মরুর বুকে দারিদ্র্য জয়

একে একে সাফল্যের সিঁড়ি ডিঙানো। শূন্য হাতে শুরু। ছিলেন বর্গাচাষি—‘নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা’। অন্যের জমিতে চাষ করে যা আয় হতো তা দিয়ে চলত কোনো রকমে। লেখাপড়াও বেশি দূর এগোয়নি। এখন বছরে আয় কোটির ঘরে।
এই গল্প চট্টগ্রামের পটিয়ার চার ভাই—কামাল উদ্দিন, এনাম উদ্দিন, মো. সাইফুদ্দিন ও নাজিম উদ্দিনের। ভাগ্য ফেরাতে বড় ভাই কামাল গিয়েছিলেন মরুর দেশ ওমানে। তখন লক্ষ্য ছিল সংসারে সচ্ছলতা আনা। ধীরে ধীরে ডালপালা মেলেছে স্বপ্ন। ‘বিন্দু’ থেকে গড়েছেন ‘সিন্দু’।
এখন অন্যের ভাগ্যের চাকা ঘোরাচ্ছেন তাঁরা। ওমানেই নিজেদের হাতে গড়ে তুলেছেন ১০টি সবজির বাগান। প্রতিষ্ঠানের নাম ‘এনাম ভেজিটেবল অ্যান্ড ফ্রুট’। যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে ২০০ বাংলাদেশি শ্রমিকের। ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ওমান থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ব্যবসা ছড়িয়ে দিয়েছেন চার ভাই। এক যুগের চেষ্টায় মরুর বুকে রচিত হয়েছে তাঁদের সাফল্যগাথা। আজ তাঁদের মুখে দারিদ্র্য জয়ের হাসি। নিজেদের বাগানে চাকরি দিয়ে সেই হাসি ছড়িয়ে দিয়েছেন স্বজন ও প্রতিবেশীদের মধ্যেও। সম্প্রতি নাজিম ও এনাম দেশে এলে পটিয়ায় হাইদগাঁও ইউনিয়নের গ্রামের বাড়িতে বসে শোনান তাঁদের সাফল্যের কাহিনি।
শুরুর কথা: সময়টা ১৯৯০ সাল। নিজের বোনের বিয়ের জন্য ভিটাটুকু বিক্রি করে দেন কামালদের বাবা সুরত আলী। এরপর কষ্টেসৃষ্টে পাড়ি জমান মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমান। সেখানে বছর সাতেক থেকেও কিছু করতে পারলেন না। ১৯৯৭ সালের দিকে দেশে ফেরেন খালি হাতে। স্ত্রী, চার ছেলে ও এক মেয়ের সংসার নিয়ে পড়লেন অথই সাগরে। তখন কামালের বয়স ১৫, এনামের ১২, সাইফুদ্দিনের ৯ ও নাজিমের ৭ বছর। সংসারে টানাটানি দেখে কামাল ভাইদের নিয়ে অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ শুরু করলেন।
সেই দিনগুলো এখনো জ্বলজ্বল করে এনামের স্মৃতিতে। বললেন, ‘আমরা চার ভাই খুবই কর্মঠ ছিলাম। তখন বড়ভাই ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়েন। আমরা কোনোভাবে একটি জমি বর্গা নিয়ে লেগে গেলাম চাষে। আদা, ক্ষীরা, ধান, ঝিঙে যখন যা হয় তা ফলাতে লাগলাম। খুব শখ করে আমরা এগুলো করতাম। সবজি বিক্রি থেকে আয় দিয়ে সংসারে একটু গতি এল। আমাদের উৎসাহ বেড়ে গেল।’ এরপর থেকে শুধুই এগোনোর গল্প।
২০০২ সালে মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী মামা নূর আলমের মাধ্যমে কামাল উদ্দিন ওমানে পাড়ি জমান। তাঁর ভিসার ৫০ হাজার টাকার জোগানও এসেছে চাষের আয় থেকে। সেখানে মামার বাগানে কাজ পান কামাল। এরপর ২০০৪ সালে এনামও গিয়ে মামার বাগানে কাজে লাগেন। এনামের ভিসার ৩০ হাজার টাকাও দেওয়া হয় সবজি চাষের আয় থেকে।
২০০৫ সালে দুই সহোদর মিলে মরুর বুকে আল কাফুরা নামের এলাকায় আরবাবের (স্থানীয় জমির মালিক) অধীনে গড়ে তোলেন নিজেদের বাগান।
দিনবদল: দেশে থাকা অপর দুই ভাইয়েরও ওমানে যেতে সময় লাগল না। ২০০৫ সালে সাইফুদ্দিন এবং ২০০৭ সালে নাজিম উদ্দিনও পাড়ি জমালেন ওমানে। এর পর চার ভাই মিলে নেমে পড়েলন কঠিন সংগ্রামে। এর ফলও পেলেন হাতে হাতে। পাল্টাতে লাগল তাঁদের জীবনচিত্র। বাড়তে লাগল বাগানের সংখ্যা।
এনাম বলেন, ‘আমি যাওয়ার পর দুজনে একটি বাগান নিয়ে চাষ শুরু করলাম। এর পরের বছর ২০০৬ সালে আরও একটি নিলাম। ২০০৭ সালে নিলাম দুটি। এভাবে বছর বছর বাড়তে লাগল বাগানের সংখ্যা। এখন ওমানের আলবিধিয়া, আলকাফুরা, আলকাদারা ও আলহাদারা এলাকায় মোট ১০টি বাগান রয়েছে।’
সর্বশেষ বাগানটি কেনা হয়েছে ২০১৩ সালে আলহাদারা এলাকায়। এটি হচ্ছে তাঁদের সবচেয়ে বড় বাগান। এর আয়তন ৪৬ একর। দিন দিন বাড়তে থাকে তাঁদের কর্মপরিধি।
