ঢাকা: বেতন চাইলেই ওরা বলতো, তোর কোনো বেতন নাই। তোকে আমরা অনেক টাকা দিয়ে কিনে এনেছি। ওরা আমাকে অনেক নির্যাতন করতো। রডের পিটানিতে আমার পায়ের একটা রগ চিকন হয়ে গেছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারি না। আমার মত আর কোন মেয়ের যেন এমন পরিণতি না হয় সে ব্যবস্থা আপনারা নেবেন। আর ক্ষতিপুরণ পেলে আমার খুব উপকার হয়।
স্বামীর চিকিৎসা ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে রিক্রুটিং এজেন্সি খান ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস এর মাধ্যমে জর্ডান যান মিনারা বেগম। প্রায় ২ বছর পর খালি হাতে জর্ডান থেকে ফেরত আসা অসুস্থ মিনারা কান্নাভরা চোখে এভাবেই শোনালেন তার জীবনের করুণ কাহিনী।
নির্যাতিতদের সমর্থনে জাতিসংঘ দিবস-২০১৫ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে আয়োজিত ‘অভিবাসন ও বাংলাদেশে মানব পাচার’ শীর্ষক গণশুনানিতে মিনারা বেগমের মতো ইরানে পাচারের শিকার ইসহাক জানান, চাকরির জন্য তিনি প্রথমে ওমান যান। সেখান থেকে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ইরানে। যেখানে আটকে রেখে তার উপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন।
নির্যাতনের মৃত্যুযন্ত্রনা থেকে ফিরে আসা ইসহাক বলেন, ‘ইরানে আটক থাকা অবস্থায় আমি পাচারকারীদের অনেক টাকা দিয়েছি। কিন্তু তাতেও কাজ না হলে অবশেষে কৌশলে ইরানি পুলিশের হাতে ধরা দেই। পরে বাংলাদেশি অ্যাম্বাসি আমার কাছ থেকে ৬৫ হাজার টাকা নিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেয়।’
তার অভিযোগ- ইরান থেকে দেশে আসার জন্য বিমানের ভাড়া ২৫ হাজার টাকা মাত্র। তাহলে কেন সর্বস্ব হারানো এই আমার কাছ থেকে বাংলাদেশি অ্যাম্বাসি এত টাকা নিয়েছে?’ তাদের মতো মানব পাচার করা এজেন্সির মালিকদের শাস্তি হবে কিনা? কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চান ইসহাক।
শুনানিতে উপস্থিত মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান এ সময় বলেন, ‘যারা বৈধভাবে অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশ গিয়েও মানবপাচারের শিকার হয়েছেন তাদের দায়ভার রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। ভুক্তভোগীদের আর্থিক, মানসিক, শারীরিক সব ক্ষতির দায় সরকারকেই নিতে হবে। জড়িত অভিযুক্ত এজেন্সিদের হাত যতোই লম্বা হোক তাদরে বিরুদ্ধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।’
বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া কয়েকজন ভুক্তভোগীর অংশগ্রহণে এ গণশুনানির আয়োজন করে শিক্ষা স্বাস্থ্য উন্নয়ন কার্যক্রম (শিসউক)।
‘মানব পাচারের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স পদক্ষেপ নেয়া হবে’ প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘যারা বিদেশে গিয়ে মানবপাচারের স্বীকার হয়ে নির্যাতিত হয়েছেন, তাদের কষ্টকথা শুনে ওইসব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ব্যবস্থা নিবেন, এটাই আমাদের চাওয়া। আমরা সেই সুসময়ের অপেক্ষায় আছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘শুনানিতে যা শুনলাম তাতে স্পষ্ট যে, রেজিস্টার্ড এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশ গিয়েও অনেকে মানব পাচারের চেয়েও নির্মম দাসত্বের স্বীকার হয়েছেন। জড়িতদের কোনো ভাবেই আইনের আওতার বাইরে রাখা যায় না।’
সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ভুক্তভোগীদের কথায় সরাসরি যে রাষ্ট্রদূত, এবং এজেন্সির কথা উঠে এসেছে এগুলো নতুন নয়। আপনারা ভিক্টিমদের বক্তব্য শুনুন। যাদেরকে আপনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন তারা তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে কিনা বা তারা জনবিরোধী কোন কাজে লিপ্ত কিনা আমরা এর জবাব চাই।’
ভুক্তভোগীদের শুধু ‘ট্রাভেলিং কস্ট’ দিয়েই সরকার দায়ভার এড়াতে পারে না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘সবধরনের ক্ষতিপুরণ প্রদানসহ তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্বও সরকারকে নিতে হবে। আমরা দেখতে চাই সরকার সর্বস্ব হারানো এই মানুষগুলোর সহায় হবে।’ রিক্রুটিং এজেন্সির হাত যতই লম্বা হোক না কেন জনগণের হাতের চেয়ে লম্বা নয়। তাই পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে সরকারকে জনগণের সরকার বলে প্রমাণ করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন ড. মিজানুর রহমান।
পাশাপাশি আগামী মাসের সর্বদলীয় সংসদীয় বৈঠকে মিজানুর রহমান মানব পাচারের বিরুদ্ধে কথা বলবেন এবং যেসব রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপতি হয়েছে সেসবও উপস্থাপন করবেন বলে এ সময় উপস্থিতিকে আশ্বস্ত করেন তিনি।
অনুষ্ঠানের শুরুতে রাইটস যশোর-এর নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক ইরাকে মানব পাচারের শিকার ১৮০ বাংলাদেশির বিষয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করেন। ইরাকস্থ বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল রেজানূর রহমান এই পাচার চক্রের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ ওঠে এই গণশুনানিতে।
এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন, শিসউকের নির্বাহী পরিচালক সাকিউল মিল্লাত, আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ডেপুটি এটর্নি জেনারেল মোতাহের হোসেন সাজু প্রমুখ।