চাপের মুখে প্রথম আলো- ডেইলি স্টার, বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার হচ্ছে

বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলো এবং ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার চাপের মুখে পড়েছে বলে দাবি করেছে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আজকাল।
আজকাল জানিয়েছে, গত চারদিন ধরে বহুজাতিক ও দেশীয় প্রতিষ্ঠানে থেকে ফোন করে বলা হচ্ছে এখন থেকে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে তাদের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হবে না।
বহুজাতিক ও দেশিয় এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে টেলিফোন কোম্পানি, বেসরকারি ব্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয়, রিয়েল এস্টেট ও প্রসাধনী কোম্পানি।
গত বুধবার একদিনেই প্রথম আলো থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে ৯৬ লক্ষ টাকার বিজ্ঞাপন।
প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেছেন, ‘আমরা চারদিন ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ফোন পাচ্ছি। তারা আমাদেরকে যেসব বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য দিয়েছিল সেগুলো প্রত্যাহার করে নিয়েছে।’
এ ঘটনার কারণ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা শুনেছি মহল বিশেষের চাপে বহুজাতিক ও দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার থেকে বিজ্ঞাপন তুলে নিচ্ছে।’
সাম্প্রতিক দুটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারকে নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়।
এর মধ্যে গত ১৫ আগস্ট ভোরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলিতে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) পাঁচজন সদস্য নিহত হলে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার নিহতদের ‘আদিবাসী’ যুবক হিসেবে বর্ণনা করে।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের সংখ্যাগুরু বাঙালিদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
পরে ১৭ আগস্ট প্রথম আলো এক ব্যাখ্যায় জানায়, “প্রথম আলোতে প্রকাশিত রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলিতে পাঁচ সন্ত্রাসী নিহত হওয়ার খবরের শিরোনাম নিয়ে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। নিহত পাঁচ ব্যক্তি যে সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্য, তা প্রতিবেদনে একাধিকবার এবং হাইলাইটসে বা বড় হরফে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে।
শিরোনামে এবং প্রতিবেদনের শুরুতে ‘আদিবাসী’ লেখার অর্থ এই নয় যে, তারা নিরীহ যুবক। আমরা গতকালও খোঁজ নিয়ে জেনেছি, নিহতরা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য। উল্লেখ্য, সংবিধানে পার্বত্য এলাকার জনগোষ্ঠীকে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।”
এর আগে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার নতুন করে আলোচনায় আসে সংবিধান সংশোধন নিয়ে সুশীল সমাজের নতুন তৎপরতাকে কেন্দ্র করে।
গত ১১ আগস্ট ব্র্যাক ইন সেন্টারে ‘উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ’ আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা সংবিধান সংশোধনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ‘উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ’ নামের এই সংগঠনটির ১৩ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। যার আহ্বায়ক করা হয়, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদাকে।
দীর্ঘদিন চুপ থাকার পর হঠাৎ করে গোলটেবিল বৈঠকের মাধ্যমে ফের আলোচনায় আসে এ সংগঠনটি।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্যারিস্টার মঞ্জুর আহসান। তিনি সংবিধানের বেশ কিছু ধারার সংশোধনের প্রস্তাব তুলে ধরেন। যার মধ্যে ছিল- একই ব্যাক্তির বহুবিধ ভূমিকা, রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন আয়োজন করা ও ক্ষমতা বাড়ানো, বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সংসদ সদস্যদের ফ্লোর ক্রসিং করতে দেয়া। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করার উপরও গুরুত্বারোপ করা হয়।
আলোচনাকালে প্রথম আলোর যুগ্ম-সম্পাদক মিজানুর রহমান খান বলেন, ‘দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীর শাসনের নামে কার্যত রাষ্ট্রপতির শাসন চলছে। মানুষ যেহেতু মরণশীল। আশা করি, অনেক জটিল সমস্যা আমাদের মৃত্যুর পর আপনা-আপনি শেষ হয়ে যাবে।’
জানা গেছে, “অনেক জটিল সমস্যা আমাদের মৃত্যুর পর আপনা-আপনি শেষ হয়ে যাবে” কথাটি রাজনৈতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বিরোধকে কেন্দ্র করে পল্টন হত্যাযজ্ঞের ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন সামরিক নেতৃত্বের সমর্থনে ক্ষমতা দখল করে সুশীল সমাজ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দিন্নের নেতৃত্বে জরুরি সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে এর কৃতিত্ব দাবি করে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার। দুই পত্রিকার প্রতিবেদনে যে সকল রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন অপরাধের জন্য অভিযুক্ত বলা হয়েছে তাদেরই গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করারও তত্ত্ব দেয়। এক পর্যায়ে ২০০৭ সালের শেষার্ধে দুই নেত্রী গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় বছরব্যাপী বন্দি ছিলেন।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোটের পক্ষে অবস্থান নিলে তারাই বিজয়ী হন এবং অকল্পনীয় পরাজয় বরণ করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট।
পরের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির বিডিআর বিদ্রোহ থেকে শুরু প্রায় সকল রাজনৈতিক ও সাধারণ ইস্যুতে সরকারকে সমর্থন দেয় এ দুটি দৈনিক।
যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়সহ সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ দুটি পত্রিকার ভূমিকা নিয়ে বারবার প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
এরই মধ্যে বিরোধী দলীয় গণমাধ্যম চ্যানেল ওয়ান, আমার দেশ, দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি সরকারি নির্দেশে বন্ধ হয়ে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় দুই হাজার সংবাদকর্মী বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান প্রায় তিন বছর ধরে কারাগারে বন্দি আছেন। সম্প্রতি তাকে তিন বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, দার্শনিক ও কৌশলগতভাবে সরকারপন্থী হওয়া সত্ত্বেও প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার চাপের মুখে পড়ায় সরকাদলীয় সংবাদকর্মীরাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

২ thoughts on “চাপের মুখে প্রথম আলো- ডেইলি স্টার, বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার হচ্ছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *