মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘যারা বৈধভাবে অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশ গিয়েও মানবপাচারের শিকার হয়েছেন তাদের দায়ভার রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। ভুক্তভোগীদের আর্থিক, মানসিক, শারীরিক সব ক্ষতির দায় সরকারকেই নিতে হবে। একইসঙ্গে জড়িত অভিযুক্ত এজেন্সিদের হাত যতই লম্বা হোক তাদের বিরুদ্ধেও সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।’
নির্যাতিতদের সমর্থনে জাতিসংঘ দিবস-২০১৫ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘অভিবাসন ও বাংলাদেশে মানব পাচার’ শীর্ষক গণশুনানীতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ সব কথা বলেন। বিদেশে পাচারের শিকার কয়েকজন ভুক্তভোগীর অংশগ্রহণে শিক্ষা স্বাস্থ্য উন্নয়ন কার্যক্রম (শিসউক) এ গণশুনানীর আয়োজন করে। ‘মানবপাচারের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স পদক্ষেপ নেওয়া হবে’ প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মিজানুর রহমান বলেন, ‘যারা বিদেশে গিয়ে মানবপাচারের শিকার হয়ে নির্যাতিত হয়েছেন, তাদের কথা শুনে ওইসব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবেন এটা প্রধানমন্ত্রীর নিকট আমাদের অনুনয়-প্রার্থনা। আমরা সুসময়ের অপেক্ষায় আছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আজ যা শুনলাম, রেজিস্টার্ড এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশ গিয়েও অনেকে মানবপাচারের চেয়ে নির্মম দাসত্বের শিকার হয়েছেন।
জড়িতদের কোনোভাবেই আইনের আওতার বাইরে রাখা যায় না।’ ড. মিজানুর রহমান সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘ভুক্তভোগীদের কথায় সরাসরি যে রাষ্ট্রদূত ও এজেন্সির কথা উঠে এসেছে এগুলো নতুন নয়। আপনারা ভিক্টিমদের বক্তব্য শুনুন। যাদের আপনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন তারা তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে কিনা বা তারা জনবিরোধী কোনো কাজে লিপ্ত কিনা আমরা এর জবাব চাই।’ ভুক্তভোগীদের শুধু ট্রাভেলিং কস্ট দিয়েই সরকার দায়ভার এড়াতে পারে না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘সকল ক্ষতিপূরণসহ তাদের পুনর্বাসনেরও সুযোগ সরকারকে নিতে হবে। আমারা দেখতে চাই সরকার সবহারা এই মানুষের সহায় হবে।’ রিক্রুটিং এজেন্সির হাত যতই লম্বা হোক না কেন তা জনগণের হাতের চেয়ে লম্বা নয়। পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে সরকারকে জনগণের সরকার বলে প্রমাণ করতে হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আগামী মাসে সর্বদলীয় সংসদীয় বৈঠক ডাকা হয়েছে। বৈঠকে আমি মানবপাচারের বিরুদ্ধে বলব। যে সব রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপতি হয়েছে সে সব বিষয়েও আমি কথা বলব।’ অনুষ্ঠানের শুরুতে রাইটস যশোর’র নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক ইরাকে মানবপাচারের শিকার ১৮০ বাংলাদেশীর বিষয়ে একটি ভিডিও প্রদর্শন করেন। ইরাকে পাচার হওয়ার বর্ণনা দিয়ে ইঞ্জনিয়ার সিদ্দিক হোসেন বলেন, ‘ইরাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল রেজানূর রহমান এই পাচার চক্রের সঙ্গে যুক্ত।’ রিক্রুটিং এজেন্সি খান টুরস এ্যান্ড ট্রাভেলস’র মাধ্যমে জর্ডান যান মিনারা বেগম। প্রায় ২ বছর পর খালি হাতে জর্ডান ফেরত মিনারা বলেন, ‘জর্ডানে দুই বছর থাকার পর আমি একদিন স্বামীর সঙ্গে কথা বলে জানাই, আমি আর থাকতে পারছি না। স্বামীর চিকিৎসা ও সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য বিদেশে গিয়েছিলাম। বেতন চাইলে বলতো তোর কোনো বেতন নাই। তোকে আমরা অনেক টাকা দিয়ে কিনে এনেছি। তারা আমাকে অনেক নির্যাতন করত।
রডের পিটুনিতে আমার পায়ের একটা রগ চিকন হয়ে গেছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না। আমার মতো কোনো মেয়ে যেন আর কারও কোনো পরিণতি না হয় সে ব্যবস্থা আপনারা নেবেন। আমার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নিন।’ ইরানে পাচারের শিকার ইসহাক তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘চাকরির জন্য তিনি প্রথমে ওমানে যান। সেখান থেকে তাকে ইরানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আটকে রেখে সেখানে আমার ওপর তারা নির্যাতন চালায়। পাচারকারীদের আমি অনেক টাকা দিয়েছি। তারপর আমি ইরানী পুলিশের হাতে ধরা দেই। পরে বাংলাদেশী এ্যাম্বাসি আমার কাছ থেকে ৬৫ হাজার টাকা নিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেয়। অথচ, ইরান থেকে দেশে আসার জন্য বিমানের ভাড়া মাত্র ২৫ হাজার টাকা।’ যে রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের পাচার করে দিচ্ছে এ সব এজেন্সির মালিকদের শাস্তি হবে কিনা কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চান ইসহাক। গণশুনানী অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন শিসউকের নির্বাহী পরিচালক সাকিউল মিল্লাত, আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ডেপুটি এটর্নি জেনারেল মোতাহের হোসেন সাজু প্রমুখ।
আতিক/প্রবাস