সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে ভোগ্যপণ্যের বিকিকিনি বেড়ে যায় এবং অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয় ব্যাপক চাঞ্চল্য।
সে হিসেবে বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচাইতে বড় উৎসবের মৌসুম হচ্ছে রমজান পরবর্তী ঈদুল ফিতর। এই সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পোশাক বাজারে ব্যাপক চাহিদা ও যোগান দেখা দেয়। এছাড়া কিছু বিশেষ খাদ্য পণ্যের বাজার, নানা ধরণের বিনোদন, পরিবহণ সেবা ইত্যাদিও থাকে বেশ চাঙ্গা। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রমজান মাসের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে নি:সন্দেহে। কি সেই ভূমিকা?
এ নিয়ে বিবিসি একটি প্রতিবেদন করেছে।
সরেজমিন পোশাক বাজার:
ঢাকার পুরনো অংশে সদরঘাট সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদীর দু’ধার এখন বেজায় সরগরম।
নদীর ওপারে কালীগঞ্জ এবং এপারে সদরঘাটে রয়েছে বাংলাদেশের বৃহত্তম তৈরি পোশাকের পাইকারি বাজার।
হাজার হাজার দোকান রয়েছে দুপাশের অগুনতি মার্কেট জুড়ে। এখানকার তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য নয়, স্থানীয় চাহিদা পূরণের জন্য।
সারা বাংলাদেশের খুচরা পোশাক বিক্রেতারা এখান থেকেই মূলত তাদের পণ্য সংগ্রহ করেন। নদীর এপারে হকার্স মার্কেট বলে একটি মার্কেটে আটশ’র মতো দোকান।
ঈদ অর্থনীতির সবচাইতে বড় চালিকা শক্তি হল পোশাকের বাজার। সরু গলির দুপাশে ছোট ছোট খুপরি ঘরের মতো। গলি ধরে হাঁটা যায়না এতই সরু।
এখানে গিয়ে দেখা গেল প্রচণ্ড ব্যস্ততা, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ক্রেতা আর বিক্রেতাদের হাঁকডাকে ব্যস্ত। প্রতিটি দোকান পণ্যে ঠাসা। ৭০ থেকে আশি বর্গফুটের এক একটি দোকানে রয়েছে কোটি কোটি টাকার পণ্য।
এখানে এখন ক্রেতারা হচ্ছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পোশাক দোকানগুলোর মালিকেরা।
তারা এখন থেকেই শুরু করে দিয়েছেন ঈদ উপলক্ষে বিক্রির জন্য পণ্য সংগ্রহ।
খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে বাংলাদেশে রমজানের ঈদকে কেন্দ্র করে দেশটির ফুলে ফেঁপে ওঠা অর্থনীতির একটি বড় চালিকাশক্তিই এই পোশাকের বিকিকিনি।
হকার্স মার্কেটের দোকানীরা বলছেন রমজানের ঈদই তাদের সবচাইতে বড় মৌসুম।
সারাবছর ধরেই তারা এই মৌসুমের জন্য প্রস্তুতি নেন। বছরের বাদবাকি এগারো মাস তারা যে পরিমাণ বিক্রি-বাট্টা করেন, তার দ্বিগুণ, কোন কোন ক্ষেত্রে তিনগুণ বিক্রি করেন এই এক মাসে।
ঈদ অর্থনীতির আকার:
শুধু পোশাক ব্যবসায়ীরাই নয়, রমজান এবং ঈদকে কেন্দ্র করে বিশেষ প্রস্তুতি থাকে অন্যান্য ভোগ্যপণ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য পণ্যের ব্যবসায়ীদের।
রমজান মাসে কিছু বিশেষায়িত খাদ্যপণ্য যেমন: ছোলা, চিনি, পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল ইত্যাদির চাহিদা হয়ে যায় আকাশচুম্বী।
এই সময়টাকে কেন্দ্র করে এসমস্ত পণ্যের আমদানি বেড়ে যায়, ক্ষেত্র বিশেষে দাম বৃদ্ধির প্রবণতা থাকে, এবং এটা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়।
সব মিলে সার্বিকভাবেই দেশের বাজার ব্যবস্থাপনায় দেখা যায় সাজ সাজ রব।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ বা সিপিডির গবেষক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, ‘রমজান মাসে বিশেষ ধরণের খাদ্য, পোশাক ও নানা রকম সেবার চাহিদা বাড়ার কারণে এগুলোর উৎপাদন,বিপণন এবং বিক্রির ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এসব পণ্যের চাহিদা বছরের অন্যান্য সময় এত বেশী থাকে না’। বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের শীর্ষস্থানীয় সংগঠন এফবিসিসিআই-য়ের একজন পরিচালক এবং দোকান মালিকদের নেতা মোহাম্মদ হেলালউদ্দিন বলছেন, ‘বাংলাদেশে বার্ষিক অর্থনীতির আকার প্রায় সাড়ে তের লাখ কোটি টাকা। আর শুধু মাত্র রোজার মাসেই সার্বিক অর্থনীতিতে যোগ হয় সোয়া এক লাখ কোটি টাকা’।
অবশ্য অর্থনীতিবিদেরা এই অংকের সাথে দ্বিমত পোষণ করছেন।
বাংলাদেশের ঈদ অর্থনীতি নিয়ে কোনও গবেষণারও নজির মিলছে না।
সিপিডির ড. মোয়াজ্জেম বলছেন, ‘এ সময় অতিরিক্ত অর্থনৈতিক চাঞ্চল্য তৈরি হলেও তার সুফল সার্বিক অর্থনীতিতে ততটা যোগ হয় না। কারণ এসময় একটা অতি মুনাফার প্রবণতা থাকে। মুনাফা বাঁটোয়ারা হয় অল্প কিছু মানুষের মধ্যে। আর এর প্রবণতা দেখা যায় শুধুমাত্র শহর কেন্দ্রিক’।
তবে রমজান-সহ বাংলাদেশের অন্যান্য উৎসবের মৌসুমে অতিরিক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে বলে উল্লেখ করছেন ড. মোয়াজ্জেম যেটা উৎসবের অর্থনীতির সুফল বলেই বর্ণনা করছেন তিনি।