গরিবের সঙ্গে প্রতারণা, ইবাদতের নামে রিয়া

ঢাকা: রমজানে যেকোনো ইবাদতের সওয়াব অন্য সময়ের সত্তর গুণ। এ কারণে এ সময়টাতে ধর্মপ্রাণ সামর্থ্যবানদের দান খয়রাতের প্রবণতাও বাড়ে। বাজারে যাকাতের কাপড় বেচাকেনার ধুম পড়ে। কিন্তু যাকাতের নামে দেশে যা চলছে তা রীতিমতো লজ্জাজনক। অনেকে তো শুধু নাম কামানোর জন্যই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করেন। এতে যে আন্তরিকতার ছিঁটেফোঁটা নেই তা যাকাতে পণ্য ক্রয় ও বণ্টনের প্রক্রিয়া দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়।

রমজান শেষের দিকে। প্রতি বছরের মতো এবারও রাজধানীসহ দেশের আশে পাশের বাজার নিম্নমানের কাপড়ে ছয়লাব হয়ে গেছে। এগুলো সব যাকাতের কাপড়। সরেজমিনে কয়েকটি মার্কেট ঘুরে ক্রেতা বিক্রিতা ও উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে এই পুরো প্রক্রিয়াটি জানার চেষ্টা করা হয়েছে।

বাজারে ‘যাকাতের কাপড়’ নামে শুধু নিম্নমানের কাপড় বিক্রি হচ্ছে এমনটিই শুধু নয়, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ‘যাকাতের কাপড় পাওয়া যায়’ সাইনবোর্ড ব্যবহার করে যাকাত দাতাদের প্ররোচিতও করছে। এমনকি এসব কাপড় কেনার আড়ালে ব্যবসায়ী ক্রেতা প্রতিনিধি কর্মচারীদের মধ্যে কমিশন বাণিজ্যও রয়েছে।

তবে এসব কাপড় যাকাতের নামে গরীব মানুষকে দেয়া প্রতারণা ছাড়া কিছু নয় বলেই মনে করছেন ইসলামি চিন্তাবিদ ও ইসলামি অর্থনীতিবিদরা। এছাড়া অনেক যাকাত দাতা লোক দেখানো ইবাদত করছেন। ইসলামে যাকে বলে ‘রিয়া’। আর ইসলামের দৃষ্টিতে রিয়া হচ্ছে ‘শিরক’। আর পরকালে মুশরিকদের (শিরককারীদের) শাস্তি হবে সবচেয়ে কঠোর।

এ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাইয়্যেদ আব্দুল্লাহ আল মারুফ বাংলামেইলকে বলেন, ‘যাকাতের কাপড় বলতে কোনো কাপড় নাই। যারা যাকাতের নিম্নমানের কাপড় গরীব মানুষকে দিচ্ছে তারা আসলে প্রতারণা করছে।’

তিনি বলেন, ‘যাকাতের কাপড় দিতে হলে ভালো কাপড় দিতে হবে। যাতে একজন তা পরে আরামবোধ করে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, কস্মিনকালেও তোমরা কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যদি তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে তোমরা ব্যয় না কর। আর তোমরা যা ব্যয় করবে আল্লাহ তা জানেন, (সুরা আল ইমরান, আয়াত: ৯২)।’

তিনি আরও বলেন, ‘সমাজের মানুষকে আত্মনির্ভরশীল ও সাবলম্বী করাই যাকাতের উদ্দেশ্য। কিন্তু বর্তমান সমাজে যাকাতের নামে যে কাপড় দান করা হচ্ছে তা দিয়ে মানুষের কোনো ধরনের উপকার হয় না। যারা লোক দেখানোর জন্য যাকাতের নামে এসব প্রতারণামূলক কাজ করছে তাদের জন্য পরকালে শাস্তির বিধান রয়েছে বলে হাদিসে উল্লেখ আছে। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম মুফতি মহিবুল্লাহহিল বাকী নদভীও একই মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, যাকাতের নামে যেসব নিম্নমানের কাপড় দেয়া হচ্ছে তা শরিয়ত অনুমোদন করে না।’

সরেজমিনে রাজধানীর ইসলামপুর, নিউমার্কেট, রাজধানী সুপার মার্কেট, বঙ্গবাজার, ফুলবাড়িয়া মার্কেট ঘুরে ব্যবসায়িদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, রোজার আগে থেকে যাকাতের কাপড় তৈরি শুরু হয়। রোজার প্রথম দিকে সারাদেশের খুচরা ব্যবসায়ীরা এসব কাপড় কিনে নেয়। কয়েক রোজা পার হলে বড় ধরনের অর্ডার আসে। বিক্রিও ভালো হয়।

তারা জানান, কাপড় কিনতে যাকাতদাতারা খুব কমই মার্কেটে আসে। বেশিরভাগই কর্মকর্তা, কর্মচারী পাঠিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে পরে অর্ডার দেয়। আবার অনেকে তাও করে না। কর্মচারী বা কর্মকর্তার মাধ্যমেই হাজার হাজার পিস কাপড় অর্ডার দেয়। তারাই আবার ডেলিভারি নেয়।

যাকাতের কাপড়ের গুণগত মান জানতে চাইলে রাজধানী মার্কেটের ব্যবসায়ী ও আকাশ টেক্সটাইলের স্বত্বাধিকারী হাজী মো. সামসুদ্দিন সেলিম বাংলামেইলকে বলেন, ‘আসলে যাকাতের কাপড় মানুষ সস্তায় কিনতে চায়। আর তাই কম দামে বিক্রি করার মতো মেটারিয়ালস দিয়েই কাপড় তৈরি করা হয়। যেমন দাম তেমন গুণ! এসব কাপড় একজন মানুষ প্রায় দুই মাস পরতে পারবে।’

বাজার ঘুরে দেখা যায়, যাকাতের নামে যেসব কাপড় বিক্রি হচ্ছে তার মধ্যে প্রতি পিস শাড়ি পাইকারি ১০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা, লুঙ্গি ৭০ টাকা থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে ।

আর এই কাপড় কেনা নিয়ে ব্যবসায়ী আর যাকাতদাতার প্রতিনিধির মধ্যে কমিশন বিনিময়ের প্রসঙ্গটি খোলাসা করলেন ইসলামপুরের এইচ এইচ টেক্সটাইলের ম্যানেজার শফিউল হক। তিনি বলেন, ‘কোনো মালিক তার কর্মচারী বা কর্মকর্তাকে পাঠালে তিনি আগে এসে তার কমিশন ঠিক করেন। এরপর কাপড় কিনেন। আর এভাবে আমাদের কাপড়গুলো বেশি বিক্রি হয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘যেমন ধরুন, এক পিস শাড়ির খুচরা দাম ২২০ টাকা, তার পাইকারি বিক্রি ১৮০ টাকায়। আমরা পাইকারি দাম থেকে প্রতি পিস শাড়িতে ১০ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত কমিশন দেই। আবার রশিদ দেয়ার সময় পাইকারি দাম ১৮০ টাকা উল্লেখ করি। এতে মালিককে দেখানো হয় ১৮০ টাকায় প্রতি পিস শাড়ি কেনা হয়েছে। আর কমিশনটা ক্যাশ দিয়ে দেই।’

গুণগত মান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মান কেউ জিজ্ঞাস করে না, জানতে চায় কত কম দামে কাপড় কি না যাবে!’

ইসলামপুরে যাকাতের কাপড় কিনতে আসা মো. জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১০ বছর ধরে চাকরি করছেন। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান খুব ব্যস্ত। তাই প্রতিবছর যাকাতের কাপড় কেনার দায়িত্ব তাকেই দেয়া হয়। এবার তিনি শাড়ি-লুঙ্গি মিলিয়ে এক লাখ পিস কাপড় কিনবেন।

তিনি বলেন, ‘কাপড়ের দাম গতবছরের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। তাই এবার কম দামে কিনতে খোঁজাখুঁজি করতে হচ্ছে।’

কম দামের কাপড় কিনকেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে স্যার গ্রামের বাড়িতে যাকাতের কাপড় বিলাবেন। এলাকায় তিনি অনেক জনপ্রিয়। তাই অনেক মানুষকে কাপড় দিতে হবে। কাপড় শর্ট পড়লে সম্মান থাকবে না। কম দামে হলেও সবাইকে দিয়ে সম্মান রক্ষা করতে হবে।’

এ ব্যাপারে ইসলামি চিন্তাবিদরা বলছেন, ইসলামে যাকাত আদায় অবশ্য পালনীয় (ফরজ)। যাকাতের মাধ্যমে সমাজে বৈষম্য দূর হয়। কিন্তু যাকাতের নামে নিম্নমানের কাপড় দিলে বৈষম্য আরও বাড়ে। এসব কাপড় দু’একবার ধুলেই ন্যাকড়া হয়ে যায়। নিম্নমানের বা অপছন্দনীয় মাল যাকাত হিসেবে দিলে যাকাত আদায় তো হবেই না বরং ‘রিয়া’ হবে বলে জানান তারা।

এ সম্পর্কে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা মুফতী এহসানুল হক বাংলামেইলকে বলেন, ‘গরীব মানুষের প্রয়োজন মিটানো হলো যাকাতের উদ্দেশ্য। বর্তমানে সমাজে যেসব নিম্নমানের কাপড় দিচ্ছে তা দিয়ে গরীব মানুষের খুব একটা প্রয়োজন মিটে না। একজন গরীব মানুষ কোন জিনিসের অভাব বেশি বোধ করছে, সুযোগ থাকলে যাকাতদাতাকে তার সঙ্গে পরামর্শ করে তা দেয়া। আর যাকাতের মাধ্যমে সে জিনিসটি দিলে গরীব মানুষটি উপকৃত হবে। যাকাতের উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে।’

অপরদিকে ইসলামি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যাকাতের কাপড় বলতে ইসলামি অর্থনীতিতে কিছু নাই। যাকাত হিসেবে কাপড় দিয়ে আমরা গরীবদেরকে নিম্নমানের কাপড় পরতে বাধ্য করছি। দেশে বা সমাজে এমন বহু পরিবার আছে যারা সময় মতো খাবারের যোগান করতে পারে না, যাকাত তো তাদের সম্পদ। তাদেরকে কাপড় কিনে দিয়ে সমাজে নিজের কর্তৃত্ব হাসিল করা হয়।

তারা বলেন, যাকাতের মাধ্যমে সমাজের উন্নয়ন করা সম্ভব, সেটা যদি পরিকল্পিতভাবে দেয়া হয়। এতে সমাজ ও দেশের উন্নয়নের অংশীদার হওয়া সম্ভব।

সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্টের উন্নয়ন বিষয়ক গবেষক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশে যাকাতের নামে কম দামে অধিক পরিমাণ কাপড় গরীব মানুষকে দেয়া মানে হলো নিজেকে প্রচার করা। এটা আসলে ঐতিহাসিকভাবে চলে এসেছে। তাদেরকে বুঝাতে হবে যে, এটা আসলে যাকাত দেয়ার সিস্টেম নয়। আর তাহলে তাদের দেয়া যাকাতের অর্থ সুষম বণ্টনের মাধ্যমে সমাজ তথা দেশের উন্নয়ন হবে।’

তিনি বলেন, ‘যাকাত সম্পর্কে একটি হাদিস আছে। আর তার অর্থ হলো- ততক্ষণ পর্যন্ত সাহায্য কর যতক্ষণ পর্যন্ত সে মুক্ত না হয়। এ থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, যাকাতের মাধ্যমে আর্থিক ও নৈতিক সক্ষমতা বাড়ানো যায়। আসলে এটাই বড় বিষয়।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.