এদিকে ২০১১ সালে ওমান থেকে দুই ভাই চলে গেলেন দুবাইয়ে। সেখানেই গড়ে তোলেন এনাম ভেজিটেবল অ্যান্ড ফ্রুট। ওমান থেকে সবজি নিয়ে সেখানে বিক্রি শুরু করেন। ওমানে আরবাবের অধীনে সব করতে হয়। কিন্তু দুবাইয়ে নিজেরা স্বতন্ত্রভাবে ব্যবসা করতে পারেন।
দেশি সবজি বিদেশে: ঢ্যঁাড়স, লাউ, করলা, শিম, মিষ্টি কুমড়া, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ক্যাপসিকাম, মরিচ, চালকুমড়া, বেগুন ইত্যাদি নানা জাতের সবজি চাষ করেন তাঁরা। প্রতিদিন ১৬ টন সবজি উৎপাদিত হয় ১০টি বাগানে, যা বিক্রি হয় বাংলাদেশি প্রায় ১০ লাখ টাকায়।
শিমের বীজ নিয়ে যাওয়া হয় সীতাকুণ্ড থেকে। নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের সীতাকুণ্ডের শিম খুব বিখ্যাত। এখানকার বীজ নিয়ে আমরা সেখানে শিম ফলাই। এ ছাড়া আরও কিছু সবজির বীজ এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের দেশীয় সবজির কদর খুব বেশি।’
বাগান থেকে সবজি তুলে কার্টন ভর্তি করে গাড়ি করে পৌঁছে দেওয়া হয় বিভিন্ন বিক্রেতার কাছে। এ ছাড়া সবজিভর্তি কার্টন চলে যায় সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন জায়গায়। নাজিম বলেন, ‘সবজি বাগান থেকে তুলেই কার্টনে ভর্তি করা হয়। কোনো রকম কেমিক্যাল এমনকি পানিও দেওয়া হয় না। অথচ এখানে (বাংলাদেশে) নাকি ফরমালিন দেওয়া হয়।’
২০০ বাংলাদেশি শ্রমিক: এনামদের ১০টি বাগানে কাজ করেন ২০০ বাংলাদেশি শ্রমিক। এর মধ্যে ১৫০ জন স্থায়ী। এর বাইরে কোনো কোনো সময় আরও শ খানেক অস্থায়ী শ্রমিককে কাজে লাগানো হয়। এঁদের বেশির ভাগই বাংলাদেশি।
নিজেদের আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের ২০০৫ সাল থেকে নিয়ে যাওয়া শুরু করেন তাঁরা। নিজেদের একমাত্র বোনের বর আলাউদ্দিন, খালাতো ভাই দেলোয়ার, প্রতিবেশী উত্তম দাশও এখন কামাল এনামদের কল্যাণে প্রবাসী। এঁদের কেউ কেউ আবার এখন নিজেরাই ব্যবসা শুরু করেছেন সেখানে।
নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘আত্মীয়স্বজন একজনকেও দেশে রাখিনি। প্রতি ঘর থেকে এক–দুজনকে নিয়ে গেছি। অনেকে এখন নিজেরাই ব্যবসা শুরু করেছেন। স্বজন–প্রতিবেশীদের সুখ দেখে আমাদেরও ভালো লাগে।’
প্রতিবেশী হাইদগাঁও এলাকার উত্তম দাশকে নিয়ে ওমান নিয়ে যান ২০০৬ সালে। অনেক দিন কামালদের বাগানে থাকার পর এখন উত্তম নিজেই একটি বাগানের মালিক। মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুঠোফোনে উত্তম বলেন, ‘কামালদের ১০টি বাগান রয়েছে। আমি অনেক দিন কাজ করেছি। এরপর তাদের সহায়তায় আমি নিজেও একটি বাগানের মালিক হয়েছি।’
একইভাবে কামালদের খালাতো ভাই দেলোয়ার হোসেনও তাঁদের সহযোগিতায় দারিদ্র্য জয় করেছেন। পটিয়ার কেলি শহরের এই ব্যক্তি ২০০৯ সালে ওমান যান। তখন তাঁকে একটি বাগানের তত্ত্বাবধায়কের কাজ দেওয়া হয়। দেলোয়ার বলেন, ‘খালাতো ভাইদের সহযোগিতা না পেলে কখনো বিদেশ যাওয়া হতো না। এখন আমার পরিবার স্বাবলম্বী। ভবিষ্যতে এনামদের মতো বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখি এখন।’
কুঁড়েঘর থেকে প্রাসাদে: একসময় ছোট ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে হতো তাঁদের। বিদেশ যাওয়ার পর পটিয়ার হাইদগাঁওতে দেড় একর জমির ওপর একতলা একটি পাকা বাড়ি করেন চার ভাই। এরপর গত দুই বছরে পটিয়া সদরে আরও দুটি বহুতল বাড়ি কেনেন তাঁরা। এখন সপরিবারে থাকা দ্বিতল বাড়িটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘সুরত আলী ভিলা’। ওখানেই সপরিবারে থাকেন তাঁরা। এনাম, নাজিমদের স্বপ্ন আরও বড় হওয়া। নাজিম বলেন, ‘আমরা সবজি নিয়েই থাকতে চাই। আমাদের সবজি নিয়ে যেতে চাই কাতার, কানাডা, ইউরোপ এমনকি আমেরিকায়ও।’

৩ thoughts on “মরুর বুকে দারিদ্র্য জয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *