা বজায় রেখে পোষাক পরিধান করি। আমি বিশ্বাস করি শুধু চুল ঢাকলেই মুসলমান হওয়া যায়না। মুখ আর শরীর দেখিয়ে শুধু চুল ঢেকে রাখলেই মুসলমান হওয়া যায়না। ইসলাম চুলে নয় ইসলাম থাকে অন্তরে। ইসলাম পালন করার জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সাথে ফরজ কাজের মধ্য অন্যতম হলো অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। মানসিকভাবে বা শারীরিকভাবে অন্যকে আঘাত না করা। নিজে শান্তিতে থাকো ও অন্যকে শান্তিতে থাকতে দাও। এই জগৎসহ জগতের সকল প্রানী আল্লাহ্‌র সৃষ্টি। যখন আমরা প্রকৃতিকে আঘাত করি তখন প্রকৃতি ভারসাম্য হারিয়ে ফ্যালে। ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রকৃতিতে বসবাসরত সকল প্রানীই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। একইভাবে আমরা যদি আল্লাহ্‌র সৃষ্টি মানুষকে শারীরিকভাবে বা মানসিকভাবে আঘাত করি তাহলেও আল্লাহ্‌র সৃষ্টিকে আঘাত করলাম ফলে যখন আমরা নামাযে দাঁড়িয়ে আল্লাহ্‌কে বলি “আলহামদুলিল্লাহ” তখন সেটা হয়ে যায় হিপোক্রেসী।

আলহামদুলিল্লাহে রাব্বুল আলামীন –
আর রাহমানুর রাহীম
মালেকী ইয়াউমিদ্দিন

আল্লাহ্‌র সৃষ্টিকে সন্মান করিনি, শান্তিতে থাকতে দিইনি তাহলে নামাযে দাঁড়িয়ে আল্লাহ্‌র সামনে আল্লাহ্‌র প্রসংশা করছি কেনো??

আমি আমার জীবন যাপন করি। আমি কারুকে বলিনি প্যান্ট শার্ট পরে বসে থাকো । যা করলে তুমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করো সেটাই করো। জীবনের সময় অল্প । যতদিন বাঁচো। সুখে বাঁচো। ভাল থাকো। যা করলে ভাল থাকতে পারো সেটা করো। তোমার গাড়ি আছে , আলমারী ভর্তি সেলোয়ার কামিজ শাড়ী আছে, তুমি যা খুশী তাই পড়ো দেখে আমাকেও যে তোমার মত হতে হবে এমন কোন কথা নেই। আমি আমার জীবন নিয়ে বাঁচি । তুমি তোমার জীবন নিয়ে বাঁচো। তুমি যদি আমার জীবনে এসে আমার জীবন নিয়া বাচতা তাহলে বুঝতে জীবন কাকে বলে। দূর থেকে মানুষ মানুষকে বিচার করে অযথা। রোলার কোস্টারে চেপেই আমি সহজে হাসিখুশি জীবন যাপন করি। অনেক বাধাঁ আর বিপত্তি অতিক্রম করেও মনোবল হারাইনা কারণ আমি যদি ভেঙ্গে পড়ি তাহলে আমাকে টেনে তোলার জন্য কেউ আসবেনা। তবে আমাকে ভেঙ্গে ফেলার জন্য সবাই চেস্টা করবে।

বাংলাদেশের মাবাবারা বুড়া হবার সাথে সাথে তাদের জীবনের আর কোন মূল্য থাকেনা। অনেকেই মনে করে বেঁচে থাকার অধিকার শুধু যৌবনে আর যৌবন পেরুলেই মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা তাই শরীরকে পচিয়ে ফেলতে হবে অযত্ন করে। নানি দাদি হইছো সেজন্য তোমার ব্লাড প্রেসার উচ্চ থাকবে –সেটাই কাম্য। তোমার শরীরের বিভিন্ন জাগাতে চামড়া ঝুলে যাবে – সেটাই কাম্য। তোমার ডায়াবেটিস হবে, ক্যানসার হবে নাহলে আর তুমি আদর্শ বাংলাদেশী মা বাবা হইতে পারলা না। ব্যায়াম করে রং ঢং করে সেজেগুজে তুমি কেনো থাকবে? তুমি তো বুড়া। রং ঢং সাজুগুজু সবই যুবক যুবতীর জন্য রিজার্ভ। প্রতিটি মাবার উচিত ৫০ বছর বয়স হইলেই আত্মহত্যা করা যাতে ছেলেমেয়েরা শোক করতে পারে। ধুমধাম করে চল্লিশা খাইতে পারে।

কানাডাতে আমার পরিচিত সব বাংলাদেশীরাই অন্যকে দেখতে চায় নিজের মত করে। নিজের চেহারা যদি কুৎসিত হয় তাহলে অন্যকে কুৎসিত দেখতে চায়। নিজে যদি বিশালদেহী হয় তাহলে অন্যকে বিশাল দেহী দেখতে চায়। নিজে যদি ভারতের মুভির মত বা বিহারীদের মত সেলোয়ার কামিজ পরিধান করে তাহলে অন্যকেও দেখতে চায় সেলোয়ার কামিজ পড়ে নিজের মতই নাদুস নুদুস হয়ে ঘুড়ুক । নিজের যদি উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকে বা ডায়াবেটিস থাকে তাহলে নিজে ব্যায়াম করে তা নিয়ন্ত্রনে না এনে অন্যকে চায় তারাও ব্যায়াম ছেড়ে দিয়ে ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপে ভুগুক।

চাইবার শেষ নাই। সব কামনা বাসনায় নিজেকে ঘিরে । সবাই অন্যকে নিজের মত দেখতে চায়। প্রতিটি মানুষই ভিন্ন । প্রতিটি মানুষ তার নিজের বেঁচে থাকার দরকা্রে পোষাক পরিধান করে। খাবার খায়। শিশুযুবকবৃদ্ধ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের উচিৎ আল্লাহ্‌র দেওয়া জীবনের যত্ন নেওয়া। আল্লাহ্‌র সৃষ্টির যত্ন নেওয়া অর্থ আল্লাহ্‌র ইবাদৎ করা। যারা সৃষ্টিকে ধবংস করে অযত্ন করে তারা আল্লাহর সৃষ্টিকে ধবংস করে নিজেদের অজানিতে। অন্যকেও ধ্বংস হতে দেখতে চায়। প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিত্ব ভিন্ন। আল্লাহ্‌র দান। অনেক ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্ব এক আকাশের নীচে একটি পৃথিবীতে যখন বেঁচে আছে তখন সবার ব্যক্তিত্বকে উপভোগ করা উচিৎ, শ্রদ্ধা করা উচিৎ, নিয়ন্ত্রন করার চেস্টা না করে, ধ্বংস করার চেস্টা না করে, অসন্মান করার চেস্টা না করে।

ছোট্ট জীবনে নিজে বাঁচুন অন্যকে বাঁচতে দিন। যতদিন আল্লাহ্‌র দেওয়া হায়াত আছে ততদিন আল্লাহ্‌র দেওয়া হায়াতকে আল্লাহ্‌র আমানত ভেবে যত্ন করুন। যখন সময় হবে তখন আপনি না চাইলেও চলে যেতে হবে।

আমি আমার নিজের পছন্দ অপছন্দকে গুরুত্ব দেই। অন্যের সাজগোজ উপভোগ করি। অন্যের ব্যক্তিত্বকে বুঝার চেস্টা করি। আঘাত না পেলে প্রতিঘাত করিনা।

One thought on “প্রবাসের গল্প ৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *