মরণ রে তুহু মম শ্যামও সম

শুয়ে শুয়ে মোবাইলে নিউজ ফিড পড়ছিলাম হঠাৎ ফেসবুকের ছোটভাই টুটুল নেসারের নোট এলো চোখের সামনে। সুমি আত্মহত্যা করেছে। আমি সুমিকে চিনিনা। টুটুলের সহকর্মী ছিল। নোটটা পড়লাম। সুমির ফেসবুক প্রফাইলে ঘূরে এলাম। সুমি চুপচাপ মেয়ে। চমৎকার কভার ফটো। সম্ভবতঃ তার নিজের তোলা। সুমী একজন শিল্পী । মুভির পোষাক ডিজাইন করে। “আত্মহত্যা” শব্দের উপরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে স্তম্ভিত, দুঃখিত ও নস্টালজিক হয়ে গেলাম।

ছোটবেলায় যখন আমার কোন সমস্যা ছিলনা তখন আমি অনেকবার আত্মহত্যার কথা ভেবেছি। ছোটখাটো অভিমানে আমি রেললাইনের উপরে চলে যেতাম। মালিবাগ রেললাইন। আমি আর আমার কুকুর। হাটতাম। আমি যেখানে যেতাম লুলু সেখানে যেতো। আমি আত্মহ্যা করলে লুলুর কি হবে এটা ভেবে অনেক কস্ট পেতাম। লুলু আমার থেঁৎলানো লাশের পাশে বসে অব্যক্ত বেদনা সহ্য করবে। অপেক্ষা করবে আমার উঠে দাঁড়াবার। আমার সাথে ঘরে ফিরে যাবার।

আত্মহত্যা শব্দটি পড়ে প্রথমে আমার শৈশব, কৈশর মনে আসে।  যখন আমার কোন সমস্যা ছিলনা তখন আমি আত্মহত্যার কথা ভাবতাম। যখন আমি সমস্যার সাগরে ভেসেছি বা ভেসে আছি বা ভাসমান তখন কোনদিন আত্মহত্যার কথা ভাবিনি। কেনো ভাবিনি? আত্মহত্যা থেকে লড়াইয়ে মোড় নিতে আমাকে সাহায্য করে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি। এই দলের যোগ দিয়ে আমি জীবনকে ভালবাসতে শিখি। জীবনকে শ্রদ্ধা করতে শিখি।মানুষকে ভালবাসতে শিখি। মানুষকে শ্রদ্ধা করতে শিখি। ন্যায়, অন্যায়, সত্য, মিথ্যা, আবেগ, ভালবাসা, স্বপ্ন আর বাস্তবতার পার্থক্য নির্ণয় করতে শিখি। আমি আমার “আত্মহত্যা” প্রবণতা থেকে ফিরে আসি। আমি আমার ইচ্ছাশক্তিকে আরো শক্তিশালী করতে শিখি। যা কিছু ঠিক না সেইসব কিছু ঠিক করার জন্য মনকে শক্ত করি। সমস্যার কাছে পরাজিত না হয়ে, সমস্যার কাছে আত্মসমর্পন না করে, সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই ও সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার মত শক্তিশালী মন তৈরি করি। অনেক সমস্যাই আমি সমাধান করতে পারিনি। পারিনি কারণ এইসব সমস্যা সমাধানের উপায়গুলো আমার নিয়ন্ত্রনের বাইরে ছিল। সেটা আমার দোষ না। আমি চেস্টা করেছি। সৃষ্টির সবকিছুই মূল্যবান। সবকিছুরই উপযোগীতা আছে। আর আছে কিছু জিনিষ যা সৃষ্টির সৌন্দর্যকে ধংস করার জন্য লেগে আছে। বিশ্বাস ধ্বংস করে। আবেগ ধ্বংস করে। ভালবাসা ধ্বংস করে। বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে ধ্বংস করে দেয়।

সুমীর ফেসবুক প্রফাইলের নীচে একটা ছবিতে থেমে গেলাম। কারুকে না জানিয়ে হঠাৎ সুমি বিয়ে করেছে। খুব সুন্দর করে সেজেছে। সুমির বর দেখতে স্বাভাবিক চশমা পড়া একটি ছেলে। সুমীর বিয়ের ছবির নীচে অনেক মন্তব্য। বন্ধুরা, পরিচিতরা মন্তব্য করেছে। বিয়েতে দাওয়াত পাইনি সেজন্য। সুমির অনেক অনেক ছবি দেখলাম। সুমীর চোখে অনেক কথা । অনেক অভিমান। অনেক কিছুই সুমী বলতে পারেনা। সব না বলা কথা তার ছবিতে আটকে রেখেছে। আমি এখানে সুমির ছবি পোস্ট করছিনা। করছিনা কারণ সুমী নেই। সুমি আমাকে অনুমতি দেয়নি তার ছবি পোস্ট করার জন্য। অনুমতি ছাড়া তার ছবি পোস্ট করার কোন অধিকার আমার নেই। আমি সুমিকে চিনতাম না। চিনলেও জানতাম না সে কেনো আত্মহত্যা করেছে। কোন মানুষ কোন মানুষের মনের কথা জানতে পারেনা।

আত্মহত্যা করতে অনেক সাহসের দরকার হয়। আমি বুঝতে পারি সুমির কস্টগুলো সুমির বেঁচে থাকার ইচ্ছার উপরে ক্ষমতায়ন করে। কস্টগুলো জয়ী হয়। বেঁচে থাকার ইচ্ছে পরাজিত হয়। আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যা পাপ। পাপ আর পূন্যের প্রশ্নে যাবোনা। ভাল লাগছেনা। আমরা অনেক পাপ করি ।নিজের অজান্তে। বুকের ভেতরে ব্যাথার পাহাড় জমা হলে বেঁচে থাকার ইচ্ছা সেই পাহাড় অতিক্রম করতে পারেনা। তখন মানুষ মনে করে তাঁকে কেউ ভালবাসেনা। তাকে কেউ চায়না। তাঁর জীবনের কোন মূল্য নেই। বেঁচে থেকে কি হবে! তাই সে চলে যায়। কোথায় যাচ্ছে আর কেনো যাচ্ছে আর কিছুদিন পরে এমনিতেই চলে যেতে হবে এইসব আর ভেবে দ্যাখেনা । অভিমান জয়ী হয়। ব্যাথারা সবাই জয়ী হয়। বেঁচে থাকার ইচ্ছা মুখ থুবরে পড়ে । সে চলে যায়। চলে যায়, কোথায় যাচ্ছে তা না জেনেই।

বাংলাদেশে প্রতিদিন মানুষকে হত্যা করা হয়। প্রতিদিন মানুষকে নির্যাতন করা হচ্ছে। অনাহারে মানুষ মরে যাচ্ছে। ধর্ষন করে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। মৃত্যু এখন অনেক বেশী পরিচিত শব্দ। বাংলাদেশে জীবন পরাজিত। বারে বারে পরাজিত। জীবন ল্যাঞ্ছিত। জীবন মুল্যহীন। বাংলাদেশ এখন একটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। শিক্ষা প্রতিষ্টানগুলোতে রাজনৈতিক হত্যা লেগেই আছে, ব্যবসায়ীরা খাদ্যে বিষ মিশিয়ে ক্রেতাদের হত্যা করছে, হাসপাতালে ভুয়া ডাক্তাররা চিকিৎসার নামে মানুষ হত্যা করছে, খাদ্যের ওভাবে বাবা ছেলেকে ফেলে দিচ্ছে ব্রীজের উপর থেকে, বৈভব কিনবে বলে নিরীহ মানুষকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ভুয়া মামলা দিয়ে টাকার জন্য ব্ল্যাকমেইল করছে। জীবনের চাইতে গাড়িবাড়িগহনাআসবাবপত্র অনেক “মূল্যবান”। মানূষের জীবন ছাড়া আর বাকী যা কিছুই আছে সেইসব কিছুই অনেক “মূল্যবান”। সেসব দিয়ে কি হবে যদি জীবন না থাকে?

সেখানে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়াটা নিছক ভুল সিদ্ধান্তের মত মনে হয়। বেচে থাকার ইচ্ছাশক্তি পরাজিত হয়ে গেছিল। আমার মনে এখন সুমির মুখ ভেসে উঠছে। সুমির প্রফাইল থেকে চলে এলাম। সুমিকে কেউ ভালবাসেনি। তাই সুমি জীবনকে ভালবাসেনি। দুঃখরা সাহস জুগিয়েছে। বেঁচে থাকার ইচ্ছাশক্তি হেরে গেছে। সুমি আত্মহত্যা করেছে।

টুটুল লিখেছে – আবার দেখা হবে । হ্যাঁ হবে । আবার দেখা হবে। এমন অনেক সুমি আছে বাংলাদেশে । এমন অনেক সুমি আছে সাড়া বিশ্বে। যারা সহজেই সমস্যার কাছে হেরে যায়। সমস্যার কাছে আত্মসমর্পন করে। সব সমস্যার সমাধান আছে। সেই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। নতুন নতুন কৌশলে সমস্যার সাথে লড়াই করতে হবে। সমস্যাকে পরাজিত করতে হবে। সবার জীবনে সমস্যা আছে। সব দেশে সব কালে সব ঘরে সব সড়কে সমস্যা আছে। সমস্যা হলো চ্যালেঞ্জ। যদি চ্যালেঞ্জ না থাকে তাহলে বুঝবো কিভাবে বেঁচে আছি? চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হবে নিজের ভেতরে সুপ্ত প্রতিভা কাজে লাগিয়ে। সবাই প্রতিভা নিয়ে জন্ম নেয়। আবেগ আর ভালবাসাকে শক্তি হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। আমাকে যদি কেউ ভাল না বাসে সেটা যে ভালবাসছেনা তার সমস্যা। আমার সমস্যা নয়। আমি তো ভালবাসি। যে নিজেকে ভালবাসে সে অন্যকে ভালবাসে আর যে ভালবাসে সে অপেক্ষা করে, অপেক্ষা করে প্রকৃতির হাত ধরে চলে যাবার। যে আমাকে ভালবাসেনা সে নির্বোধ । একজন নির্বোধের কারণে আমি নিজের বুদ্ধিগুলোকে হত্যা করতে পারিনা। জীবন সুন্দর। জীবন একটাই । জীবন সংক্ষিপ্ত। এই সংক্ষিপ্ত ও সুন্দর জীবন যেকোন সমস্যার চাইতে অনেক বড় অনেক শক্তিশালী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.