গম কেলেঙ্কারিতে সমালোচিত সরকার বহাল তবিয়তে কামরুল ইসলাম

যতই দিন গড়াচ্ছে পচা গম ইস্যু ততই বিস্তৃতি হচ্ছে। এতে সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা বেড়েই চলেছে। কেলেঙ্কারির দায়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন মহল খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের পদত্যাগ দাবি করলেও এখনও তিনি বহাল তবিয়তে।
যদিও খাদ্যমান বারবার বলে আসছেন ব্রাজিল থেকে আমদানি করা এই গমে পুষ্টিমানে কোন ঘাটতি নেই দাবি করে বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলা হলেও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বলছে ভিন্ন কথা।
আমদানি করা করা দুই লাখ পাঁচ হাজার ১২৮ মেট্রিক টন গমে কার্যাদেশের শর্ত অনুযায়ী, গমের নষ্ট দানার পরিমাণ সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ এবং শুকনো দানা ৫ শতাংশ পর্যন্ত থাকার কথা। অথচ বিসিএসআইআরের পরীক্ষায় নষ্ট গমের দানা পাওয়া গেছে ১৬ শতাংশের বেশি এবং শুকনো দানা পাওয়া গেছে প্রায় ৯ শতাংশ। প্রতি বস্তায় ৭৫ কেজি গম পাওয়ার কথা থাকলেও পাওয়া গেছে ৭১ কেজি করে।
এছড়া যাদের জন্য এই গম আমদানি সেই সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, বিজিবি, পুলিশ, আনসার, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস সবারই মনে এই গমের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকেতো এ গম নিয়ে তীব্র আপত্তিও করা হয়েছে। খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে খাদ্য অধিদফতর থেকে দেয়া চাল ও গম মোটা, দুর্গন্ধযুক্ত, নোংরা ও কাচযুক্ত উল্লেখ এ গম গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করা হয়। ফলে ব্রাজিল থেকে আমদানি করা দুই লাখ টন নিম্নমানের গম নিয়ে সরকারের অভ্যন্তরে লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথম দিকে পুলিশ-বিজিবিসহ বিভিন্ন বাহিনীর লোকদের এ গম দেয়া হলেও তাদের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে অবশিষ্ট গম গ্রামাঞ্চলে টিআর-কাবিখার কাজে ব্যবহার করার সিদ্ধিান্ত নেয় সরকার। তবে শেষ পর্যন্ত মাঠপর্যায় থেকেও এ গম তুলে নেয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। অথচ ভয়াবহতম গম কেলেঙ্কারির এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা, তাদের রক্ষায় সরকারের বিভিন্ন মহল তৎপর হয়ে উঠেছে বলে জানা গেছে।

খাদ্য অধিদফতর সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, বিজিবি, পুলিশ, আনসার, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সদস্যদের মধ্যে রেশন হিসেবে যে আটা সরবরাহ করা হয় সেগুলো সংগ্রহের দায়িত্ব এ অধিদপ্তরের। মজুত কমে আসায় গত জানুয়ারিতে দুই লাখ টন গম আমদানির উদ্যোগ নেয় খাদ্য অধিদফতর। সে অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি মাসে ইমপেক্ট ইন্টারন্যাশনাল ও ওলাম ইন্টারন্যাশনাল নামে দুইটি প্রতিষ্ঠানকে দুই লাখ পাঁচ হাজার ১২৮ মেট্রিক টন গম সরবরাহের কার্যাদেশ দেয়া হয়। কার্যাদেশের শর্ত অনুযায়ী, গমের নষ্ট দানার পরিমাণ সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ এবং শুকনো দানা ৫ শতাংশ পর্যন্ত থাকার কথা। অথচ বিসিএসআইআরের পরীক্ষায় নষ্ট গমের দানা পাওয়া গেছে ১৬ শতাংশের বেশি এবং শুকনো দানা পাওয়া গেছে প্রায় ৯ শতাংশ। প্রতি বস্তায় ৭৫ কেজি গম পাওয়ার কথা থাকলেও পাওয়া গেছে ৭১ কেজি করে। অথচ কার্যাদেশের শর্তানুযায়ী ৭২ কেজির কম থাকলে ওই গম বন্দর থেকে খালাসই করার কথা নয়। কিন্তু সরকারের প্রভাবশালী একটি মহলের চাপের মুখে অধিদফতর নিম্নমানের ও পরিমাপে কম এ গম গ্রহণ করতে বাধ্য হয় বলে সূত্র জানায়।
পচা গম ইস্যুতে সমালোচনার ঝড় উঠেছে সর্বত্র। দাবি উঠেছে খাদ্যমন্ত্রীর পদত্যাগেরও। ২০ দলীয় জোটনেত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, জনগণের প্রতি তাদের কোনো দায়িত্ববোধ নেই। তারা শুধু লুটপাটে ব্যস্ত। বিদেশ থেকে পচা গম আমদানি করছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ কেউ এই গম নিতে চায় না। এ গম কাদের খাওয়াবেন? আওয়ামী লীগের লোকদের খাওয়ান। তাদের স্বাস্থ্য এমনিতেই ভালো। আরো ভালো হবে।
পচা গম আমদানির সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে বিএনপি মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন বলেছেন, খাদ্য মন্ত্রণালয় যে পচা গম আমদানি করেছে তার সাথে জড়িতদের তদন্ত করে বের করতে হবে। খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম নিজ পদে বহাল থাকলে তদন্ত সুষ্ঠু হবে না। তাই তাকে খাদ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
সিপিবি সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ বলেছেন, সরকারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ছেয়ে গেছে, ৩০০ কোটি টাকার গম বাণিজ্য হয়েছে। এতে কামরুল সাহেব ও তার সচিব সরাসরি জড়িত। তাই খাদ্যমন্ত্রীসহ জড়িত সবার শাস্তি হওয়া দরকার। তিনি বলেন, এখন আমাদের স্লোাগান হলো ‘পচা গম খাই না, পচা সরকার চাই না’। বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেছেন, দেশে এখন দুর্নীতির প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। পচা গম যে আমদানি হয়েছে এটা এখন সবার সামনে উন্মুক্ত। কারণ পুলিশ বিজিবি এ গম খেতে চায় না। তাই খাদ্যমন্ত্রীকে এ গম খাওয়ানো দরকার।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, এখন পর্যন্ত এটা প্রমাণিত যে ব্রাজিল থেকে আমদানি করা গমের মান ভালো ছিল না। তাই খাদ্যমন্ত্রীরও উচিত ছিল স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা। এরপর যদি তদন্ত ও বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে প্রমাণ হতো যে এ ঘটনার সাথে তিনি জড়িত নন, তাহলে তিনি অনেক বেশি জনপ্রিয় হতেন। মানুষ তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করত।
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, খাদ্যের মান পরীক্ষার প্রতিষ্ঠান সার্টিফিকেট দেয়ার পর আর পরীক্ষার দরকার হয় না। এ ছাড়া আমাদের নিজস্ব পরীক্ষায় গমের পুষ্টিমান সঠিক পাওয়া যাচ্ছে। গম পচা বা খাবার উপযোগী নয় বলে যে প্রচার চালানো হচ্ছে, তা সঠিক নয়। একটি মহল সরকারকে বিব্রত করতেই গমকে ইস্যু করছে। এমন দাবি করা হয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া বিবৃতিতেও। পরীক্ষা করে পচা গমের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বলে দাবি মন্ত্রণালয়ের।
যদিও খাদ্য অধিদফতরের সরবরাহ করা গমের আটা অত্যন্ত নিম্নমানের দাবি করে ২৮ জুন পুলিশ সদর দফতর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেয়া এক চিঠিতে বলা হয়, পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা অকান্ত পরিশ্রম করার পর এসব নিম্নমানের গম ও আটা খাচ্ছে। এতে তাদের মনোবল দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর আগে পুলিশ সদর দফতর থেকে পাঠানো আরেক চিঠিতে বলা হয়, খাদ্য অধিদফতর থেকে দেয়া চাল ও গম মোটা, দুর্গন্ধযুক্ত, নোংরা ও কাচযুক্ত। পুলিশের পাশাপাশি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্য, জাতীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা অধিদফতর এবং বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিশেষ নিরাপত্তা ফোর্সেও বেসামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে কর্মরত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীসহ প্রায় ৩৩ হাজার কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঢাকা মহানগর পুলিশের রেশন স্টোর থেকে এসব গম উত্তোলন করেন বলে পত্রে উল্লেখ করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পুলিশের পক্ষ থেকে তীব্র আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে ব্রাজিল থেকে আমদানি করা পচা গমের আটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে বিতরণ বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে গ্রামাঞ্চলে টেস্ট রিলিফ (টিআর) ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে (কাবিখা) ব্যবহার করা হয় এ গম। শেষ পর্যন্ত আপত্তি আসে সেখান থেকেও। কারণ টিআর-কাবিখার বেশির ভাগ গমই খরচ হয় সরকারি দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের হাত দিয়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বরাদ্দকৃত গমের পরিবর্তে বরাদ্দপত্রই বিক্রি করে দেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এবারের গম অত্যন্ত নিম্নমানের হওয়ায় নগদ টাকায় এসব বরাদ্দপত্র কিনতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা রাজি হচ্ছেন না। এসব কারণে সারা দেশ থেকে একযোগে আপত্তি আসায় শেষ পর্যন্ত অবশিষ্ট গম প্রত্যাহার করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার।
চট্টগ্রাম বন্দরে এ গম খালাসের সময়ও এর মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তখন খাদ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) খাদ্যবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং খাদ্য অধিদফতরের নিজস্ব ল্যাবে পরীক্ষা করে তিনটি সার্টিফিকেট নেয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে, খাদ্য মন্ত্রণালয় তখন আমদানি করা গমের নমুনা না দিয়ে বাইরে থেকে নমুনা সংগ্রহ করে তার ওপর রিপোর্ট সংগ্রহ করে এবং গম খালাসের ব্যবস্থা করে। এ প্রক্রিয়ায় সব গম খালাস করলেও সর্বশেষ জাহাজের ক্ষেত্রে বাদ সাধেন নতুন করে যোগ দেয়া খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ফয়েজ আহমদ। তার হস্তক্ষেপে সর্বশেষ জাহাজের গমগুলো গ্রহণ করা হয়নি বলে জানা গেছে। পচা গম আমদানির সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে অধিদফতরের তৎকালীন মহাপরিচালক সারওয়ার খানকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে বলে অধিদফতরে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে।

আতিক/প্রবাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *