খেলার মাঠেই সারা দিন পড়ে থাকত ছোট্ট ছেলেটি। লিকলিকে পা নিয়ে যখন বল করতে দৌড়াত; দেখে মনে হয় যেন তালপাতার সেপাই। গ্রামের স্কুলে ধুলোকাদায় খেলতে খেলতে ছোট্ট ছেলেটিই যে একদিন বাংলাদেশের হয়ে ভারতবধের নায়ক হয়ে উঠবে, তা কি ভেবেছিল কেউ?
না ভাবলেও লিকলিকে পায়ে দৌড়ানো সেই মুস্তাফিজুর রহমানই হয়ে উঠলেন ইতিহাসের অংশ। বৃহস্পতিবার অভিষেক ম্যাচেই তাঁর দাপুটে বোলিংয়ের সামনে দাঁড়াতেই পারল না বিশ্বক্রিকেটের অন্যতম পরাশক্তি ভারত।
মুস্তাফিজের বড় ভাই মোখলেছুর রহমান পল্টু জানান, ১২ বছর বয়স থেকে প্রতিদিন ভোরে জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত তেঁতুলিয়া গ্রাম থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে মোটরসাইকেলে করে মুস্তাফিজকে নিয়ে তিনি যেতেন সাতক্ষীরায়। সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামে অনুশীলন শেষে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যেতেন বাড়িতে। পথশ্রমে ক্লান্ত মুস্তাফিজ ভাইকে জড়িয়ে মোটরসাইকেলে ঘুমিয়ে পড়তেন। পড়ে যাওয়ার ভয়ে ভাইয়ের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে রাখতেন।
‘আমার গাঁয়ের ছেলে মুস্তাফিজ ভারতকে হারিয়েছে’ বৃহস্পতিবারের পর থেকে এই আনন্দে একাকার কালীগঞ্জের তেঁতুলিয়া গ্রামের মানুষ। ওই দিন ম্যাচজয়ের পরই ঢোল বাজিয়ে, মিছিল করে আর আতশবাজি পুড়িয়ে গ্রামময় আনন্দের বন্যা বইয়ে দেন তাঁরা। আজ শনিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উচ্ছ্বাস এতটুকু কমেনি গ্রামবাসীর।
সহপাঠী বন্ধুরা জানান, স্বভাবে শান্তশিষ্ট মুস্তাফিজ সব সময় ভালো খেলতেন। কিন্তু এত ভালো খেলোয়াড় যে হতে পারেন তা ছিল কল্পনারও বাইরে। বরেয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হাফিজুর রহমান জানান, মুস্তাফিজের লেখাপড়ার দিকে তেমন মন ছিল না। শুধু খেলা আর খেলা। এ নিয়ে অনেক বকাবকি শুনতে হলেও তাঁর এই অতি আগ্রহে এতটুকু বাধা দেয়নি তাঁর পরিবার।
২০১১ সালে বরেয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। ওই সময়েই তাঁর খেলায় মুগ্ধ হয়ে সাতক্ষীরার ক্রিকেট কোচ আলতাফ হোসেন তাঁকে বয়সভিত্তিক খেলায় অংশ নিতে নিয়ে যান।
সাতক্ষীরা জেলার হয়ে অনূর্ধ্ব-১৪ ক্রিকেট দিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে প্রবেশ তাঁর। এরপর বিভাগীয় অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৮ অবশেষে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলে বারবার নিজেকে প্রমাণ করেছেন মুস্তাফিজ।
অনূর্ধ্ব-১৬ দলে খেলার সময় প্রথম খুলনা বিভাগীয় দলে স্থান পান তিনি। অনূর্ধ্ব-১৮-তে খেলার সময় আবার তাঁর ডাক পড়ে বিভাগীয় দলে। ২০১৪ সালে বিভাগীয় লিগে তিনি ম্যান অব দ্য সিরিজ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এরপর জাতীয় লিগে খুলনা বিভাগের হয়ে দুই বছর খেলেন মুস্তাফিজ।
সাতক্ষীরা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শেখ নিজামউদ্দিন বলেন ‘দেশ সেরা নারী ফুটবলার সাবিনা ছিলেন সাতক্ষীরার গৌরব। তাঁর পায়ের জাদুতেই সাতক্ষীরার নাম আন্তর্জাতিক ময়দানে ছড়িয়েছে। আর গত বিশ্বকাপে সৌম্য সরকার বয়ে এনেছে বিজয়ের গৌরব। আর মুস্তাফিজ ভারত বধ করে সাতক্ষীরাকে আরো এক ধাপ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করলেন।’
চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে মুস্তাফিজুর সবার ছোট। বাবা আবুল কাসেমসহ পরিবারের সবাই তাঁর ক্রিকেট নৈপুণ্যে যারপরনাই খুশি। বাবা এনটিভি অনলাইনের মাধ্যমে ছেলের জন্য দোয়া চেয়েছেন। মোখলেছুর রহমান পল্টু বলেন, ‘আমার ভাইয়ের খেলায় আমার পরিবার থেকে নিজ গ্রাম, নিজ শহর সবাই আনন্দে ভাসছে।’ সবার সহায়তায় এই হাসি ধরে রাখতে হবে মন্তব্য করে পল্টু আরো বলেন, ‘বিশ্বের আরো বড় বড় দলকেও হারাতে হবে তাকে। আপনারা সবাই দোয়া করবেন।’