জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছিলেন, ‘আমি তো শেখ মুজিবকে ভয় পাই না, আমি ভয় পাই তার পাশে বগলে ফাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঐ খাটো মানুষটিকে।’ বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকা এই লোকটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক তাজউদ্দীন আহমদ। অথচ যার গৌরবময় অবদান ও কীর্তি এদেশে বর্তমানে রীতিমতো বিলুপ্তপ্রায়। নির্লোভ আত্মপ্রচারবিমুখ তাজউদ্দীন কি ইতিহাসে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু পেয়েছেন? তাজউদ্দীনকে কেন হত্যা করতে চেয়েছিল মুজিব বাহিনী? ‘৭৫-এর পর শক্ত হাতে আওয়ামী লীগের হাল ধরে থাকা তাজউদ্দীনের সহর্ধমিণী জোহরা তাজউদ্দীন কি তার আত্মত্যাগের যথার্থ মূল্যায়ন পেয়েছেন? তাজউদ্দীনের একমাত্র পুত্রকে কেন আওয়ামী দানবদের হাতেই লাঞ্ছিত হতে হলো? তাজউদ্দীনের নাতিকে আওয়ামী লীগের শাসনামলেই কেন পুলিশের বেধড়ক পিটুনি খেতে হলো? তাজদ্দীনের পরিবারের প্রতি এত ক্ষোভই বা কী কারণে?
সম্প্র্রতি তাজউদ্দীন আহমদের বড় মেয়ে শারমীন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসনির্ভর একটি বই লিখেছেন। ‘তাজউদ্দীন আহমেদ নেতা ও পিতা’ শীর্ষক বইটির প্রতিটি পাতার ভাঁজে ভাঁজে লুকানো আছে তাজউদ্দীনের অসামান্য আত্মত্যাগ ও বঞ্চনার কাহিনী। ইতিহাসের অনেক নির্মম সত্য আর ভয়ঙ্কর সব তথ্য রয়েছে এই বইটিতে। কিন্তু খুবই আশ্চর্য লাগল যে, আজ অবধি আওয়ামী লীগের কারও কাছ থেকেই তাজউদ্দীনের মেয়ে শারমীন আহমেদের করা প্রশ্নগুলোর কোনো জবাব পাওয়া গেল না! কিন্তু কেন জবাব দেয়া হলো না, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন বটে। ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের অভিভাবক হিসেবে সংগঠিত করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। কিন্তু এই কিংবদন্তি নেতাকে আজও আমরা দিতে পারিনি তার সঠিক সম্মানটুকু। স্বাধীন দেশের শুরু থেকে আজ অবধি আওয়ামী লীগের একাংশের ষড়যন্ত্র ও চরম হীনম্মন্যতার নিষ্ঠুরতম শিকার হয়ে আছেন নির্লোভ আত্মপ্রচারবিমুখ মুক্তিযুদ্ধের এই মহান সংগঠক। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী এ মানুষটিকে হত্যার প্রচেষ্টা পর্যন্ত চালায় তৎকালীন মুজিব বাহিনীর এক শীর্ষ নেতা।
অথচ ইতিহাস সাক্ষী এই তাজউদ্দীনই সব বিপদ থেকে আগলে রাখেন বঙ্গবন্ধুকে। ৩ আগস্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, দেশদ্রোহিতার অপরাধে শীঘ্রই শেখ মুজিবের বিচার ও উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে। ২ অক্টোবর পাকিস্তানের সামরিক আদালত শেখ মুজিবকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের সুপারিশ করেছে বলে তৎকালীন একটি কূটনৈতিক সূত্রে প্রকাশ পায়। অক্টোবরের শেষে ‘নিউজউইক’ পত্রিকার প্রতিনিধিকে ইয়াহিয়া খান জানান, বাঙালি জাতি যদি শেখ মুজিবের মুক্তি চায় তাহলে তিনি শাস্তি প্রদান থেকে সরে আসবেন। কিন্তু বাংলাদেশ মুক্ত করার চূড়ান্ত অভিযান শুরু করার পর পুনরায় শেখ মুজিবের জীবনাশঙ্কা দেখা দিতে পারে এমন ষড়যন্ত্র ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন তাজউদ্দীন। পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরাজয়ের পর সামরিক জান্তাকে শেষ বর্বরতা থেকে বিরত রাখা সম্ভব হবে এমন নিশ্চয়তা ছিল না বলে তাজউদ্দীনের আশঙ্কা ছিল।
তবে এই আশঙ্কা থেকে শেখ মুজিবের প্রাণ রক্ষার নিশ্চিত একটা কৌশল বের করে আনেন তাজউদ্দীন। বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে শেখ মুজিবের মুক্তিপণ হিসেবে সাড়ে একানব্বই হাজার পাকিস্তানি বন্দী ছিল বাংলাদেশের হাতে। সে লক্ষ্যেই মুজিবের মুক্তির পণমূল্য হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশের অবরুদ্ধ উপকূলভাগ দিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর নিষ্ক্রমণ পরিকল্পিতভাবে বন্ধ করা হয়েছিল। তাজউদ্দীন মনে করেছিলেন, যদি উপকূলভাগে পাকিস্তানিদের পলায়নপথ উন্মুক্ত রাখা হতো তাহলে ৭ ডিসেম্বর যশোরে পতনের পর দক্ষিণ দিকে তাদের যেভাবে দৌড় শুরু হয়েছিল তার ফলে সম্ভবত দুই-তিন দিনের মধ্যেই সারা বাংলাদেশ খালি করে তারা পালিয়ে যেতে পারত।
ফলে যুদ্ধ প্রলম্বিত হতো না, প্রাণহাণিও কমত। তাজউদ্দীনের এই অসামান্য দূরদর্শিতা, ঝুঁকি ও ত্যাগের বিনিময়ে শেখ মুজিবের এই মুক্তিপণ আদায় করা তখন সম্ভবপর হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশকে পুনর্গঠন ও অবকাঠামো পুনঃস্থাপনে দ্রুত পদক্ষেপ নেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরদিন ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একান্তে বসেন তাজউদ্দীন। তখন স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। আর দেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতাকেন্দ্রিক এক সমস্যার সৃষ্টি হয়। পার্লামেন্টারি সিস্টেমে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রকৃত কোনো কার্যকরী ক্ষমতাই ছিল না। এই সিস্টেমে প্রধানমন্ত্রীর হাতেই সব ক্ষমতা বিদ্যমান। শেখ মুজিবুর রহমান এই পদ্ধতি পরিবর্তন করে প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেম প্রবর্তনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন।
তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুকে বোঝান, যে পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আওয়ামী লীগ ২২ বছর ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে তা হঠাৎ করে বাতিল করা সঠিক হবে না। কারণ ৭০-এর নির্বাচনে দেশবাসী এ দাবির পক্ষেই আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে রায় দেয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষমতাকেন্দ্রিক ইস্যুতে তাজউদ্দীনের এই অবস্থানকে সহজভাবে মানতে পারেননি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। এভাবেই সত্তরের নির্বাচনে জনগণের রায় ক্ষমতার রাজনীতির কাছে পরাজয়বরণ করে। এর ধারাবাহিকতায় একে একে ‘৭৩ সালের ভোট ডাকাতির নির্বাচন, জাসদের ৩০ হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা, রক্ষীবাহিনীর নৃশংসতা, সিরাজ শিকদারকে হত্যা করার পর প্রকাশ্য উল্লাস, আর সবশেষে একদলীয় বাকশাল কায়েম করে গণতন্ত্রকে হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পুরো ভিতকেই ধসিয়ে দেওয়া হয়।
একে একে দূরে সরে যেতে হয় মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কদের। আওয়ামী লীগের মধ্যে চরম অন্তঃকলহ, বিবাদ, সন্দেহ ও সংঘাতের জাঁতাকলে দেশে মারাত্মক এক নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়। যার চূড়ান্ত পরিণতিতে জাতিকে হারাতে হয় বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারকে এবং তাজউদ্দীনসহ জাতীয় চার নেতাকে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী খন্দকার মোশতাকসহ বাকশালের ১৯ জন মন্ত্রী তখন তাদের নেতার লাশের ওপর দিয়েই আনন্দচিত্তে মন্ত্রিত্বের শপথ গ্রহণ করে। অথচ বঙ্গবন্ধুর কান ভারি করা সেই নেতারা ঠিকই সেদিন বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সাহচর্য তাজউদ্দীনকে নির্মম এক ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত করে। বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বাস পর্যন্ত করানো হয় যে, তাজউদ্দীন তাকে হত্যা করতে পারে। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তাজউদ্দীন আফসোস করে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু জানতেও পারলেন না- কে তার শত্রু আর কে তার বন্ধু ছিল!’
তাজউদ্দীন আহমদ বাকশাল সমর্থন করেননি। তিনি তাই শেখ মুজিবকে মৃত্যুর আগে সাবধান করেছিলেন, ‘মুজিব ভাই, আপনাকে আরও সতর্ক হতে হবে। যে অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি সে অবস্থা চলতে থাকলে আপনিও বাঁচবেন না, আমিও বাঁচব না…’। কিন্তু শেখ মুজিব তাজউদ্দীনের সে কথায় কর্ণপাত তো করলেনই না, বরং অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে তাকে বরখাস্ত করেন।
গত ক’দিন আগে বর্ণাঢ্যভাবে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন হয়ে গেল। কিন্তু এতে কোথাও স্থান পেল না দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের নাম কিংবা কোনো ধরনের ছবি। তেমনিভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদও রয়ে গেলেন আওয়ামী ইতিহাসে একেবারেই অজানা কেউ। অথচ শেখ মুজিবুর রহমান একাই বঙ্গবন্ধু হননি। শত সহস্র নেতা-কর্মীর আত্মত্যাগেই আওয়ামী লীগের সবটুকু অর্জন।
যারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে, আর যারা মুক্তিযুদ্ধকে নেতৃত্ব দিয়েছে, এদেশে আজ তারাই কেন এত বেশি অসম্মানিত আর অবহেলিত? মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক তাজউদ্দীন আহমদ আর তার একান্ত সহযোদ্ধা ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামরা অবশ্যই ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ। অথচ তাদের নিজ দলের কাছ থেকেই তারা সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত ও বঞ্চনার শিকারে পরিণত হয়েছেন। এদের কাছেই ঋণী আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, মুজিবনগর সরকার গঠন এবং আমাদের পবিত্র সংবিধান। আসুন, এবার অন্তত পদ্মা সেতুটা তাজউদ্দীন আহমদের নামে দিয়ে আমাদের দায়মোচনটা শুরু করি।
আতিক/প্রবাস
Kamrul Islam liked this on Facebook.
Mintu Islam liked this on Facebook.
Allama Delowar Hossen Siyedi liked this on Facebook.
Toriquzzaman Khan liked this on Facebook.
Halim Hossain liked this on Facebook.
Atikur Rahman liked this on Facebook.
probasnews24.com liked this on Facebook.
Nashir Uddin Roman liked this on Facebook.
Ðrêãm Wêãvêr Sûjõñ liked this on Facebook.
Rafiqul Islam liked this on Facebook.
প্রবাস জীবন liked this on Facebook.
Moin Ahmed liked this on Facebook.
Omar Faruk Sagor liked this on Facebook.
Mizanur Rahaman liked this on Facebook.
Mohammad Javed Meah liked this on Facebook.
Jahangir Gazi liked this on Facebook.
Mohammad Nuruddin liked this on Facebook.
Ahmmed Faruq liked this on Facebook.
টিটু খান পাংশা liked this on Facebook.
তারার মেলা বিনোদন সাতকানিয়াই liked this on Facebook.
Alamin Subo liked this on Facebook.
Shajahan Mohammed liked this on Facebook.
Jashim Uddin liked this on Facebook.
Mohammad Maimunul Islam Rony liked this on Facebook.
Ibrahim Khalil liked this on Facebook.
MadZy Anik MoLlick liked this on Facebook.
Sayed Monir Ahamed liked this on Facebook.
K.s. Hossain Tomas liked this on Facebook.
Alamgir Rashid liked this on Facebook.
Reyad Ireland liked this on Facebook.
Prul Aktar liked this on Facebook.
Md Hassan Mehedy liked this on Facebook.
Ariful Islam Jony liked this on Facebook.
Kamal Hossain liked this on Facebook.
Jonogon ar posai podha bridge hoccy , ata tajuddin ar family taka deya ai hoccy na tahly kano unar namy hoby ?
Nurul Islam liked this on Facebook.
Arif Sikder Bappy liked this on Facebook.
Abu Bakar liked this on Facebook.
Md Jashim Uddin liked this on Facebook.
Syed Ahmed liked this on Facebook.
Dolon Shaik Dhakaiya liked this on Facebook.
Sarowar Islam liked this on Facebook.
Shahriar Nafees liked this on Facebook.
Anwar Sarker liked this on Facebook.
Ak Azad liked this on Facebook.
Vorar Akash liked this on Facebook.
MD Shahjahan liked this on Facebook.
Jueal Mazumder liked this on Facebook.
Mohammed Anwar Biplob liked this on Facebook.
Daulat Khan liked this on Facebook.
Azad Azad liked this on Facebook.
Muhim Sumon liked this on Facebook.
Abu Bakar Sohel liked this on Facebook.
Sohel Rana liked this on Facebook.
Halim Khan liked this on Facebook.
Muazzem H. Sayem liked this on Facebook.
Nazrul Islam liked this on Facebook.
Shahinur Rahman liked this on Facebook.
Humayun Kabir liked this on Facebook.
Mahbub Patwary liked this on Facebook.
Rubel Mahmud liked this on Facebook.
মোঃ কবির হোসেন কবির liked this on Facebook.
Atiq Rahman liked this on Facebook.
Surmin Begum liked this on Facebook.
Ahmed Uddin liked this on Facebook.
Ruhul Amin liked this on Facebook.
Atiq Farazi liked this on Facebook.
Yusuf Un Nobi Babu liked this on Facebook.
Titu Khan Pangsha liked this on Facebook.
Ibrahim Khalil liked this on Facebook.
Hasan Dewan liked this on Facebook.
Imam Uddin liked this on Facebook.
Zakir Hussain liked this on Facebook.
Mohammad Uddin liked this on Facebook.