চলমান অর্থনৈতিক সংকটে গ্রিস আগামী এক সপ্তাহের জন্য দেশটিতে সব ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে। দেশটির সামগ্রিক পরিস্থিতিতে সেখানে কর্মরত ২০ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি এখন চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য হারানোর আতঙ্কে আছেন।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, গ্রিসের সংকট প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয়ে তাৎক্ষণিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আর সংকটটি প্রলম্বিত হলে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতেও ভাটার টান পড়তে পারে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘গ্রিসে ইতিমধ্যেই নতুন শ্রমিক নেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, আর যাঁরা আছেন তাঁদের অনেকেই কর্মচ্যুত হতে পারেন। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে প্রবাসী-আয়ে। আর এ সংকট প্রলম্বিত হলে তা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রপ্তানিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’
গ্রিসে বাংলাদেশিদের মালিকানায় ছোট-বড় প্রায় ২৫০টি পোশাক কারখানা রয়েছে। কারখানাগুলোতে কাজ করেন পাঁচ হাজার বাংলাদেশি। বাংলাদেশ থেকে পাওয়া ক্রয়াদেশের ওপরই মূলত এসব কারখানা চলে। মন্দা না কাটলে চাকরি হারানোর পাশাপাশি এসব কারখানার বেশির ভাগই বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন গ্রিসের প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, শুধু কর্মসংস্থান হারানো বা প্রবাসী আয় কমার চেয়েও গ্রিসের এ সংকটের বহুমাত্রিক প্রভাব আছে। গ্রিসের এ সংকট যদি ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে তা বাংলাদেশের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ।
এমনিতেই ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জুলাই-মে পর্যন্ত ১১ মাসে ইইউতে ১ হাজার ৫৩৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ বেশি। অথচ গত অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১৮ শতাংশ। দেশের মোট পোশাক রপ্তানির ৬০ শতাংশই যায় ইউরোপে। গ্রিসের কারণে ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা বাড়লে সামগ্রিক রপ্তানিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
গ্রিসের কাছে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার পাওনা আছে ৩২ হাজার কোটি ইউরো। এর মধ্যে ইইউর পাওনা ২৪ হাজার কোটি ও জার্মানির ৫ হাজার ৬০০ কোটি ইউরো। দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপির) বিপরীতে ঋণের অনুপাত ১৭৭ শতাংশ। দেশটিতে এখন বেকারত্বের হার ২৬ শতাংশ।
আর্থিক পুনরুদ্ধার (বেইলআউট) কর্মসূচি বাস্তবায়নে ঋণদাতা দেশ ও সংস্থাগুলো গ্রিসকে যে প্রস্তাব দিয়েছে, সে ব্যাপারে গ্রিসের জনগণের মতামত নিতে আগামী ৫ জুলাই গণভোট আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। বেইলআউট কর্মসূচির শর্ত মানা না-মানার ওপর নির্ভর করছে গ্রিসের ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার বিষয়টি।
দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় গত কয়েক দিনে গ্রিসের জনগণ ব্যাংক থেকে ৪০০ কোটি ইউরোর বেশি তুলে নিয়েছে। আর্থিক সংকট কাটাতে ইউরোপিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংক জরুরি তহবিল সরবরাহ করতে রাজি না হওয়ায় গ্রিস সরকার অনেকটা বাধ্য হয়েই দেশটির সব ব্যাংক বন্ধ করে দিয়েছে। এ ছাড়া এটিএম থেকে দিনে ৬০ ইউরোর বেশি না তোলার বিধানও জারি করা হয়েছে।
গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাস এক টুইটার বার্তায় বলেছেন, ‘সামনের দিনগুলোতে আমাদের ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। গ্রিসের জনগণের ব্যাংক আমানত সম্পূর্ণ সুরক্ষিত আছে।’
গ্রিসের এ সংকটের প্রভাব পড়েছে ইউরোপসহ বিশ্বের বড় পুঁজিবাজারগুলোতে। একই সময়ে অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করার চেষ্টা করায় এই অবস্থা সৃষ্টি হয়। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দামও এ কারণে কমেছে। বেড়েছে সোনার দাম।
গ্রিসে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা এ পরিস্থিতিতে কেমন আছেন, তা জানতে বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন গ্রিসের সভাপতি জয়নুল আবেদীনের সঙ্গে গতকাল সোমবার যোগাযোগ করা হয়। দেশটির রাজধানী এথেন্স থেকে টেলিফোনে তিনি বলেন, ‘গ্রিসে থাকা বাংলাদেশিসহ সব বিদেশিই আতঙ্কের মধ্যে আছেন। অনেকেই সারা রাত লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও ব্যাংকের এটিএম থেকে টাকা তুলতে পারছেন না। সামনের দিনগুলোতে কাজ ও ব্যবসা-বাণিজ্য থাকবে কি না, সেটা নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছি।’
২৫ বছর ধরে গ্রিসে বসবাস করা জয়নুল আবেদীন জানান, এখন পর্যন্ত দেশটিতে ছোট-বড় প্রায় দেড় লাখ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে তাঁর নিজের দুটি সুপারশপও আছে। কর হার বাড়তে থাকায় দেশটির পর্যটন ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে সবচেয়ে বেশি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) অনুযায়ী, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের ১১ মাসে বাংলাদেশ থেকে গ্রিসে মোট ২ কোটি ৮২ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। গত অর্থবছরে এ রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৭২ লাখ ডলার। গ্রিসে রপ্তানি পণ্যের তালিকায় আছে তৈরি পোশাক, চিংড়ি, চামড়া, খাদ্যপণ্য, পাটের সুতা ও বস্তা, পাদুকা, তামাক প্রভৃতি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় তৈরি পোশাক।
আর কদিন পরেই মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রবাসী বাঙালিরা সব সময়ই দেশে বাড়তি টাকা পাঠান। কিন্তু গ্রিসের সরকার আগামী এক সপ্তাহের জন্য ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়ায় এবার সেটি নাও হতে পারে।