মুক্তিযুদ্ধকালে শান্তি কমিটির সদস্য অভিযোগে হাঁটুপানিতে নামিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় শাহবাগি ইমরানের দাদাকে

শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের একাংশের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার মুক্তিযুদ্ধকালে নিহত রাজকারের নাতি। রংপুর মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় প্রথমে ছাত্রশিবির করেন, পরে ছাত্রলীগে যোগ দিয়ে কলেজের সভাপতি হন।
ডাক্তারি পাস করার পর রংপুর থেকে ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগের প্রচার উপ-কমিটির সদস্য হওয়ার সুবাধে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগের কথিত গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বায়ক হন।
বুধবার সকালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ইমরান এইচ সরকারের ব্যক্তিগত তথ্যসহ বিস্তারিত পরিচয় ও ঠিকানা জানতে চাওয়ার পরে তথ্যানুসন্ধান করে তার ব্যাপারে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, কুড়িগ্রাম জেলার রাজীবপুর উপজেলার বালিয়ামারীর বাজারপাড়া গ্রামের মতিউর রহমান সরকারের চার ছেলে ও মেয়ের মধ্যে সবার ছোট ইমরান এইচ সরকার। তার জন্ম ১৯৮৩ সালের ১৪ অক্টোবর।
ইমরানের দাদার নাম হাজী খয়ের উদ্দিন সরকার। তিনি মুসলিম লীগ করতেন। মুক্তিযুদ্ধকালে শান্তি কমিটির সদস্য অভিযোগে ১৯৭১ সালের ১৪ জুন স্থানীয় মাখনেরচরে হাঁটুপানিতে নামিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
ইমরানের বাবা মতিন সরকার স্বাধীনতার পরে সিপিবিতে যোগ দেন এবং ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদ পান। বর্তমানে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ইমরান এইচ সরকার ১৯৯৯ সালে এসএসসি ও ২০০১ সালে এইচএসসি পাস করেন। ২০০২ সালে রংপুর মেডিকেল কলেজে ৩১তম ব্যাচে ভর্তি হন তিনি। মেডিকেলেরে ছাত্রাবাসে তিনি প্রথমে ছাত্রশিবিরের সভাপতির সাথে একই কক্ষের বাসিন্দা ছিলেন। ওই সময় শিবির কর্মী হিসেবে সক্রিয় ছিলেন তিনি।
পরে ইমরান ছাত্রলীগে যোগ দিয়ে কলেজ শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক, আহ্বায়ক ও ইন্টার্ন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
ইমরান মেডিকেল থেকে পাস করার পর ২০০৯ সালে ঢাকায় চলে আসেন। এরপর আওয়ামীপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন ‘স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ’ (স্বাচিপ) ও আওয়ামী লীগের প্রচার উপ-কমিটিতে সক্রিয় হন তিনি।
তিনি অ্যাডহক ভিত্তিতে কুড়িগ্রামের উলিপুরে চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পান। পরে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যানসথেশিয়া বিভাগে যোগ দেন।
২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এ রায় না মেনে মোল্লার ফাঁসির দাবিতে সরকারপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর সাবেক ও বর্তমান নেতারা রাজধানীর শাহবাগে ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক (বোয়ান) নামে সমবেত হয়।
ওই সমাবেশকে সরকার পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, বিভিন্ন ব্যাংক-কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান অর্থ-খাবারের যোগান দেয় এবং আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো জনবল সরবরাহ করে। তখন শাহবাগের সমাবেশকে গণজাগরণ মঞ্চ আখ্যা দিয়ে ইমরানকে মুখপাত্র হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে নজিরবিহীনভাবে ১৯৭৩ সালের ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল আইনকে সংশোধন করে ভূতাপেক্ষিকভাবে আবদুল কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করে এবং শাহবাগের দাবি অনুযায়ী তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
