ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে ফেনীর অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা

অস্ত্রের উৎস ও বহনের কারণ বের হওয়ার আগেই ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে ফেনীর অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা। বিশাল এই চালান উদ্ধারের সাথে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা জড়িত থাকায় শুরুতেই শেষ হয়ে গেল চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চালানটি আটক হওয়ায় অনেকটা বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় প্রশাসনের সদস্যরা; যে কারণে কোনো রকম ঘাঁটাঘাঁটি ছাড়াই বিষয়টি শেষ করতে চাচ্ছেন প্রশাসনের লোকজনও। এ দিকে নিজাম হাজারীসহ তার অনুসারীরা এ ঘটনায় র‌্যাবকে দায়ী করছে। তাদের দাবি, র‌্যাব এ ঘটনা সাজিয়েছে। র‌্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইং প্রধান মুফতি মাহমুদ খান বলেছেন, যথাযথ নিয়ম মেনেই মামলা হয়েছে এবং গ্রেফতারকৃতদের আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এখন তদন্ত করে দেখা হবে অস্ত্রের উৎস কোথায় এবং কী কাজের জন্য তা বহন করা হচ্ছিল।

গত শনিবার রাতে ফেনীতে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে বিপুল দেশী-বিদেশী অস্ত্রসহ ক্ষমতাসীন দলের ২৬ নেতাকর্মীকে আটক করে। শনিবার রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর লালপোল এলাকায় অভিযান চালিয়ে তিনটি মাইক্রোবাস থেকে ১৬টি বিদেশী অস্ত্রসহ মোট ৩২টি অস্ত্র উদ্ধার করে। উদ্ধারকৃত অস্ত্রগুলো সরকারদলীয় নেতাদের লাইসেন্সকৃত বৈধ অস্ত্র বলে দাবি করলেও র‌্যাব জানিয়েছে বৈধতার কোনো কাগজপত্র তারা দেখাতে পারেনি। আর বৈধ অস্ত্র থাকলেও একজনের লাইসেন্সকৃত অস্ত্র অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারে না। তা করতে গেলেও অবৈধ হয়ে যাবে। সেটিও ফৌজদারি অপরাধ।
স্থানীয় সূত্র জানায়, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে গত ১ জুন রাতে সোনাগাজী উপজেলা যুবলীগ নেতা আজিজুল হক খুন হন। এর প্রতিবাদে শনিবার বিকেলে সোনাগাজী বাজারের জিরো পয়েন্টে উপজেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জেলা আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতারা বক্তব্য দিয়ে সন্ধ্যায় গাড়িবহর নিয়ে ফেনী ফিরছিলেন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব লালপোলে চেকপোস্ট বসিয়ে গাড়িতে অভিযান চালায়। এ সময় র‌্যাব তিনটি মাইক্রোবাস আটক করলেও বেশ কয়েকটি গাড়ি পালিয়ে যায়।
র‌্যাব ৭-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতা উদ্দিন আহম্মেদ ওই দিন মিডিয়াকে জানান, র‌্যাব আটককৃত মাইক্রোবাসগুলো তল্লাশি করে পাঁচটি বিদেশী পিস্তল, পাঁচটি বিদেশী শটগান, চারটি বিদেশী এলজি, একটি দোনলা বন্দুক, ১৬টি রামদা, দু’টি চাইনিজ কুড়ালসহ বিপুল কার্তুজ ও গুলি উদ্ধার করে। র‌্যাব অস্ত্রবহনের দায়ে দুই মাইক্রোবাস চালকসহ ২৬ যুবককে আটক করে।
এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃতরা হলেনÑ ফুলগাজী আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও গোসাইপুর গ্রামের হাজী আলী আকবরের ছেলে জামাল উদ্দিন (৪২), ফুলগাজী উপজেলা যুবলীগ সভাপতি ও গাবতলা গ্রামের মৃত নাসির উদ্দিনের ছেলে ছালেহ আহম্মদ মিন্টু (৩৫), উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও দক্ষিণ আনন্দপুর গ্রামের ওবায়দুল হকের ছেলে এনামুল করিম রাজিব পাটোয়ারী, ফেনী পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুবক্কর ছিদ্দিক শুভ, আনন্দপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি ও ফেসিবাড়িয়ার মৃত কবির আহম্মদের ছেলে সরোয়ার হোসেন (২৯), দরবারপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি ও উত্তর শ্রীপুর গ্রামের ওহিদুর রহমানের ছেলে আবুল কাসেম বেসু (৩৫), মুন্সীরহাট ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কমুয়া চানপুর গ্রামের মৃত ওহাব মিয়ার ছেলে মো: ফরিদ (৩০), সোনাগাজীর চর সোনাপুর গ্রামের নুর ইসলামের ছেলে আবু ইউসুফ ডলার (২৫), একই গ্রামের আবদুস সাত্তারের ছেলে মইনুদ্দিন (১৯), ফুলগাজীর দক্ষিণ আনন্দপুর গ্রামের মো: ওয়াজিউল্লাহর ছেলে শফিকুল ইসলাম রিপন (২৬), একই উপজেলার পৈথারা গ্রামের মো: সাদেকের ছেলে মো: শাহাদত হোসেন (২৪), দক্ষিণ আনন্দপুরের মো: ইউসুফের ছেলে আশরাফুল ইসলাম মাসুম (২৩), একই এলাকার আবুল খায়েরের ছেলে ওমর ফারুক (২৪), আবদুল হকের ছেলে গাড়িচালক মো: আবু তাহের (৩৫), মীর হোসেনের ছেলে শাহাদাত হোসেন (২৭), কমুয়া চানপুর গ্রামের মৃত নজির আহম্মদের ছেলে রবিউল ইসলাম মানিক (২৪), হাসানপুর গ্রামের ফজলে রহমানের ছেলে ফারুক হোসেন (৩২), মাওলানা সমাজের কবির আহম্মদের ছেলে কফিল উদ্দিন সোহেল (২৮), ছাগলনাইয়ার পশ্চিম মধুগ্রামের জহিরুল হকের ছেলে এশরামুল হক সিফাত (২১), সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের মাথিয়ারার আবদুল করিমের ছেলে ইমরান হোসেন (২৬), একই এলাকার মৃত আহসান উল্লাহর ছেলে মাহবুবুর রহমান জেমি (২৫), বগইড গ্রামের ইসমাইল হোসেন খোকনের ছেলে আরাফাত হোসেন আসিফ (২৪), একই এলাকার নূর ইসলামের ছেলে মো: নোমান (২২), বাথানিয়া গ্রামের নুরুন্নবীর ছেলে মো: হাসান (২২), শর্শদী ইউনিয়নের উত্তর জাহানপুর গ্রামের মৃত আবদুল ওহাবের ছেলে ও গাড়িচালক রবিউল হক লিটন (৩৮)। এরা ফেনীর সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর অনুসারী বলে জানা যায়।
এ দিকে অস্ত্র আটকের জেরে ঘটনার পরপরই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা র‌্যাবকে ঘটনাস্থলে অবরুদ্ধ করে রাখে। তারা রাত ১০টা পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ফেনী-নোয়াখালী মহাসড়ক ও ফেনী-সোনাগাজী আঞ্চলিক সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে অবরোধ করে। তিনটি সড়কে কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় তারা। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাত ৯টার দিকে মহাসড়কে দুই প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। এর এক ঘণ্টা পর রাত ১০টার দিকে সড়কে যানচলাচল স্বাভাবিক হয়।
এ দিকে সাম্প্রতিক সময়ের অস্ত্রের এই বিশাল চালানটি উদ্ধার করেও অনেকটা বিপাকে পড়েছে র‌্যাব। উল্টো এখন তাদের দায়ী করার চেষ্টা চলছে। ঘটনার পরপরই স্থানীয় আওয়ামী লীগ-যুবলীগ নেতারা দাবি করেন ওগুলো বৈধ অস্ত্র। এসবের লাইসেন্স রয়েছে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত ওগুলোর কোনো লাইসেন্স তারা দেখাতে পারেননি বলে জানা গেছে। এ দিকে এসব অস্ত্র কী কারণে তারা ব্যবহার করছিল সে সম্পর্কে কোনো তথ্য না জেনেই পুলিশ তাদের আদালতে সোপর্দ করে। আদালতে পুলিশ গ্রেফতারকৃতদের ব্যাপারে কোনো রিমান্ডেরও আবেদন করেনি। আদালত গ্রেফতারকৃতদের জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সন্ত্রাসকবলিত এই জনপদে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এখন চরমে। গত বছর গুলি করে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামকে। ওই ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের অনেক শীর্ষ নেতাও গ্রেফতার হন। তাদের অনেকেই এখন জামিনে রয়েছেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা গ্রেফতার হওয়ায় অস্ত্র উদ্ধারের এ ঘটনাটিও ধামাচাপা পড়ে যেতে পারে। শুরুতেই সে লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ দিকে র‌্যাবের মিডিয়া উইং প্রধান বলেছেন, যথাযথ আইন মেনেই গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে এই অস্ত্রের উৎস এবং কী কাজে ব্যবহারের জন্য তা বহন করা হচ্ছিল তা তদন্তসাপেক্ষে জানা যাবে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে।
এ দিকে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে সরকারের উচ্চপর্যায়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন নিজাম হাজারী ও তার শীর্ষ অনুসারীরা। ইতোমধ্যে ঢাকায় তারা অনেকের সাথেই সাক্ষাৎ করেছেন এবং সাক্ষাতের চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। অস্ত্র উদ্ধারের ব্যাপারে গতকাল ফেনীর সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী নয়া দিগন্তকে বলেছেন, উদ্ধারকৃত অস্ত্র বৈধ এবং তার লাইসেন্স আছে।

আতিক/ প্রবাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *