ঢাকা : কয়েকদিনের ভারি বর্ষণে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র কক্সবাজার ও বান্দরবানে ঢল ও পাহাড় ধসে অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। কক্সবাজারে বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হচ্ছে।
বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফরিদপুর ও ঝিনাইদহসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। নিচু এলাকা তলিয়ে যাওয়ায় পানি ঢুকেছে বহু ঘরবাড়িতে।
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু সক্রিয় থাকায় আরও অন্তত একদিন দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভারি বৃষ্টি চলতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
প্রতিনিধিদের পাঠানো বিভিন্ন জেলায় খবর :
ভোলা : ভোলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা মনপুরায় গত ৭ দিনের টানা বর্ষণ এবং মেঘনার জোয়ারের পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বেড়ীবাঁধের বাহিরের গ্রামগুলোসহ চরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। জলমগ্ন এলাকার মানুষ বর্তমানে চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে কৃষকের ফসলি জমি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২১ জুন দুপুর থেকে মনপুরার মেঘনায় পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে তলিয়ে গেছে মনপুরার মূল ভূ-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন কলাতলীচর, ঢালচর, চরনিজাম ও চর শামসুদ্দিন। এছাড়া মূল ভূখন্ডের হাজিরহাট ইউনিয়নেরর চরজ্ঞান, চর যতিন, দাসেরহাট, সোনারচর জোয়ারে পানিতে ডুবে রয়েছে। মনপুরা ইউনিয়নের আন্দিরপাড়, পূর্ব আন্দিরপাড়, রামনেওয়াজ বাজার, লঞ্চঘাট ও ইউনিয়ন পরিষদ এলাকা পানিতে ডুবে রয়েছে। এসব এলাকার মানুষ প্রচন্ড কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। বর্তমানে তারা দুবেলা দুমুঠো খেতেও কষ্ট হচ্ছে। রমজানের এই সময়ে প্লাবিত এলাকার বাসিন্দারা খেয়ে না খেয়ে রোজা রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। বর্তমানে তাদের কষ্টের যেন শেষ নেই।
বরিশাল : টানা তিন দিন ব্যাপক বৃষ্টিপাতে বরিশাল মহানগরের নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, নগরে গণপরিবহনের চাপ তেমন একটা নেই। কিছু দোকানপাট খুললেও ক্রেতাদের উপস্থিতি কম।
শুক্রবার বন্ধের দিন হওয়ায় কর্মব্যস্ত নগরবাসী বৃষ্টির কারণে প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের হননি। দিনভর দেখা মেলেনি সূর্যের। আবহাওয়া প্রতিকূল থাকায় নদীবন্দরে রয়েছে সতর্কতা সংকেত।
বরিশাল আবহাওয়া অফিসের উচ্চ পর্যবেক্ষক আনিসুর রহমান জানান, বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত একটানা বৃষ্টিপাত হয়। এরপর কখনও মুষলধারে কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি আকারে বৃষ্টি হচ্ছে।
মহানগরে সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের পাইপ বসানোর কাজ চলছে। প্রবল বর্ষণের আর জলাবদ্ধতার সঙ্গে এ কাজ নগরের সদর রোড, বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর সড়ক, নাজিরেরপুল এলাকায় দুর্ভোগের মাত্রা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
কক্সবাজার : পাহাড়ি ঢল, ঝড়ো হাওয়ায় গাছ চাপা এবং পাহাড় ধসে কক্সবাজারে আটজন নিহত হয়েছে। এছাড়া নিখোঁজ রয়েছে দুজন; আহত হয়েছে সাতজন।
বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার দিনভর বৃষ্টিতে জেলার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়ে এক হাজারের বেশি ঘরবাড়ি এবং দুই শতাধিক চিংড়ি ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক পানিতে তলিয়ে জেলার বেশ কয়েকটি এলাকা যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
রামু উপজেলায় পাহাড়ি ঢলে ভেসে গিয়ে পাঁচজন, সেন্টমার্টিন দ্বীপে ঝড়ো হাওয়ায় গাছের নিচে চাপা পড়ে দুজন এবং কক্সবাজার শহরে পাহাড় ধসে এক শিশুর মৃত্যু হয়।
নিহতরা হলেন- ফতেখারকুল ইউনিয়নের আমতলিয়া পাড়ার হালিমা বেগম (২৭) ও দক্ষিণ বিটের জিনু মিয়া (৬০), জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের মিতারছড়া এলাকার মো. রিদুয়ান (১০), কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের উখিয়ারঘোনার আমির হোসেন (২৩) ও কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের তিথিরপাড়ার খতিজা বেগম (৩৮)।
এদিকে কক্সবাজার শহরের ঘোনাপাড়া, লাইটহাউজ ও সাহিত্যিকা পল্লীতে পাহাড় ধসে এক শিশু নিহত ও সাতজন আহত হয়েছে।
নিহত মো. আবছার (৩) ঘোনাপাড়া এলাকার নূরুল মোস্তফার ছেলে।
আহতরা হলেন- ঘোনাপাড়ার জয়নাব বেগম (১৭), মো. সাকের (২৬), আব্দুল মান্নান (২২), উম্মে জামিলা (৪৫), লাইটহাউজ এলাকার শাকেরা খাতুন (৫৫), ইসমত আরা বেগম (৯) ও সাহিত্যিকা পল্লীর মো. ইয়াছির (১০)। তাদের কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
অপরদিকে দুপুর দেড়টার দিকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের কোনারপাড়া এলাকায় ঝড়ো হাওয়ায় গাছের নিচে চাপা পড়ে এক গৃহবধূ ও তার শিশু সন্তানের মৃত্যু হয় বল সেন্টমার্টিন দ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নূরুল আমিন জানান।
সেখানে নিহতরা হলেন- কোনারপাড়া এলাকার আনোয়ারা বেগম (২৫) ও তার ছেলে জিসান (৩)।
এদিকে ভারি বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানিতে জেলার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কক্সবাজার পৌরসভার বৃহত্তর বাজারঘাটা প্লাবিত হয়ে সড়ক-উপসড়কগুলো খালে রূপ নিয়েছে। প্রধান সড়কে কোমরসমান পানি। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়েছে পানি।
বান্দরবানে ভাই-বোনের মৃত্যু
বান্দরবান শহরে টানা বর্ষণে পাহাড় ধসে ভাই-বোনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন তাদের বাবাসহ দুজন।
শুক্রবার ভোররাতে বনরূপা পাড়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে বান্দরবান সদর থানার ওসি আমির হোসেন জানান। নিহতরা হল- মো. আলিফ (১১) ও তার ছোট বোন ফারজানা মীম (৮)।
এদিকে টানা বর্ষণে পাহাড়ি ঢলে বান্দরবানের প্রধান সড়ক কেরানীহাট ও রাঙ্গামাটি প্রধান সড়কের কয়েকটি স্থান এখনও পানির নিচে তলিয়ে থাকায় সারা দেশের সঙ্গে এ পার্বত্য জেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে।
ঝিনাইদহ : ঝিনাইদহে তিনদিনের টানা বৃষ্টিতে পৌরসভার নিচু এলাকাগুলোতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
শহরের হামদো, আরাপপুর, মুরারিদহ, উপশহরসহ বিভিন্ন মহল্লার নিচু এলাকায় ঘর বাড়িগুলোতে পানি ঢুকেছে। অনেক স্থানে রাস্তার উপর হাঁটুসমান পানি ওঠায় ভোগান্তিতে পড়েছে এলাকাবাসী।
নগরবাসীর অভিযোগ, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে এ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
চাঁদপুর : টানা বৃষ্টিতে চাঁদপুর শহরের নাজিরপাড়া, গুয়াখোলা, রহমতপুর কলোনি, প্রফেসরপাড়া, বাসস্ট্যান্ড এলাকা, তালতলা, রেলওয়ে কলোনি এখন হাঁটু পানিতে তলিয়ে গেছে। ডুবে গেছে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা, দোকান ও স্কুলের মাঠ।
জলাবদ্ধতার কারণে ঘর থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন শহরের নাজির পাড়া এলাকার বাসিন্দারা।
চাঁদপুর আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক আজহার উদ্দিন জানান, শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় চাঁদপুরে ৩৫৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
ফরিদপুর : ফরিদপুরে টানা ভারি বৃষ্টিতে নিম্ন আয়ের মানুষসহ ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির মুখে পড়েছে।
অতি বৃষ্টির কারণে শহরের বড় বড় দোকান থেকে শুরু করে ফুটপাতের দোকানগুলোও ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে। শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত পুরো শহরের পথঘাট প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে।
তবে এ পরিস্থিতি উপেক্ষা করেও জীবিকার তাগিদে নিম্ন আয়ের মানুষদের বাইরে বের হতে হচ্ছে।
জেলা আবহাওয়া অফিস জানায়, চলতি সপ্তাহের শেষ তিন দিনে ফরিদপুর অঞ্চলে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে ।
ভারী বর্ষণে দুর্ভোগে রাজশাহীবাসী
মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে ঝুমবৃষ্টি হচ্ছে রাজশাহীতে। টানা পাঁচ দিন থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। রাতে হচ্ছে একটানা। দাবদাহের পর স্বস্তির বৃষ্টি তাই দেখা দিয়েছে অস্বস্থি হয়ে।
বৃষ্টির কারণে এরই মধ্যে মহানগরের নিম্নাঞ্চল জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। একদিন কাজ মিললেও বেকার থাকতে হচ্ছে দুই দিন।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়া কর্মকর্তা আনোয়ারা বেগম জানান, পাঁচ দিন থেকে রাজশাহীতে কখনও মুষলধারে কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। ২২ জুন থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত রাজশাহী মহানগরে ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
এরই মধ্যে মহানগরের নিচু এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতভর বৃষ্টিতে মহানগরের উপশহর, ষষ্টিতলা, কাদিরগঞ্জ, তেরখাদিয়া, হেতম খাঁ, রাজারহাতা, মহিষবাথান, বেলদারপাড়া, শিরোইল, ভদ্রা, গৌরহাঙ্গা, পঞ্চবটি, তালাইমারীসহ বিভিন্ন এলাকার মূল সড়কসহ অলিগলিতে পানি জমে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।
ভারী বর্ষণে তাই জনদুর্ভোগ বাড়ছেই। এর মধ্যে গ্যাস সংযোগের জন্য বর্ষা মৌসুমে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে কোনো কোনো এলাকায় সেই দুর্ভোগের মাত্রা দ্বিগুণ হয়েছে। যানবাহন চলাচলেও বিঘœ ঘটছে। কোথাও কোথাও ড্রেনের ময়লা পানির সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে।
এরই মধ্যে মহানগরের নিচু এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতভর বৃষ্টিতে মহানগরের উপশহর, ষষ্টিতলা, কাদিরগঞ্জ, তেরখাদিয়া, হেতম খাঁ, রাজারহাতা, মহিষবাথান, বেলদারপাড়া, শিরোইল, ভদ্রা, গৌরহাঙ্গা, পঞ্চবটি, তালাইমারীসহ বিভিন্ন এলাকার মূল সড়কসহ অলিগলিতে পানি জমে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।
ভারী বর্ষণে তাই জনদুর্ভোগ বাড়ছেই। এর মধ্যে গ্যাস সংযোগের জন্য বর্ষা মৌসুমে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে কোনো কোনো এলাকায় সেই দুর্ভোগের মাত্রা দ্বিগুণ হয়েছে। যানবাহন চলাচলেও বিঘœ ঘটছে। কোথাও কোথাও ড্রেনের ময়লা পানির সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে।
জনদুর্ভোগের নগরী কুমিল্লা
চলছে ঋতুরাজ বর্ষাকাল। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে প্রতিদিনই অনবরত বৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে গত কয়েকদিনে টানা বৃষ্টিপাতে জনজীবন ওষ্ঠাগত। বৃষ্টির কারণে নগরী জুড়ে খানা-খন্দকে ভরপুর রাস্তাঘাট বৃষ্টির পানিতে এখন টইটম্বুর। ফলে জন দুর্ভোগের নগরীতে পরিণত হয়েছে কুমিল্লা।
নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর এখন বেহাল দশা। রাস্তাগুলোতে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়ে প্রতিনয়িতই ঘটছে বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা।
কুমিল্লা নগরীর নজরুল এভিনিউ রোড থেকে রাণীর বাজার পর্যন্ত, রাণীরবাজার মোড় থেকে বিসিক রোড, বিসিকের ভেতরের সড়ক, বাগিচাগাঁও সড়ক, পার্ক রোড, ঝাউতলা সড়ক, উত্তর-দক্ষিণ চর্থার বিভিন্ন সড়ক, কালিয়াজুড়ি সড়ক, আলিয়া মাদ্রাসা সড়কগুলো খানা-খন্দকে ভরপুর। রাস্তাগুলোতে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
এসব সড়কগুলোতে প্রতিনিয়ত রিকশা-অটোরিকশা, মোটরসাইকেল উল্টে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়কে যানজটও নিত্য নৈমেত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকদিন টানা বর্ষণ হলেও আজ দেশের বিভিন্ন জেলায় বৃষ্টিপাতের খবর পাওয়া যায়নি। তবে গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতার। আর এতে করে জনভোগান্তি চরমে উঠেছে।