মিরপুরের কসাই কাদের নামক ব্যক্তিকে দেওয়া ফাঁসির রায়ের ভিত্তিতে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে প্রথম শ্রেণী প্রাপ্ত শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও বু্দ্ধিজীবী আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়া হয়। মোল্লা তার ফাঁসির রায় কার্যকরের আগ মুহূর্তেও দাবি করে গেছেন তিনি আর কসাই কাদের এক ব্যক্তি নয়।
আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির ১৬ মাস পর এ বছরের ১২ এপ্রিল রাতে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ফাঁসি দেওয়া হয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণী প্রাপ্ত। তিনি পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে সাপ্তাহিক সোনার বাংলার সম্পাদক ছিলেন। বুদ্ধজীবী হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন তিনি। ইসলামী রাজনীতি বিষয়ে তার লেখা বই অনেক জনপ্রিয়।
এদিকে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ইসলাম বিদ্বেষের অভিযোগ তুলে হেফাজতে ইসলামের নামে পাল্টা আন্দোলন গড়ে ওঠে। হেফাজতের ডাকে ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল ও ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে বড় সমাবেশ হয়।
৫ মে শাপলা চত্বরের সর্বশেষ সমাবেশে গভীর রাতে সরকারি বাহিনী রক্তাক্ত অভিযান চালিয়ে হেফাজত কর্মীদের হটিয়ে দেয়। এরপর দিন ৬ মে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চও উচ্ছেদ করে পুলিশ।
এরপরও বিভিন্ন সময়ে সক্রিয় করার চেষ্টা করলে আওয়ামী লীগের আপত্তির মুখে গণজাগরণ মঞ্চে বিভক্ত হয়ে যায়। এক পক্ষের নেতৃত্বে ইমরান থাকলেও আরেক পক্ষের নেতৃত্বে আসেন আওয়ামী লীগের প্রচার উপ-কমিটির আরেক সদস্য কামাল পাশা চৌধুরী।
এই বিভক্তিকে কেন্দ্র করে শাহবাগে ইমরান ও কামাল গ্রুপের মধ্যে মারামারির ঘটনাও ঘটে। তখন কামাল গ্রুপকে জামায়াত-শিবির বলে আখ্যা দেয় ইমরান।
এর প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ১১ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর কেন্টিনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড কেন্দ্রীয় কমিটি।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি মেহেদী হাসান দাবি করেছিলেন, ‘ডা. ইমরান এইচ সরকার শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।সে একজন ছদ্মবেশী। সে ছদ্মবেশ ধারণ করে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয় এবং পরবর্তীতে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে।’
মেহেদি দাবি করেছিলেন, ‘ইমরানের পূর্বপুরুষদের মহান মুক্তিযুদ্ধে কী ভূমিকা ছিল তা বিশ্লেষণ করলেই আসল তথ্য বেরিয়ে আসবে।’
এদিকে গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর গণজাগরণ মঞ্চের নেতা ও সরকারপন্থী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর তৎকালীন সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু দাবি করেছিলেন, ‘ইমরান সরকার জামায়াত শিবিরের সাথে আঁতাত করে নিজের ব্যক্তিগত ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছেন।’
এসময় তিনি ইমরানের সহযোগী ব্লগার আরিফ জেবতিক সাবেক ছাত্রদল নেতা ও ইব্রাহিম খলিল ওরফে সবাক শিবির নেতা বলেও দাবি করেন।
ইমরান এইচ সরকারের বিরুদ্ধে গণজাগরণ মঞ্চের সরকারপন্থীদের তরফে চাঁদাবাজিরও অভিযোগ রয়েছে। এরমধ্যে তার নিত্যনতুন পাঞ্জাবি পরা নিয়েও প্রশ্ন আছে। গণমাধ্যমে তার শতাধিক পাঞ্জাবীর ফটো অ্যালবামও প্রকাশিত হয়েছিল।
ইমরান এইচ সরকার তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সব সময় অস্বীকার করে গেছেন। তবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আপিল বিভাগে ইমরানের বিস্তারিত পরিচয় ও ঠিকানা জানাতে গিয়ে কী তথ্য হাজির করেন তার মাধ্যমেই হয়তো প্রকৃত সত্য জানা যাবে।

২০ thoughts on “মুক্তিযুদ্ধকালে শান্তি কমিটির সদস্য অভিযোগে হাঁটুপানিতে নামিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় শাহবাগি ইমরানের দাদাকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *