২০১৩ সালের একদিন। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ফোন করার জন্য টেলিফোনটা তুলে নিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফোন করার হেতু, বিএনপির ডাকা সহিংস অবরোধ কর্মসূচি বন্ধ করতে তাঁকে আহ্বান জানানো।
কথোপকথনটা ছিল অনেকটা এ রকম :
শেখ হাসিনা : আমরা ঝগড়া করতে চাই না।
খালেদা জিয়া : আপনি ঝগড়া করছেন।
শেখ হাসিনা : আপনি একাই তো কথা বলে যাচ্ছেন। আমাকে কথা বলতেই দিচ্ছেন না।
খালেদা জিয়া : আমি তা কেন করব? আপনি প্রশ্ন করছেন, আমি উত্তর দিচ্ছি।
শেখ হাসিনা : আমি তো কথা বলার সুযোগই পাচ্ছি না।
এই কথোপকথনকে প্যারোডির মতো মনে হয়েছে বাংলাদেশি লেখক তাহমিমা আনামের। তিনি নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, এটা পড়তে বিদ্রূপাত্মক রচনা বলে মনে হলেও আসলে বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তব চিত্র। বাংলাদেশের রাজনীতির দুই নারী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার জন্য লড়াই অব্যাহত রয়েছে।
সেই ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদটি এই দুই নারীর মধ্যেই পরিবর্তিত হচ্ছে। এই দুজনই তাঁদের বেশ কিছু কাজের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন। তবে ক্ষমতায় থাকাকালীন দুজনের বিরুদ্ধেই নির্বাচনে দুর্নীতি ও নির্বাচনে প্রহসনের অভিযোগ রয়েছে। প্রতিবারই এঁরা দুজনেই যখন বিরোধী দলে গেছেন, তখনই অপর পক্ষকে ঘায়েল করতে সহিংস আন্দোলন করেছেন।
এ বছরের শুরুতে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বাংলাদেশের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার দুই নেত্রী সম্পর্কে বলেন, ‘এরা দুজন বাংলাদেশকে দুটি যুদ্ধশিবিরে বিভক্ত করেছেন। এ কারণে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত্তি দুর্বল হয়ে গেছে এবং সুশীলসমাজ বিভক্ত হয়ে গেছে।’
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশে সহিংসতার মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষত এ বছরের প্রথম দিকে তা ভয়ানক আকার নেয়। দেশটির এখন যে অবস্থা, তাতে এখানে স্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে দেশটির বড় দুই রাজনৈতিক দলের নেত্রীর এক হওয়া প্রয়োজন। যেমনটা তাঁরা হয়েছিলেন ২০০৮ সালে। যখন তাঁদের দুজনকে রাজনীতি থেকে বিদায় জানাতে চাওয়া সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সরাতে তাঁরা একযোগে কাজ করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য হাফিংটন পোস্ট আজ বুধবার একটি প্রতিবেদন শুরু করেছে এভাবেই। ‘উই নিড টু টক অ্যাবাউট বাংলাদেশ (বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের কথা বলা দরকার)’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই দলের মধ্যে বিরোধের কারণে বাংলাদেশকে যথেষ্ট মূল্য দিতে হচ্ছে। প্রতিবেদনটিতে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ও প্রভাবশালী কিছু পত্রিকার ভাষ্যও ব্যবহার করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব হাল-এর দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রকল্পের পরিচালক ভূমিত্র চাকমা বলেন, ‘এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে উল্টো দিকে ধাবিত করছে। সে সঙ্গে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার সংস্কৃতি তৈরি করছে।’
প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতির বর্ণনা করতে বলা হয়, বাংলাদেশে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিন, অর্থাৎ এ বছরের ৫ জানুয়ারি থেকে দেশটির বড় দুটি দলের মধ্যে শুরু হয় সহিংসতা। দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে সংঘাতময় সেই নির্বাচনে জয় পেয়েছিলেন শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ। খালেদা জিয়া ও তাঁর জোট নির্বাচন বর্জন করে এবং বলে, এটি একটি প্রহসনের নির্বাচন।
সেই নির্বাচনের প্রতিবাদে এ বছরের জানুয়ারি মাসে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ডাক দিলেন লাগাতার ধর্মঘট ও অবরোধ। শেখ হাসিনাকে জোরপূর্বক ক্ষমতা থেকে সরাতে এই আন্দোলনের ডাক দিলেও সফল হননি খালেদা জিয়া।
দুই দলের মধ্যে এই সংঘাতে শতাধিক মানুষ নিহত হন। তিন মাস ধরে চলা এই আন্দোলনে গুরুতর আহত হন আরো অসংখ্য সাধারণ মানুষ। বিরোধীপক্ষের ১০ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রাজনৈতিক সংঘর্ষের ফলাফল হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অন্তত ২ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতি হয়।
দ্য ডিপ্লোম্যাট পত্রিকার একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা হয়, কয়েক দশক ধরেই হরতাল আর অবরোধ বাংলাদেশের মানুষের জীবনের জন্য সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এখন এটি গণতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় একটি পাইকারি বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
২০১৩ সালে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে পত্রিকাটি লেখে, ‘মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে বিপর্যস্ত? হরতাল ডাকুন। আদালতের রায়ে কম সাজা দেওয়া হয়েছে? হরতাল ডাকুন, আদালতের রায়কে অতিরিক্ত বা অন্যায্য বলে মনে হচ্ছে? হরতালের ডাক দিন। একই দিনে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর হরতাল নয় কেন? হরতালে হরতালে বিপর্যস্ত আপনি? ভাববেন না যে হরতাল শেষ হয়ে যাবে।’
স্বাধীনতার পর গত বছরকেই বাংলাদেশ ইতিহাসের সবচেয়ে রাজনৈতিক সহিংসতাপূর্ণ সময় বলে মন্তব্য করেছে হাফিংটন পোস্ট।
ক্রমাগত বাড়তে থাকা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকেও বাধাগ্রস্ত করছে। এখানে চিন্তার বিষয় হলো, এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে চরমপন্থী দলগুলো তাদের প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এরই মধ্যে ইসলামী চরমপন্থী দলগুলো দেশটিতে সংঘাত সৃষ্টি করতে শুরু করেছে। এ বছরের শুরুতেই ইসলামী মৌলবাদ বা অন্ধবিশ্বাসের ওপর লেখালেখি করার দায়ে তিন ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। ইসলামপন্থী জঙ্গিরাই এসব হত্যার সঙ্গে যুক্ত বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ‘দুই নারী’ এবং তাঁদের দল দুটির মধ্যে চলমান শত্রুতাকে অবাধ্য বলে মন্তব্য করেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক ডেভিড লুইস। তিনি বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক হবে না ততদিন এই দৃশ্য বদলাবে না।’ তবে এসবের পরেও এটা আশা জাগায় যে অতীতে দুটি দলই দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সহযোগিতা করার মানসিকতা দেখিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সরিয়ে একই পতাকাতলে এক হয়েছিলেন দুই নেতা। যে সরকার তাঁদের রাজনীতি থেকে বিদায় দিতে চেয়েছিল।
সেই একতাটি আরেকবার প্রয়োজন বলে মনে করছে হাফিংটন পোস্ট।