শিক্ষার উদ্দেশ্য ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে

শেখ জাহিদুজ্জামান

শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য নিজেকে জানার সঙ্গে বিশ্বকেও জানা। কিন্তু ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী হয়ে পড়ছে ছন্দহীন। শিক্ষার উদ্দেশ্য হয়ে পড়ছে অর্থহীন। আজকাল বিষয়ভিত্তিক ক্ষেত্রে জ্ঞানার্জন করে জীবন ধারণের সুযোগ হয় না। অথচ যেখানে জ্ঞানার্জন করতে হবে নিজেকে জানার জন্য। আজ সেখানে জ্ঞান অর্জন শব্দটি যেন মুমূর্ষ।

একটা সময় ছিল যখন মেধাবীদের অনেক পড়ালেখা করতে হতো। কিন্তু পড়ালেখা এখন আর মেধা নয়, বাণিজ্য হয়ে গেছে। আসলে শিক্ষা বলতে সাধারণত আমরা কি বুঝি? শিক্ষা বলতে সাধারণত আমরা জ্ঞান অর্জনকেই বুঝে থাকি। কিন্তু আজ আর শিক্ষাকে শিক্ষা বলা যায় না এটি হয়েছে একটি বাজার। যে বাজার থেকে অর্থের বিনিময়ে কেনা যায় শিক্ষা। আপনারা হয়ত ভাবছেন বাজার হতে অর্থের বিনিময়ে কি শিক্ষা ক্রয় করা যায়। হ্যাঁ যায়। কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ শিক্ষার নামে বাণিজ্যের ফাঁদ পেতে বসেছে। খাবার দিয়ে মাছ কে যেমন লোভ দেখানো হয়। আর সেই লোভের ফাঁদে যখন মাছ পা দেয় ঠিক তখন সেই মাছের অবস্থা যেমন হয়। আজ আমাদের শিক্ষার্থীদের অবস্থা ঠিক তেমনি বলা যায়।

আর এসব শিক্ষাঙ্গনগুলোতে না আছে ভাল শিক্ষার পরিবেশ না আছে পর্যাপ্ত সংখ্যক ভাল শিক্ষক। একজন শিক্ষক যদি না শেখায় একজন শিক্ষার্থীর শেখাটা কখনো সহজ হয় না। শিক্ষক উন্নতমানের হলে তাঁর ছাত্ররাও উন্নতমানের হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। তবে শিক্ষককে শুধু ভাল হলেই হবে না তাঁকে তাঁর শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় না। একজন শিক্ষকের বড় চ্যালেঞ্জ তাঁর ছাত্রদের আজীবন জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণ করতে উদ্বুদ্ধ করা। সেটি বর্তমানে ভাবাই অতীত।

গণমাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চটকদার বিজ্ঞাপন ও রাস্তার ওলিতে গলিতে বিল বোর্ডের চিত্র কমবেশি সবারই চোখে পড়ে। কিন্তু ভাবার বিষয়! শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো বিজ্ঞাপন কিংবা বিলবোর্ডের প্রয়োজন আছে কি না? সেটা আমার বোধগম্য নয়। যেখানে জ্ঞানের আলো সরবরাহ করা বা জ্ঞান দান করা হয় সেটার কি প্রচারের প্রয়োজন আছে? সেটারই প্রচারের প্রয়োজন আছে যেটা ব্যবসা কেন্দ্রিক। শিক্ষা তো আর বাণিজ্য নয়। তাহলে প্রশ্ন থাকতেই পারে শিক্ষা আজ কেন বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে।

আর এসব চটকদার বিজ্ঞাপন দেওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর চিত্র চোখে পড়ারই মতো। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম চলছে মূলত একটি ভবণের কয়েকটি রুম ভাড়া নিয়ে। আর রাজধানীর অভিজাত এলাকায় গড়ে ওঠা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেলে প্রথমত যেকারোরই দৃষ্টি কেঁড়ে নেয়। কেননা সৌন্দর্যখচিত ভাবেই এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সময় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিভিন্ন সেবা দেওয়ার কথা বললেও পরবর্তীতে চোখে মেলে ভিন্নতা। প্রতিটি সেবার বিনিময়ে গুনতে হয় কাড়ি কাড়ি অর্থ। আর অর্থছাড়া এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেবা পাওয়ার চিন্তা করা আকাশ-কুসুম ছাড়া কিছুই নয়।

অথচ দেশের অনেক নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন কিংবা বিলবোর্ডের প্রয়োজন হয় না। কেননা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক শিক্ষার্থী একেকটি বিজ্ঞাপন ও বিলবোর্ড। এখন প্রশ্ন থাকতেই পারে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যদি বিজ্ঞাপন ও বিলবোর্ড হয়ে থাকে । তাহলে গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কেন বিজ্ঞাপন বা বিলবোর্ড হতে পারে না। এই জন্য হতে পারছে যে, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের নিকট হতে কাড়ি কাড়ি অর্থ নিলেও তাদেরকে প্রকৃত জ্ঞান দানে ব্যর্থ হচ্ছে।
এদিকে আমরা মনে করি, যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নজরকাড়া কিংবা চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন গণমাধ্যমে প্রচার হয় না সেগুলো মান সম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। আবার কিছু কিছু অভিভাবক মনে করেন, শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত ক্লাস রুম ও সুন্দর পরিপাটি ভাবে সাজানো প্রতিষ্ঠান-ই মান সম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আজ নিজেকে বড়ই অসহায় মনে হয়। আমাদের ভাবনা, চিন্তা-চেতনা আজ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে সেটাই আজ ভাবার বিষয়?

আর এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জন করানো হয় মুখস্তকরনের মাধ্যমে। তাইতো আমাদের এই মুখস্ত বিদ্যা সর্ম্পকে রবীন্দ্রনাথ দুঃখ করে বলেছেন, ‘যে ছাত্র পকেটে করে নকল নিয়ে পরীক্ষার হলে ঢোকে তাকে তোমরা হল থেকে খেদিয়ে দাও, আর যে মগজের ভেতর চুরি করে নিয়ে ঢোকে তাকে তোমরা শ্রেষ্ঠ ছাত্রের সম্মান দাও, এ কেমন শিক্ষাব্যবস্থা।’ আর একটি প্রাচীন প্রবাদ আছে,‘তুমি যদি কাউকে ১ কেজি মাছ দাও তাহলে তার ১দিনের আহারের ব্যবস্থা করলে, আর যদি কাউকে মাছ ধরতে শিখিয়ে দাও তাহলে তুমি তার সারা জীবনের খাবারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করলে।’
তাইতো পণ্ডিত নেহেরু বলেছিলেন, ‘আগামী দিনের ভারত কেমন হবে, তা নির্ধারিত হবে শ্রেণি কক্ষসমূহে।’ আসলে অঢেল টাকা ঢেলে যে মেধা বাড়ানো যায় না, সেটি আজ আমাদের অভিভাবকদের কেবা বোঝাবে?

শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় প্রাণের স্পন্দন জাগে না। শিক্ষা আনন্দময়, আনন্দঘন, নিজের জীবনের জন্য প্রয়োজন। মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষাকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। জীবনমুখি ও কর্মমুখি শিক্ষার মাধ্যমে যেমন দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি করা সম্ভব। তেমনিভাবে ‘শিক্ষা একটি গাছের মত যা একবার লাগালে তা হতে ফুল, ফল আর অক্সিজেন পাওয়া যায় সারা জীবন। মনে হয় একথাটি আমরা ভুলেই গেছে। আমরা ছুটেই চলেছি শিক্ষার পেছনে কিন্তু প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের পেছনে নয়।

অথচ আজকের পৃথিবীতে ইউরোপের দেশগুলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এশিয়ার চীন, জাপান, কোরিয়া, মালয়েশিয়া উন্নতি লাভ করেছে জীবনমুখি শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমেই। আর আমরা দিন দিন শিক্ষাকে বাণিজ্যকরণ করে দেশকে পিছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছি।

তাইতো রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘জীবন যেমন হওয়া উচিত, শিক্ষাও তেমন হওয়া উচিত।’ জীবন ও শিক্ষা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তাই জীবনের চাহিদা মেটাতে সক্ষম সেরকম শিক্ষা চাই।

আর এখন সবার কাছেই জিপিএ-৫ মুড়ি-মুড়কি। এই তথাকথিত সর্বোচ্চ ভালো ফলাফলের সার্টিফিকেট নিয়ে সবাই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেও পরবর্তীতে উচ্চতর শিক্ষা কিংবা কর্মক্ষেত্রে গিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। এতে একদিকে যেমন শিক্ষার সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জাতি, অন্যদিকে সমৃদ্ধ সার্টিফিকেট অর্জন করেও চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয় আমাদের তরুণ-তরুণীদের।
শিক্ষাকে বাণিজ্যকরণ না করে কিভাবে আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা লাভ করতে পারে সেলক্ষে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আর শিক্ষামন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে,শিক্ষা কি বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে। আর যদি বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ততা চান তাহলে এদেশে মানসম্মত শিক্ষার্থীর নামে সার্টিফিকেটধারী শিক্ষার্থীর জন্ম হবে।
শিক্ষায় জাতিকে উন্নয়ন ঘটাতে পারে। এর মাধ্যমে মানুষকে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে আলোকিত জীবন গঠনের পথ প্রশস্ত করে। উন্নত শিক্ষা আলোকিত মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়।

লেখক: সাংবাদিক এবং কলামিস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.