ক্ষমতার জোরে ডাঃ হয়ে গেলেন ইঞ্জিনিয়ার…

চিকিৎসক হয়ে তিনি বসেছেন ইঞ্জিনিয়ারের পদে। একই সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন আবাসিক সার্জন ও বায়ো মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। নিচ্ছেন দুই পদের সুযোগ-সুবিধাও। শুধু তাই না। তার দাপটে তটস্থ থাকতে হয় পুরো হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। নিজে নিয়মনীতির ধার ধারেন না। টেন্ডার ছাড়া বিক্রি করে দেন হাসপাতালের যন্ত্রপাতি। তার অবাধ্য হলেই নামে শাস্তির খড়ক। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের এই চিকিৎসক কাম ইঞ্জিনিয়ারের দাপটের কাছে অসহায় খোদ হাসপাতালের কর্তাব্যক্তিরাও। ওই চিকিৎসকের নাম মো. নজরুল ইসলাম। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক ও ট্রমা সার্জারি বিভাগের আবাসিক সার্জন তিনি।

একটি পদে সন্তুষ্ট নন তিনি। তার কাঙ্ক্ষিত পদ বায়ো মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। এক সময় চেষ্টা-তদবির করে কাঙ্ক্ষিত এ পদটি পেয়ে যান তিনি। তবে বাধ সাধেন রাজধানীর সেগুনবাগিচাস্থ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা। একজন ডাক্তারকে ওই পদে বেতন দিতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। তবে থেমে থাকেননি ডা. নজরুল ইসলাম। যে কোনভাবে পদটি তার চাই-ই চাই। তাই আবারও নামেন চেষ্টা-তদবিরে। তবে এবার আর ব্যর্থ হননি। আবাসিক সার্জনের পাশাপাশি নামের পাশে যুক্ত করেন অতিরিক্ত বায়ো মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (নবসৃষ্টি) পদটি। আর এরপর থেকেই হাসপাতালে একক আধিপত্য চলে তার। বিশাল অর্থ পকেটস্থ করতে কিনছেন অপ্রয়োজনীয় বা নিম্নমানের জিনিস। তার মতের সঙ্গে না মিললে বা অসৎ কাজে সহযোগিতা না করলে এক হাত নেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। ক্ষমতার জোরে বদলি করে দেন অপছন্দের ব্যক্তিকে। এমনকি কর্মকর্তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতেও ছাড়েন না।

এজন্য রয়েছে মাস্তান বাহিনীও। তার এ বেপরোয়া কর্মকাণ্ড অনেকটা ওপেনসিক্রেট। তবে মুখ খোলার সাহস নেই কারও। ডাক্তার কাম বায়ো মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার নজরুল ইসলাম সম্প্রতি রাতের আঁধারে বিক্রি করে দিয়েছেন হৃদরোগ (কার্ডিওলজি) বিভাগের বিপুল পরিমান সরঞ্জাম। এসব যন্ত্রপাতি শিক্ষার্থীদের গবেষণার কাজে ব্যবহার করার কথা ছিল। এছাড়া তার সিদ্ধান্তে হাসপাতালের ছাদের ওপর বসানো হয়েছে মোবাইল নেটওয়ার্কের টাওয়ার। ব্যাংকের জন্য সিঁড়ির নিচে জায়গা দেয়ার পক্ষে অনেকে মত দিলেও তার একক ইচ্ছাতেই ব্যবস্থা করা হয়েছে হাসপাতালের সামনে একটি খোলা জায়গায়। গুঞ্জন রয়েছে, এখান থেকেও অর্থ কামিয়েছেন তিনি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৩ সালের ২৩শে জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক প্রজ্ঞাপন জারি করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক ও ট্রমা সার্জারি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. মো. নজরুল ইসলামকে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার শূন্য পদে পদায়ন করে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎকালীন পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. শাহ্‌ নেওয়াজ স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয় এতে মহাপরিচালকের অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু একজন ডাক্তারকে ইঞ্জিনিয়ার পদে নিয়োগ দেয়ায় ওই সময় একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তার নিয়োগটি বাতিল করে।

ডা. নজরুল ইসলাম আবার আগের পদে ফিরে যান। কিন্তু ওই পদটি পেতে তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন। এবার তদবির চলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় গত বছর ৬ই ফেব্রুয়ারি একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে তাকে ওই পদে বদলি বা পদায়ন করে। কিন্তু একজন ডাক্তারকে বায়ো মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার পদে বেতন দিতে আপত্তি জানান মন্ত্রণালয়ের সেগুনবাগিচাস্থ সিজিএ ভবনের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা। এরপরও থেমে থাকেননি। পরে একই বছরের ১২ই মার্চ মন্ত্রণালয় আরও একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে বলা হয়, হাসপাতালের আবাসিক সার্জন ডা. নজরুল ইসলাম তার নিয়মিত দায়িত্বের পাশাপাশি বায়ো মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (নবসৃষ্টি) পদের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। হাসপাতালের তৎকালীন সহকারী পরিচালক (বর্তমান পরিচালক) তাকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এর আগে ২০১০ সালে হাসপাতালের টেলিফোন এক্সচেঞ্জটি নষ্ট হয়ে গেলে ১ কোটি টাকা দিয়ে ২০১১ সালে নতুন একটি টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ক্রয় করা হয়। যেটি ঠিকমতো কাজ করে না। সূত্র জানিয়েছে নষ্ট টেলিফোন এক্সচেঞ্জটি মেরামত করতে এক থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ হতো। তাছাড়া পুরাতন এ এক্সচেঞ্জটির গুণগত মানও ভাল ছিল। নতুনটি ক্রয় করে পুরনোটি কাউকে না জানিয়েই বিক্রি করে দেয়া হয়। ওই সময় হাসপাতালের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাপক ছিলেন মশিউর রহমান। তাকে বিলের কাগজে স্বাক্ষর দিতে বললে তিনি অস্বীকৃতি জানান। তাছাড়া তিনি টেকনিক্যাল কমিটিরও একজন সদস্য ছিলেন। কিন্তু এসব ক্রয়ের ক্ষেত্রে কিছুই জানতেন না। তাকে আত্মসাৎকৃত টাকার ভাগ দেয়ারও প্রলোভন দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া বিভিন্ন সময় এ ধরনের নানা বিষয় নিয়ে নজরুল গংদের সঙ্গে মশিউরের ঝামেলা চলতে থাকে।

ফলে তাদের এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দেয়ায় প্রভাবশালী ডা. নজরুল ইসলামসহ অন্যরা তার ওপর ক্ষিপ্ত হন। তাদের কাজ নির্বিঘ্ন করতে শেষ পর্যন্ত ২০১৩ সালে তাকে মহাখালীর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে বদলি করে দেয়া হয়। মশিউর রহমানকে বদলি করে আরও নির্বিগ্নে এসব কাজ চলতে থাকে। সম্প্রতি মশিউরকে তার বাসা থেকেও উচ্ছেদ করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী কোন নোটিশ ছাড়াই গত ১৯শে মে মশিউরের বসবাসকৃত এইচডি-৬ নং বাসা থেকে উচ্ছেদ করা হয়। উচ্ছেদের সময় একজন ম্যাজিস্ট্রেটও উপস্থিত থাকার কথা। কিন্তু তার কিছুই ছিল না। এসব বিষয় স্বীকার করে মশিউর অভিযোগ করেন তার বাসায় মাস্তান নিয়ে গিয়ে ভাঙচুর চালায়। এ সময় সন্ত্রাসীরা লুটপাট চালিয়েছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। বাসাটিতে বর্তমান সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ওয়ার্ড বয় রেজাউল ইসলাম বাস করছেন। যদিও নিমানুযায়ী সিনিয়রদের এ বাসাটি পাওয়ার কথা।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, হৃদরোগ হাসপাতালটি পূর্বে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সঙ্গেই ছিল। পরে বিশেষায়িত এ হাসপাতালটির কার্যক্রম পাশেই একটি পৃথক নতুন ভবনে চালু হলে তারা তাদের মালামাল নিয়ে যায়। তবে ক্যাথল্যাবের মালামাল সবই রেখে যায়। হৃদরোগে নতুন সরঞ্জাম ক্রয় করায় এগুলো সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের কাজে ব্যবহার করার কথা ছিল। অর্থোপেডিক বিভাগের আউটডোরেই সেগুলো রক্ষিত ছিল। কিন্তু ডা. নজরুল ইসলাম গত মাসে এগুলো বাইরে বের করে রাখেন। এ মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে ক্যাথল্যাবের মূল্যবান সরঞ্জামসহ কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ওইসব যন্ত্রপাতি রাতের আঁধারে বিক্রি করে দেন। বিষয়টি হাসপাতালে ওপেন সিক্রেট হলেও এ নিয়ে মুখ খোলার সাহস নেই কারও। বিক্রিত এসব জিনিসের মধ্যে এনজিও গ্রামের যন্ত্র, প্রায় ২৫টি এসি, সিআর্ম মেশিন, ইনজেকটর মেশিনও ছিল। সিমেন্স কোম্পানির এ মেশিনগুলো তারা দেড় কোটি টাকার বিনিময়ে মেরামত করে দিতে চেয়েছিল বলেও সূত্র জানিয়েছে। তবে তার আগেই গায়েব হয়ে যায়। নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালে পুরনো জিনিসপত্র বিক্রি করতে হলে একটি কমিটি করতে হয়। ওই কমিটি যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেবে কোনগুলো বিক্রি হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কিছুই করা হয়নি।
হাসপাতাল ভবনের ওপরে মোবাইল নেটওয়ার্ক কোম্পানির দুটি টাওয়ার বসানো হয়েছে। এর পেছনেও রয়েছেন ওই চিকিৎসক। ৬২ সালে নির্মিত হওয়া পুরনো এ ভবন এবং হাসপাতালের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে এ টাওয়ার বসানোয় খোদ হাসপাতালেরই অনেকে ক্ষুব্ধ। একটি ব্যাংকের জন্য হাসপাতালের সিঁড়ির নিচেই অব্যবহৃত জায়গাটিতে দেয়ার পক্ষে সবাই মত দিলেও নজরুল ইসলাম বাধ সাধেন। তিনি হাসপাতালের বাইরে সামনে জায়গা দেন। এখানে কয়েক লাখ টাকার মতো লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া হাসপাতালের সামনে গাড়ি পার্কিয়ের জন্য চাঁদার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। আগে এখানে গাড়ি পার্কিয়ের জন্য কোন টাকা লাগতো না। কিন্তু এখন রোগী বহনকারী বা স্বজনদের যেকোন গাড়ি রাখতে গেলেই টাকা লাগে। এজন্য রশিদের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। ফলে দূরদূরান্ত থেকে আসা রোগীদের ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এসব অর্থ প্রতিষ্ঠান নয় বরং নিজেদের পকেটস্থ হচ্ছে। অনেকেই সেবাধর্মী এ প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিক রূপ দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সরকারি কোন অনুমতি ছাড়াই ডা. নজরুল ইসলাম আমেরিকায় কাটিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্তাদের ম্যানেজ করে পরে তিনি চাকরিতে বহাল হন।
জানা গেছে, বায়ো মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার পদের জন্য বিএসসি ডিগ্রি লাগলেও তার এ ডিগ্রি নেই। এসব অভিযোগের ব্যাপারে হাসপাতালের বায়ো মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ডা. নজরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। ক্যাথল্যাবের সরঞ্জাম বিক্রির ব্যাপারে তিনি বলেন, এগুলো দীর্ঘদিন ধরে পড়ে ছিল। ২০-২৫ বছর আগের। ভাল থাকলে তো হৃদরোগ হাসপাতাল নিয়ে যেত। পরিচালকের নির্দেশে পরিষ্কারের জন্য এগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। হাসপাতালের সাবেক রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাপক মশিউর রহমানকে বাসা থেকে উচ্ছেদের ব্যাপারে নজরুল ইসলাম বলেন, এটা হাসপাতালের ব্যাপার। তাকে সরিয়ে পরিচালক মহোদয় আরেকজনকে দিয়েছেন। নিয়ম মেনে সরানো হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা হাসপাতাল বলতে পারবে। পরিচালক মহোদয় সেখানে একজন ওয়ার্ড বয়কে তুলেছেন।
ভবনের ওপর টাওয়ার বসানোর ব্যাপারে তিনি বলেন, রোগীদের স্বার্থে টাওয়ার বসানো হয়েছে। এ ব্যাপারে হাসপাতালের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছে। তাছাড়া বাংলালিংঙ্ক ফ্রি ওয়াইফাই দেয়ার শর্তে তাদের টাওয়ার বসাতে দেয়া হয়েছে। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ব্যাপারে বলেন, এটা আমার জানা নেই। তবে এতটুকু জানি, এখন যেটা নেয়া হয়েছে সেটা ঠিকমতো কাজ করে না। হাসপাতালের সামনে গাড়ি পার্কিয়ের ব্যাপারে বলেন, চুরি ঠেকাতে পুলিশের ডিসি-এডিসি নির্দিষ্ট জায়গায় পার্কিংয়ের জন্য হাসপাতালকে চিঠি দিয়েছিল। পুলিশের চিঠিতে টাকা নেয়ার কথা উল্লেখ ছিল কি না জানতে চাইলে বলেন, তা ছিল না। তবে এ বাবদ সার্ভিস চার্জ নেয়া হয়। এ ব্যাপারে জানতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়ার বক্তব্যের জন্য যোগাযোগ করলেও তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

আতিক / প্রবাস

৪০ thoughts on “ক্ষমতার জোরে ডাঃ হয়ে গেলেন ইঞ্জিনিয়ার…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *