নেতা, জনগন আর সেই অদৃশ্য হাত

পুরানা এক গল্প নতুন করে বলি। স্কুলে থাকতে পড়েছিলাম। কিছু কিছু মনে আছে। কথাগুলো এমনঃ

একটি রাস্ট্র একা একা চলতে পারেনা। একটি রাস্ট্রের সকল সম্পদের মালিক সেই রাস্ট্রের নাগরিকেরা। একটি রাস্ট্রে অনেক নাগরিক বসবাস করে তাই এইসব নাগরিকেরা রাস্ট্র ও জনগনের কল্যানের জন্য কাজ করবে এমন একটি রাজনৈতিক দলকে জনগনের প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত করে।

এই রাজনৈতিক দলটি যদি জনগন ও রাস্ট্রের কল্যানের জন্য কাজ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে জনগনের কাজ হলো এই রাজনৈতিক দলকে রাস্ট্র পরিচালনার কাজ থেকে অব্যহতি দেওয়া। তারপর জনগন অন্য একটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচিত করবে। সেই দল যদি ব্যর্থ হয় তাহলে সেই দলকেও গদি ছাড়তে হবে। একটি রাস্ট্রে অনেক রাজনৈতিক দল থাকতে পারে।  জনগন যার যার ইচ্ছামত তার তার পছন্দের রাজনৈতিক দলকে নির্বাচিত করতে পারে। যে দলটি সংখ্যাগরিষ্ট ভোটে জয়লাভ করবে সেই দলটি রাস্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিবে। বাকী নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যার যার এলাকা থেকে সংসদ সদস্য হিসাবে জনগনের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।

উপরের গল্পটি বাংলাদেশের আবালবৃদ্ধবনিতা সবারই জানার কথা। সবার যেটা জানার কথা না সেটা হলো – বাংলাদেশ পরিচালনা করার জন্য রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জনগনের আদৌ কোন ভূমিকা আছে কি নেই। আমি যতদূর জানি। কে বা কাহারা রাস্ট্র পরিচালনা করবে আর কে করবেনা সেটা নিয়া জনগন অনেক মাথা ঘামায় কিন্তু  এই ব্যাপারে জনগনের আদৌ কোন ভূমিকা নেই। সর্বকালেই বাংলাদেশে নির্বাচনে কারচুপি হয়। দুর্নীতিবাজেরা সব নির্বাচিত হয়। জোর যার মুলুক তার। জনগনের কোন ক্ষমতা নেই এইসব বন্ধ করার। তাই রাস্ট্র ও জনগনের ভাগ্য পরিবর্তিত না হয়ে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। সবাই আশা করে যদি তাদের দল জয়লাভ করে তাহলে তারাও একইভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে নেবে। সেজন্য দেখা যায় যখন যে দল নির্বাচিত হয়, তখন সেই দলের সমর্থকদের বাড়ী, গাড়ী, ব্যবসা, ব্যাঙ্ক বালান্স বৃদ্ধি পায়।

১৯৭২-৭৫ সালে যারা বিরোধীদলে ছিল তারা কেউ টাকার জন্য রাজনীতি করতোনা। এখন রাজনীতি মানেই টাকা, সুযোগ, সুবিধা, দুর্নীতি, হানাহানি। ব্যক্তিগত লাভক্ষতির হিসাব নিকাশ। ১৯৭২-৭৫ সালে বিএনপীর জন্ম হয়নি।

বিএনপীর যখন জন্ম হয় তখন বাংলাদেশের আর্মীরা ব্যাপক সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। ১৯৭৫ সালের বিপ্লবীরা বিদেশের রাস্ট্রদূত হিসাবে নিয়োজিত হয়। সাদ্দামের আমলে ইরাক ও গাদ্দাফির আমলে লিবিয়াতে এরা কন্ট্রাক্টর হিসাবে ব্যবসা করে, মুনাফা করে এবং যার যার ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড় গড়ে।

তাহলে জনগনের জন্য কে কি করলো? রাস্ট্রের জন্য কে কি করলো? এক দল মানুষ অট্টালিকাতে বসবাস করে অন্য দল মানুষ নীচে বসে গার্বেজ খায়। রাস্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব কে নেবে সেই সিদ্ধান্ত জনগনের নেবার দরকার হয়না। এক অদৃশ্য হাত সেই সিদ্ধান্ত নেয়। এই অদৃশ্য হাতের দ্বারাই বাংলাদেশ পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সাংস্কৃতি সব কিছুই এই অদৃশ্য হাতের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

রাস্ট্র পরিচালনা কে করবে – এই সিদ্ধান্ত নেয় সেই অদৃশ্য হাত। তাই জনগনের উচিৎ রাজনীতি থেকে দূরে থাকা। রাজনীতির সাথে জড়িত হওয়া মানেই সময় ও প্রানের অপচয়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সম্পত্তির যদি তালিকা করা হয় তাহলে জনগন জানতে পারবে ১৯৪৭ সালে এদের কত একর জমি ছিল, কয়টা বাড়ি ছিল, কতগুলো ব্যবসা ছিল আর ২০১৫ সালে এদের কত একর জমি আছে আর কয়টা বিল্ডিং আছে ঢাকা, চট্রগ্রামে আর কত একর জমি আছে। চট্রগ্রামের এক ব্যবসায়ী তার মেয়ের বিয়া দেয় চট্রগ্রাম স্টেডিয়ামে। হেলিকপ্টারে করে বর আসে। রুপকথার মত। ১৯৪৭ সালে সাড়া বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা যখন চলে যায় তখন ওরা এইসব জমিগুলো বিভিন্ন ধনী মুসলীম লীগের নেতাদের কাছে বিক্রি করে দেয়। তারপর বিক্রির টাকা আচলে বেঁধে ভারতে চলে যায়। — এইরকম আজগুবী কথা কেউ যদি বলে তাহলে বাংলাদেশের জনগন বিশ্বাস করতে পারে আর বিশ্বাস করে বলেই সেই অদৃশ্য হাত এত সহজেই বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যলিপি তৈরি করে। ১৯৭১ সালে হিন্দু ও মুসলমানেরা  নিজেদের ভিটা ছেড়ে পালিয়ে যায় তারপর ১৬ই ডিসেম্বরের পরে ফিরে এসে দ্যাখে তাদের ঘরবাড়ি হাতছাড়া হয়ে গেছে। ১৯৭২ সালে যখন বিহারীরা নিহত হয়, নির্যাতিত হয়, ক্যাম্পে যেয়ে বাস করে তখন বিহারীদের জমিজমা, কারখানাগুলো সব তখনকার প্রশাসকদের কাছে বিক্রি করে দেয় টাকার বিনিময়ে—এটাও রুপকথা। নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করুন — এত সম্পদের মালিক আপনি কিভাবে হলেন? আপনার পূর্ব পুরুষেরা যখন জন্ম নিয়েছিল তখন ওরা আল্লাহ্‌র দরবার থেকে জমিদারী লিখে এনেছিল ?

একজন মানুষ যখন লুট করে সম্পদশালী হয় তখন তার কপাল থেকে লুটেরা নাম মুছে ফেলার জন্য লুটের মাল থেকে কিছু সম্পদ খরচা করে। লোক দেখানো দাতা সাজে। হাসপাতালে কিছু টাকা দেয়। রাজনীতিতে জড়িয়ে জনগনের সেবা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। বিরোধীদলের দিকে হুঙ্কার দিয়ে মন ভুলানো বড় বড় কথা বলে। জনগন ভুলে যায় সে এই ব্যক্তি বাপ বা দাদা একদিন মানুষের সম্পত্তি লুট করে এত ধনী হয়েছে। সবাই সম্পদশালীদের পূজা করে। সম্পদ, ক্ষমতা, চাপাবাজী – এই তিনটার জোর যার আছে সেই দুনিয়াতে সব চাইতে বেশী উপভোগ করে।

এখন দুর্নীতিবাজদের ভেতরও প্রতিযোগীতা আছে। চোরদের ভেতরে প্রতিযোগীতা আছে। বাজারে সর্ব শ্রেনীর লুটেরাদের ভেতর প্রতিযোগীতা আছে। এই প্রতিযোগীতায় যিনি জয়লাভ করেন তিনিই লুট বাজারে মনোপলি খেলে। বাকী চোর ডাকাত দুর্নীতিবাজের উপরে ক্ষমতায়ন করে।

এখানেও জনগনের কোন ভূমিকা নেই। জনগন হলো উলোখাগড়া। জনগন হলো রাজনীতিবিদদের জনপ্রিয় করার মাল মসলা। দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদেরা  ক্ষমতা হাতে পাবার জন্য নিজেরা নিজেরা লড়াই করে আর মাঝখানে জনগন ক্রশফায়ারে মারা পড়ে।  তেতুলিয়া থেকে টেকনাফের মাঝখানে সেই অদৃশ্য হাত ঝোলে। এই অদৃশ্য হাত যাকে ক্ষমতায় বসাবে সেই ক্ষমতায় বসবে। জনগন মৃত সৈনিক।

২ thoughts on “নেতা, জনগন আর সেই অদৃশ্য হাত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *