আমিরাতের রুদ্ধ শ্রমবাজারে সুখবর নেই!

কামরুল হাসান জনি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরব আমিরাতে রাষ্ট্রীয় সফরের প্রায় আট মাস কেটে গেলেও বন্ধ শ্রমবাজার নিয়ে নেই কোন সুখবর। দেশীয় শ্রমিকের অভাবে বছরের পর বছর ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা ক্রান্তিকালে বসে সুদিনের অপেক্ষা করছেন!

২০১২ সালের আগস্টে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ভিসা বন্ধ হলেও গত বছরের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে দেখা দেয় ভিসা খোলার দারুণ সম্ভাবনা। রাষ্ট্রীয় এ সফরকে ইতিবাচক ও শেষ ভরসা হিসেবেও বেশ গুরুত্বের সাথে দেখছিলেন প্রবাসীরা। বাস্তবে এ বিষয়ে হয়েছে সামান্যতম অগ্রগতি! মিলেছে বাংলাদেশ থেকে আমিরাতে ১ হাজার নারীকর্মী নেয়ার প্রতিশ্রুতি। এছাড়া আমিরাত সরকারের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা, বন্দিবিনিময় এবং ঢাকায় ইউএই দূতাবাস নির্মাণে জমি হস্তান্তর বিষয়ে স্বাক্ষরিত হয়েছে তিনটি চুক্তি। কিন্তু বাংলাদেশের রুদ্ধ শ্রমবাজার উন্মুক্ত করে দেয়ার ব্যাপারে হয়নি কোনো অগ্রগতি।

প্রধানমন্ত্রীর সফরের আট মাসেও মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম এই শ্রমবাজার খোলার বিষয়ে সুসংবাদ না পাওয়ায় প্রবাসীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ বলছেন, ‘ভিসা বন্ধ থাকা আমাদের বৈদেশিক শ্রমবাজারের ওপর একটি বড় আঘাত।’ আবার কেউ বলছেন, ‘অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত লোক দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করা ঠিক নয়! যারা দেশে হয়ত কোন ক্ষেত-খামারে কাজ করত এরকম ব্যক্তিকে দেখে অন্য দেশের একজন মানুষ বাংলাদেশ সম্পর্কে কেমন ধারণা নেবে!’ আবার প্রবাসীরা বলছে, ‘অনেক আশায় ছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে ভিসা খুলবে অথবা ট্রান্সফার চালু হবে। কিন্তু কিছুই হলো না, তাই চরম হতাশার মধ্যে আছি।’

তবে দুবাইয়ের বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল মাসুদুর রহমান জানান, এখনো প্রতি বছর বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে প্রায় ৫ হাজার বাংলাদেশি প্রবেশ করছেন আমিরাতে। এদের মধ্যে গৃহ পরিচালিকা, ফ্যামিলি ভিসা, আরটিএ, সরকারি সেক্টর, ডু ও ইত্তেসালাত কোম্পানিতে ক্লিনার হিসেবে আসছেন নারী শ্রমিক। এমনকি বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি নিয়েও বাংলাদেশ থেকে আসছেন নারীরা। তবে পূর্বে এক মিলিয়ন প্রবাসী আমিরাতে অবস্থান করলেও বর্তমানে ভিসা জটিলতায় কিছুটা কমে গেছে।

অন্যদিকে, ভিসা খোলার ব্যাপারে অগ্রগতি না হওয়ায় প্রবাসী ব্যবসায়ীরা দুষছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কূটনৈতিকদের। বানিয়াসস্থ আল মুনতাহা টাইপিং সেন্টারের মালিক আবছার তৈয়বী ও আবুধাবী আল কাওয়াকেব আবাইয়া সপ এর মালিক মুহাম্মদ আলী রেজা যৌথভাবে জানান, ‘এটি বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কূটনৈতিক ব্যর্থতা বলা যায়। তাছাড়া বাংলাদেশিদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য কিছু অংশ এখানে নানা অপরাধের সাথে জড়িত। সেটিও ভিসা সমস্যা সমাধানের পথে অন্তরায়। দূতাবাস যদি তাদের জন্য নৈতিক প্রশিক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করে তবে অপরাধ কমতে পারে।’

ইউএই এক্সচেঞ্জের দুবাইস্থ অফিসের বাংলাদেশ রেমিটেন্স ম্যানেজার মহিউদ্দিন মাহমুদ জানান, ‘ভিসা বন্ধের বিষয়টি বিরূপ প্রভাব ফেলেছে বাংলাদেশের শ্রমবাজার ও রেমিটেন্সের ওপর। আমি প্রবাসী চাকুরিজীবী হিসেবে বেশি বেতনে চাকরির অফার পাওয়া সত্ত্বেও ভিসা না থাকায় নতুন চাকুরিতে যেতে পারছি না। এতে আমার দক্ষতার মূল্যায়নও পাচ্ছি না। তাছাড়া বাংলাদেশি মালিকানাধীন একমালিকানা ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। কারণ, তারা মূলত বাংলাদেশি শ্রমিকের উপর বেশি নির্ভরশীল।’

রাস আল খাইমাহ কারজ সুপার মার্কেটের স্বতাধিকারী মানিক হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সফর প্রবাসীদের মনে আশার আলো জ্বালিয়েছিল। অথচ দীর্ঘ ৮ মাসের বেশি সময়েও কোন কার্যকর ভূমিকা নেই। এই ক্ষেত্রে কূটনৈতিক তৎপরতাকে দায়ী করব। বর্তমানে আমাদের শ্রমবাজার দখল করে নিচ্ছেন নেপাল, ইন্ডিয়া সহ এশিয়ার অনেক দেশ। আমরা দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপের মাধ্যমে ভিসা জটিলতা অবসানে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আর্কষণ করছি।’

ইউএই মার্কিউরি ট্রাভেল এজেন্সির মেসেঞ্জার দীল মোহাম্মদ মামুন জানান, ‘ইন্টারভিউ দিয়ে যখন চাকরিটা নিয়েছি তখন ইন্ডিয়ান ম্যানেজার বলেছিলেন এক বছর পর ৫০০ দিরহাম বেতন বাড়াবে সাথে দেবেন দেশে যাওয়ার জন্য টিকেট। কিন্তু ভিসা বন্ধ হয়ে যাবার পর আজ পর্যন্ত বেতন বাড়ানোর কোন সদিচ্ছা তো নেই বরং কাজের চাপ আগের চেয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ দ্বিগুণ বেতনে অন্য কোম্পানিতে কাজের অফার থাকলেও ভিসা জটিলতায় কোম্পানি পরিবর্তন করতে পারছি না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *