যেভাবে অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে ফিরে আসলেন ছাত্রদল নেতা গুম আনিস

মাহমুদা ডলি : চোখের সামনে থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। কখনো সাদা পোষাকে, আবার কখনো পুলিশের ইউনিফর্মের মানুষেরা। যেই নিয়ে যাক না কেন তাদের হাতে পুলিশের হাতকড়া পড়িয়েই নেয়া হয়েছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলাবাহিনী অস্বীকার করে যাচ্ছে।

অপরদিকে মিসিং ডায়রীও নিতে অপরাগতা প্রকাশ করছেন তারা। এমনকি কে বা কারা এই গুমের সঙ্গে জড়িত তা দেখার দায়িত্বও যেন নেই রাষ্ট্রের। সারা দেশের ৩ শতাধিক নেতা গুম হলো। তাদের মধ্যে হাতে গোনা ২/৪জন ফিরে এসেছে। অন্যদের কোন হদিস মেলেনি এখনো পর্যন্ত। যারা ফিরে এসেছেন তাদের মধ্যে ৩ জনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে।

জানালেন কিভাবে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ক্ষমতা বিস্তারের ব্লুপ্রিন্টের শিকার তারা। কিভাবে অন্ধকার প্রকৌষ্ঠ থেকে ফিরে এলেন তারা! পৃথিবীর আলো-বাতাস শূন্য শত্রু নিধনের গোপন সেলে ১২দিনের মর্মান্তিক বর্ননা দিলেন ছাত্রদল নেতা মো. আনিসুর রহমান ( গুম আনিস)।

ছাত্রদল নেতা আনিসুর রহমান। নিখোঁজ হওয়ার পরে অজ্ঞাতস্থান থেকে ফিরে আসা বিরোধী নেতা-কর্মীদের মধ্যে একজন। নিখোঁজের পর তার ১২ টি দিন কেটে যায় অজ্ঞাতস্থানে। পরে তাকে ফেরত দেয়া হয়। আনিস জানান, এই ১২ টি দিন তার কেটেছে শুধুই আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে। সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা মনে উঠলে এখনো আঁতকে ওঠেন তিনি। তার সঙ্গে আরো চার নেতা নিখোঁজ হয়েছিলেন। যাদের মধ্যে দু’জনের হদিস মেলেনি আজো।

২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর। তখনো ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধ। কারাগারে আটক সূত্রাপুর থানা ছাত্রদল নেতা সঞ্জয়কে দেখতে গিয়েছিলেন আনিস, বিপ্লব, রুবেল, সোহেল, সম্রাট এবং মিঠু। কারাগারের টিকেট কাউন্টারের সামনেই ৪-৫ জনের একটি দল এসেই একে একে সবার নাম, পরিচয় জানতে চাইলেন। সম্রাটের (সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক) নাম বলার পরই তাদের ৫ জনকেই একটি সিলভার কালারের মাইক্রোতে উঠিয়েই কালো কাপড় দিয়ে চোখ ঢেকে দেওয়া হয়। রুবেল নামাজে যাওয়ায় সে বেঁচে যায়। এরপর দুহাত পিছনে নিয়ে হ্যান্ডকাপ পরানো হলো। এরপর শুরু হয় একের পর এক কিল, ঘুষি। তবে অন্যদের চেয়ে বেশি মারা হয় সম্রাটকে। গাড়িতে তুলেই সম্রাটকে নাক-মুখ বরাবর মারা হয়। গাড়িতেই রক্তাক্ত হয় সম্রাট।

যখন তাদেরকে হ্যান্ডকাপ পরানো হয় তখন তারা ধরে নেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই তাদেরকে আটক করেছে। প্রায় ঘন্টাখানেক মাইক্রো চলার পর একটা জায়গায় গিয়ে গাড়ি থামিয়ে তাদেরকে একটি রুমের ফ্লোরে বসানো হয়। চোখ বাঁধা থাকায় তারা বুঝতে পারেননি এটা কোথায়। এরপর একজন করে অন্য একটি রুমে নেয়া হয়। সেখান থেকে চিৎকারের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিলো। সে আওয়াজ ছিলো গগণবিদারী।

তিনজনের পর আনিসের পালা। আনিস জানান, অন্য রুমে নিয়ে একটি চেয়ারে বসিয়ে দেয়া হল। এরপর নাম, এলাকা এবং ছাত্রদলের অন্যান্য নেতাদের সম্পর্কে জানতে চাইলো। জানতে চাইলো দলের অবস্থা, শীর্ষ নেতাদের কে কোথায় আছে। সঙ্গে বেদম প্রহার তো রয়েছেই। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার সম্পর্কে জানতে চাইলো। কিন্তু তার বাসার ঠিকানা আনিস নিজেই জানতো না। আনিসের সঙ্গে থাকা কাগজপত্র দেখে সেখান থেকে অন্য একটা রুমে। আনিস বুঝতে পারলো ওখানে আর কেউ নেই। আনিস বললো, তখন আমার আশঙ্ক হয় আমাদেরকে গুম করার জন্য নেয়া হয়েছে।
ওই রুমে আনিসকে একটি ছোট পাত্র দেয়া হয় প্রস্রাব করার জন্য। এরপর হ্যান্ডকাপ পিছন দিক থেকে সামনের দিকে নিয়ে আসা হয়। তখনো চোখ বাঁধা ছিল। প্রায় ২-৩ ঘন্টা পর একজন এসে আবার অন্য একটি রুমে নিয়ে গিয়ে বেসিনে হাত ধুয়ে দিল। এরপর ফ্লোরে বসিয়ে খাবার দেওয়া হয়। কিছু ডাল দিয়ে মাখানো ভাত। খেতে না চাওয়ায় লাঠি দিয়ে পেটালো আনিসকে।

আনিস বললো, তখন মনে হচ্ছিলো আর বেঁচে থাকতে পারবো না। দিন-রাত বোঝা যেত না। একসময় ঠান্ডা লাগলে ধরে নিতো এটা রাতের শেষভাগ। দুই-তিন দিন এভাবেই চললো। অন্যদের কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যেত না। মনের মাঝে সবসময় একটা আতঙ্ক বিরাজ করতো। তখন মনে হতো আর হয়ত কখনো জীবিত ফিরে যেতে পারবো না পরিবারের কাছে। মনে হয় দুজন লোক আসতো একজনের কাছে খাবার থাকতো। অন্য জনের কাছে থাকতো চাবি। যখন কেউ আসতো তখন তাকে বলতাম আমার পরিবারের কাছে একটু খবর দিন যে আমি বেঁচে আছি। যেভাবে পারতাম তাদের কাছে অনুরোধ করতাম। আর দিনরাত আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করতাম।

চারদিন পরে বিপ্লবের ডাক শুনতে পেলাম। বিপ্লব আনিস ভাই আনিস ভাই বলে ডাক দিল। মনে হল আমার সামনের কোন রুমেই হয়ত সে আছে। তখন অন্যান্য সেল থেকে সম্রাট , মিঠুরাও আওয়াজ দিল। তখন স্পষ্ট হলো যে সত্যিই মার খেয়ে সম্রাট একদিন অজ্ঞান ছিল।

কান্না-কাটি করলে বেদম মারতো। কেন মারছেন জানতে চাইলে বলতো মারবো না কি করবো? তখন তাদেরকে আশ্বাস দিত তোদের মেরে ফেলবো না, ছেড়ে দিবো। তোদের মারলে এভাবে রাখা হতো না। দিনে দুবার এভাবে খাবার দেওয়া হতো। না খেতে চাইলে লাঠি দিয়ে আঘাত করা হতো।

একদিন একজন এসে জিজ্ঞেস করলো কোথা থেকে ধরে নিয়ে আসলো। সব কিছু বলার পর আশ্বাস দিলো ছেড়ে দিবে। বলতো তোরে কথা দিচ্ছি তোকে ছেড়ে দিবো। ৭-৮ দিন পর বুঝতে পারলাম আমরা সবাই কাছাকাছি আছি। এতো দিনে কখনো ঘুমাতে পারিনি। কারণ হাত এবং চোখ বাঁধা ছিল।

হঠাৎ ১১তম দিনে একজন এসে বললো মনে কর তোরা মালয়েশিয়া আসছো। তোদের বিমান বাংলাদেশ থেকে আসতেছে। তোরা প্রস্তুত হ। তখন মনে মনে খুশি হলেও ভয়ও পেয়েছি। ভাবতাম এখান থেকে মুক্তি পাবো, নাকি পৃথিবী থেকে।
১২ তম দিন সকালে কেন যেন মনে হচ্ছিলো আজ হয়ত মুক্তি পাবো। ওদের কথায় বিশ্বাস ছিলো যেকোন সময় মুক্তি পাবো। কিন্তু কেউ কোন খোঁজ খবর না নিতে আসায় মনে হলো না আর হয়তো ছাড়া পাবো না।

এরপর রাত সম্ভবত ১১ টার দিকে হবে একজন এসে বললো তোদের বিমান আইসা পড়ছে। তোরা রেডি হ । এরপর সম্রাট এবং রুবেলকে ছাড়া তিনজনকে (আনিস, বিপ্লব, মিঠু) একটি রুমে নিয়ে আসা হলো। তখনো সবার হাত এবং চোখ বাঁধা। সেখানে আনার পর একজন জিজ্ঞেস করলো কিভাবে তাদেরকে কোথা থেকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে।

সব শোনার পর বললো তোরা বোমা মারস, মানুষ হত্যা করস। তোরা কে কোন পদে আছস বল? কোন পদে নাই বলার পর পত্রিকায় নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দেখে বলতো তোদের পদ আছে। তোরা মিথ্যা বলছস।

এরপর বললো তোদের সাথে হয়ত মা-বাবার দোয়া আছে। এখানে যারা আসে তারা কখনো পঙ্গু হওয়া ছাড়া বের হতে পারে নাই। তখন এত রাতে ছাড়ালে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করবে, পুলিশ ধরলে বলবি তোদের ছিনতাইকারী ধরে নিয়ে গেছিলো। এর বাইরে কিছু বলবি না।

তারপর মুখের কালো কাপড়টা সরিয়ে গামছা দিয়ে চোখ বাঁধলো এবং হ্যান্ডকাপ খুলে আরেকটা গামছা দিয়ে হাত বেঁধে দিল। এরপর গাড়িতে উঠিয়ে বসালো। প্রায় এক ঘন্টার মত গাড়ি চলার পর মনে হল মেইনরোড দিয়ে গাড়ি চলছে। এসময় প্রত্যেকের পকেটে ২০০ করে টাকা দিয়ে দিয়েছিল। একটা জায়গায় এসে গাড়ি থামিয়ে ৩০ সেকেন্ডের মাঝে তিনজনকে নামিয়ে দিল। তখন খালি শোনা গেল গাড়ি টান। এর বাইরে আর কিছু শোনা গেল না। এরপর কোনমতে গামছা খুলে ১২ দিন পর আলোর মুখ দেখলাম। তখন মনে হল যেন নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি। কিন্তু কোথায় ছাড়লো বুঝতে পারছিলাম না। তারপর একটু হেটে মেইন রোড়ে আসতেই দেখলাম পুলিশের টহল দল। তখন আমাদের তিনজনের হাতেই দুটি করে গামছা। পুলিশ ধর বলার পরই দিলাম দৌঁড়। দৌঁড়িয়ে একটা সাঁকোর সামনে গিয়ে থামলাম। তখন অনেক রাত ভয়ে আর সাঁকো পার হলাম না। একটা পুকুরের সামনে এসে ঝোঁপের আড়ালে বসলাম। তখন অন্যদিক থেকে একটা রিকশা আমাদের দিকে আসছিলো। তারপর একজন গিয়ে রিকশাওয়ালাকে সব খুলে বলার পর তার বাড়িতে রাতে আশ্রয় দিতে রাজি হল। তখন বুঝলাম আমাদেরকে বিক্রমপুরের সিঁড়ি ঘাটের কাছে নামিয়ে দিয়েছে। বিক্রমপুর ছিল বিপ্লবের মামার বাড়ি।

রাতে রিকশাওয়ালার বাড়িতেই থাকলাম। তবে ঘুমাতে পারলাম না। কারণ রিকশাওয়ালার বাবা মনে করছিলেন আমরা রিকশা চুরি করতে এসেছি। তাই তিনি সারাক্ষন সাথেই ছিলেন। ফজরের আযানের পর ঐ বাসা থেকে বের হলাম। এরপর একটা করে গামছা ফেলে দিলাম। একটি হোটেলে গিয়ে ১২ দিন পর মুখ ধুলাম। নাস্তা করে মিঠুকে বিদায় করে দিলাম। তার মত করে বাসায় চলে যেতে।

আনিস জানায়, এরপর বিপ্লবের মামা বাড়ি গিয়ে উঠলাম। সেখান থেকে বাসায় যোগাযোগ করে জানালাম আমি বেঁচে আছি। তবে সম্রাট এবং সোহেল আজও নিখোজ রয়েছে।

২৫ thoughts on “যেভাবে অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে ফিরে আসলেন ছাত্রদল নেতা গুম আনিস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *