বর্বর দেশে এলো খুশীর ঈদ

প্রাকৃতিক কারণে যখন কারু মৃত্যু হয় তখন আমরা কিছু করতে পারিনা যেহেতু প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। পাশবিক কারণে যখন কারু মৃত্যু হয় তখন আমরা সেই খুনীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বিধান করে এই ধরনের পাশবিকতার  হার হ্রাস করতে পারি। কিন্তু যখন খুনীদের সমাজে প্রতিষ্টিত করা হয়, যখন খুনীদের সমাজের উচ্চ স্থানে বসিয়ে পূজা করা হয়, আর যখন আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী নিজেরাই হত্যা কান্ড চালায় তখন সমাজের অন্যান্য খুনীদের মাঝে খুন করার সুপ্ত বাসনা জেগে উঠে। মশামাছির মত এরা মানুষ হত্যা করে।

কিছুক্ষণ আগে আমি ফেসবুক বন্ধ করলাম। দেওয়ালে দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে একটি শিশু হত্যার ভিডিও। একটি শিশুকে পিটিয়ে হত্যা করার সময় সেই ভিডিও ধারন করা হয়েছে এবং তা সবাই দেওয়ালে দেওয়ালে শেয়ার করছে। বুঝিনি এই ভিডিওটি সবার জন্য কি বার্তা এনেছে। সামনে ঈদ আসছে। ঈদের খুশীতে মানুষ হত্যা। হতে পারে। তবে এই ভিডিও দেখার সাহস আমার হয়নি। ভিডিওর নীচে পোস্ট করা কিছু মন্তব্য পড়েছি। কিছু বুঝিনি। বাংলাদেশ জনবহুল দেশ। এই ভিডিও ধারণ করার সময় সেখানে শুধু খুনীরা ছিল আর কেউ ছিলনা। ধারণা করা যাচ্ছে সেখানে কোন মানুষ ছিলনা। যদি সেখানে কোন মানুষ থাকতো তাহলে নিশ্চয় এই ভিডিও ধারণ করার কোন দরকার হতোনা । সেই মানুষ বা মানুষগুলো এই ছেলেটার জীবন রক্ষা করতো। তাহলে আর ফেসবুকের দেওয়ালে দেওয়ালে এই নৃশংস হত্যাকান্ডের স্টিমিং ভিডিও শোভা পেতোনা। শত শত বেকার আর নিষ্টুর মানুষেরা মায়া কান্না কেঁদে ভিডিওর নীচে মন্তব্য পোস্ট করার সুযোগ হারাতো। এটা ভাবা যায়না। অন্তত জনবহুল বাংলাদেশে কোন মানুষ বসবাস করে এটা ভাবা যায়না। আমার এই লেখাতে আমি এই হত্যাকান্ডের ভিডিও পোস্ট করতে পারছিনা। আমার সাহস নেই। আমি রোজা আছি। এই ঘটনা পড়ে অসুস্থবোধ করছি।

এধরণের ঘটনা আগেও ঘটেছে। পুলিশে একটি কিশোরকে বেঁধে এনে জনগনের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। জনগন ছেলেটিকে পিটিয়েছে তারপর পুলিশ সেই লাশ উঠিয়ে নিয়ে গেছে। গনপিটুনীতে হত্যা বাংলাদেশে একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কিছু মানুষ একজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করে আর সেটা দেখার জন্য চারিপাশে ভিড় জমে। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দ্যাখে । কেউ কেউ ভিডিও করে ফেসবুকে পোস্ট করে। রাজনৈতিক কারণে অনেকেই চায় এই ধরনের ঘটনা ঘটুক। একজন নেত্রী বলেছে – এইভাবেই অন্য নেত্রী পচুক। যত পচবে ততই নাকি ক্ষমতা দখল করতে সুবিধা হবে। তাই রাজণীতিবিদের জন্য  মানুষ হত্যা একটি আশীর্বাদ। মানুষ হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতার রদবদল একটি স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া।  এই ধরনের ভিডিও অনেকবার ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছে। অনেকবার মানুষের দেওয়ালে দেওয়ালে সেগুলো শোভা পেয়েছে। সেইসব ভিডিওর নীচে অনেক পশু মায়াকান্না কেঁদে মন্তব্য পোস্ট করেছে।  ভুয়া সহানুভুতি দেখানোর কারণ হলো নিজের প্রচার করা। সাড়া বিশ্বের সব দেশেই খুনী আছে । তবে সাড়া বিশ্বের সব দেশেই সম্ভবতঃ খুনের বিরুদ্ধে বিচারের ব্যবস্থা  আছে।

সাড়া বিশ্বের মধ্য বাংলাদেশের খুনীরাই সব চাইতে সৌভাগ্যবান। মানুষ হত্যার কোন বিচার হয়না বাংলাদেশে। আইন আছে কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। ভুল বললাম । অনেক বড় ভুল। ইসরায়েলী বোমা যখন পালেস্টাইনের মা ও শিশুদের হত্যা করে তখন কোন বিচার হয়না। তবে বাংলাদেশের খুনীদের সাথে ইসরায়েলী খুনীদের তুলনা চলেনা। ইসরায়েলীরা ইসরায়েলী শিশু, কিশোর, যুবক হত্যা করেনা। তারা অন্য দেশ থেকে এসে পালেস্টাইনের নাগরিকদের হত্যা করছে। বাংলাদেশের খুনীরা বাংলাদেশীদের হত্যা করছে। এই দুই হত্যাকান্ডের ভেতর পার্থক্য আছে। ইসরায়েলীরা পালেস্টাইনের জমি চায়। সেজন্য তারা পালেস্টাইনীদের হত্যা করছে যাতে যদি কেউ জীবিত থাকে তারা প্রানভয়ে পালিয়ে যাবে তাদের জমি ছেড়ে যাতে ইসরায়েল পালেস্টাইনে তাদের সম্রাজ্য গড়ে তুলতে পারে।

বাংলাদেশের খুনীরা বাংলাদেশী হত্যা করছে বিভিন্ন কারণে। কেউ হত্যা করছে তার ভেতরের পশুকে আনন্দ দেবার জন্য। রক্ত ও লাশ ভালবাসে সেজন্য। কেউ হত্যা করছে ভয় দেখানোর জন্য। কেউ হত্যা করছে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য। কেউ হত্যা করছে টাকার জন্য। টাকা দিয়ে বৈভব কিনবে সেজন্য। বাংলাদেশের খুনীরা বিদেশীদের হত্যা করেনা। বিদেশীদের গোলামী করে। বাংলাদেশের খুনীরা বাংলাদেশীদের হত্যা করে। বাংলাদেশ বা পূর্ব বাংলা বহু যুগ ধরে বিদেশীদের গোলামী করে আসছে । আমি ভাবছি বিদেশীদের কাছ থেকে বাংলাদেশীরা গনহত্যা করতে শিখেছে নাকি বিদেশীদেরকে গনহত্যা করতে শিখিয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী বাংলাদেশীদের গনহত্যা করতে শিখিয়েছে কিনা বলা মুস্কিল। কারণ ১৯৭২ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশীরা বাংলাদেশী হত্যা করে। গরু জবাইয়ের মত। মুরগী জবাইয়ের মত। মশামাছি মারার মত।

একজন খুনী অন্য একজন খুনীকে খুন করতে তেমন একটা দেখা যায়না। একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে রাস্তায় পিটিয়ে হত্যা করতে দেখা যায়না। ডঃ বদরুদ্ধোজা চৌধুরী বা কাদের সিদ্দিকীকে রাস্তায় ফেলে কেউ পিটিয়ে হত্যা করবেনা। কিন্তু বাংলাদেশের সড়কে একটি অসহায় শিশুকে হত্যা করতে দেখা যায়। একজন প্রতিবন্ধিকে পিটিয়ে হত্যা করতে দেখা গেছে। অসহায় নারীকে পিটিয়ে হত্যা করতে দেখা গেছে। সাড়া বাংলাদেশ থেকে আসা হাজার হাজার আলেম রাতের অন্ধকারে ৪৫ মিনিটের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখা গেছে। এই অদৃশ্য করতে খরচা হয়েছে ১৫৫০০০ রাউন্ড এম্যুনিশন। বিভিন্ন খুনীকে দেখা গেছে পুলিশ পাহাড়াতে অসহায় মানুষকে পেটাচ্ছে। পুলিশকে দেখা গেছে রাস্তায় মানুষ হত্যা করছে – সাংবাদিকেরা সেইসব হত্যা্কান্ডের ছবি উঠিয়ে প্রকাশ করেছে আর ফেসবুকের দেওয়ালে দেওয়ালে তা শোভা পেয়েছে। বাংলাদেশের কোন আদালতে এইসব হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে কোন মামলা করা হয়নি। ধরে নিচ্ছি অসহায় কোন মানুষকে হত্যা করা বৈধ।

প্রতিবাদ মিছিলে নারীপুরুষকে পেটানো খুব স্বাভাবিক দৃশ্য। বাংলাদেশের পুলিশের দায়িত্ব হলো প্রতিবাদীদের পেটানো, গুলি করা এবং সাংবাদিকদের দায়িত্ব হলো এইসব দৃশ্য ধারণ করা। ফেসবুকারদের দায়িত্ব হলো এইসব দৃশ্য ফেসবুকে পোস্ট করা । কেউ কেউ উল্লাস করে কেউ কেউ মায়াকান্না কাঁদে । তবে ফেসবুকের অনেকেই রক্ত ভালবাসে। লাশ ভালবাসে। ধর্ষন ভালবাসে। এক এক খুনের পেছনে এক এক কাহিনী লেখে। হাসি তামাসা করে। নারী ধর্ষন করে হত্যা করা হলে অনেকেই মন্তব্য লেখে — “পর্দা না করার জন্য এইটা হয়েছে” । অর্থাৎ যারা যারা পর্দা না করবে তাদেরকে ধর্ষন করে হত্যা করা স্বাভাবিক ঘটনা। অনেক সময় দেখা গেছে বিভিন্ন পর্দানশীন মহিলাকে তাদের বাসা থেকে পুলিশে গ্রেফতার করেছে। কোরআন পাঠ করার জন্য বা ইসলামিক সভা করার জন্য। এখন বুঝতেছিনা কোনটা স্বাভাবিক।

তবে সভ্যতা অন্য কথা বলে।
সভ্যতার মানদণ্ড অনুসারে মানুষ হত্যা পাপ।
একজন নিরস্ত্র, অসহায়, মানুষ হত্যা করা অপরাধ।
যারা খুন করে তারা আর যারা এই খুন হতে দেখে বাঁধা দেয়না তারা আর যারা এই খুনীদের শাস্তি বিধান না করে তারা – এরা সবাই অপরাধী।

ফেসবুকে একটা পোস্ট প্রায়ই দেখি সেটা হলো— “আল্লাহ্‌ বিচার করবে”

বাংলাদেশের বিচার বিভাগ তাহলে কি করবে?  বাংলাদেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে পাশ করা হাজার হাজার আইনজীবিরা কি করবে? বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী কি করবে?

“আল্লাহ্‌ বিচার করুক”
খুনীরা খুন করুক
আইনজীবিরা ভুয়া মামলাতে ফাঁসিয়ে নির্দোষ মানুষকে ফাঁসী দিক।
অসহায় মানুষের লাশগুলো সড়কে, খালে, বিলে, নদীতে, মর্গে বা কাঁটাতারের বেড়াতে ঝুলে পচুক। সাংবাদিকেরা লাশের ছবি প্রকাশ করুক। ফেসবুকের দেওয়ালে দেওয়ালে মানুষ হত্যার দৃশ্য শোভা পাক। সেই লাশের ছবির নীচে বিভিন্ন মুখোশ মায়াকান্নাভরা মন্তব্য করুক। ভাবটা এমন যেন এরা সবাই চন্দ্রলোকে বসবাস করে। খুনের নেশায় নেশায় পাশবিক ও বর্বর বাংলাদেশের পবিত্র ঈদ আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠুক।

৩ thoughts on “বর্বর দেশে এলো খুশীর ঈদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *