রাতের বেলা অফিস থেকে ফেরার পথে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে ফয়েজের প্রচন্ড মাথা ধরেছে। প্রতিদিনই অফিসের কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে তার রাত হয়। আজকে বৃষ্টির জন্য গাড়ি পেতে দেরী হওয়াতে রাতটা একটু বেশীই হয়ে গেছে। আদা লেবু দিয়ে এক কাপ রং চা খেলে হয়ত ভাল লাগত। কিন্তু রত্নাকে চায়ের কথা বলার সাহস তার হচ্ছেনা। বিছানায় গাল ফুলিয়ে বসে আছে। এভাবে গাল ফুলিয়ে বসে থাকলে রত্নাকে মনে হয় যেন একটা গ্যাস বেলুন সুতা দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। সুতা ছিঁড়ে দিলেই বাতাসে উড়ে যাবে। আজকেও ফয়েজ ফেরার পথে হিজাব কেনার কথা ভুলে গেছে। সেই কবে থেকে রত্না তাকে হিজাব কিনে দেয়ার জন্য বলছে। কিন্তু প্রতিদিনই সে ভুলে যায় হিজাব কেনার কথা। তাছাড়া সে যখন অফিস থেকে বের হয় তখন আর মার্কেট খোলা থাকেনা। অবশ্য সে বেশ কয়েকদিনই ভেবেছে অফিস থেকে একটু আগে বের হয়ে মার্কেটে যাবে। কিন্তু তার এখনও সেই সময় সুযোগ আর করে উঠা হয়নি অফিসের কাজের চাপে।
টেলিভিশনে সিস্টার হেরার টক-শো চলছে। রত্না গভীর মনোযোগ দিয়ে সিস্টার হেরার কথা শুনছে। এমন মনোযোগ দিয়ে কোন স্ত্রী তার স্বামীর কথাও শোনে কিনা সন্দেহ আছে। এভাবে যদি কোন স্ত্রী তার স্বামীকেও পীর ভাবত এতদিনে দেশটা সুখি দম্পতীদের অভয়ারণ্যে পরিনত হয়ে যেত। এইসময়ে ডিসকভারি চ্যানেলে সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির উপর খুব চমৎকার একটা প্রোগ্রাম হয়। এইটা দেখার জন্য ফয়েজ সব সময় মুখিয়ে থাকে। কিন্তু আজকে আর সেই সুযোগ হচ্ছেনা তার। বাধ্য হয়ে শরৎ সমগ্র নিয়েই তাকে বসতে হলো। বহুবার চরিত্রহীন উপন্যাসটা সে পড়েছে। সতীশ-সাবিত্রী দুজন-দুজনকে ভালোবাসলেও তাদের মিল দেখান হয়নি। সাবিত্রী বিধবা। তার দৃষ্টিতে তখনকার সামাজিক পটভূমিতে এই প্রেম অনৈতিক। তাছাড়া সতীশের সমকক্ষ পবিত্রতা তার নেই। তার দৃষ্টিতে বিচ্ছেদের মাধ্যমে সরোজিনীর সাথে সতীশের বিয়ে দিয়ে নিজেকে মহিয়সী নারী রুপে প্রতিষ্ঠিত করা। খুব নিম্ন পরিবেশে অঙ্কিত চরিত্রগুলো মহিয়সীর রুপ লাভ করেছে শরৎ উপন্যাসে। তারপরেও সাবিত্রী চরিত্রটা তাকে খুব টানে।
বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে আধুনিক এবং সাহসী লেখক খুব সম্ভবত শরৎচন্দ্র। নারী-পুরুষের মধ্যকার জৈবিক সম্পর্কের টানা-পোড়েন নিয়ে সাহিত্যে তার চিন্তার বিচরণ, বিচক্ষণতা অতুলনীয় এবং বাস্তব সম্মত। বস্তুত এমন কিছু দিক আছে যা আমরা বাস্তবে সহজ ভাবে মেনে নিতে না পারলেও, শরতের সাহিত্যে সেগুলো সানন্দেই গ্রহন করে নিয়েছি।
দর্পচূর্ণের সেই স্বামীকে দেবতার আসন থেকে নামিয়ে জৈবিক চাহিদার তাড়নায় তাচ্ছিল্য করতে দেখা গেছে। দেবদাসে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ছুটে যেতে দেখা গেছে পতিতালয়ের নর্তকীর কাছে। চরিত্রহীনে দেখা গেছে কাজের মেয়ের প্রতি আসক্তির। তবে সব কিছু ছাড়িয়ে এইসব সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে মূলত প্রেম এবং প্রেমের পরিণতি হিসেবে বিচ্ছেদ। তবে কিছু কিছু বিচ্ছেদ যে প্রেমকে অমর করে তোলে সেটাই মূল উপজীব্য বিষয় শরৎ সাহিত্যের।
কবি জীবনানন্দের ভাষায় শরৎ সাহিত্যে ঠিক যেন, হাজার বছর ধরে পথ চলার পর কারও কাছে দুদন্ড শান্তি পাওয়ার গল্পই উঠে এসেছে। আমাদের প্রেম-ভালোবাসাগুলো আজও ঠিক এমনই। আমরা দুদন্ড শান্তির নেশায় পথ হেটে চলি।
“আমি মাদার তেরেসার মতো মানব সেবা মূলক কর্মকান্ডে বেশি বেশি নিজেকে সংযুক্ত করতেই বেশি পছন্দ করি।“
হঠাৎ কথাটা কানে আসতেই ফয়েজ শরৎ থেকে মুখ ফিরিয়ে আগ্রহ নিয়ে টেলিভিশনের দিকে তাকায়। কথা হচ্ছিলো নারীর অধিকার নিয়ে। নারীকে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। একজন নারী হয়ে উঠতে পারে একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। এখনত অনেকেই নিজের বুটিক হাউজ দিচ্ছে, বিউটি পার্লার দিচ্ছে। এইজন্য ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধাও পাওয়া যাচ্ছে। এমন নারী উদ্যোক্তাদের পাশে সব সময়েই সিস্টার হেরা স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসেন। তাছাড়া সমাজের অসহায় দুঃস্থ নারীদের জন্য তিনি খুলেছেন সমবায়-সমিতি। এখানে যে কেউ চাইলেই সঞ্চয় করতে পারে। সমিতি থেকে সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থাও তিনি রেখেছেন।
ফয়েজ ভাবে, বাহ ! বেশত সিস্টার হেরার এমন মানব সেবা মূলক কর্মকান্ড। সিস্টার হেরার কিছু কর্মকান্ডের ভিডিও ফুটেজ দেখান হচ্ছে। সেখানে সরকারের অনেক মন্ত্রীদের সাথেই তার হাস্যউজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেল। সামনের কোন নির্বাচনে দাঁড়াবার প্রত্যাশাও ব্যাক্ত করলেন তিনি।
সিস্টার হেরাকে দেখার পর ফয়েজের বুঝতে আর বাকি রইলনা; তার স্ত্রী রত্নার কোথা থেকে এমন হিজাব প্রীতির উদয় হয়েছে। মোটা শোটা গড়নের মধ্য বয়স্কা একজন নারী; সিস্টার হেরা দেখতে খুব একটা খারাপ নন। হয়ত মুখে একগাদা মেকআপ দেয়ার কারণেই তার সৌন্দর্যটা খুব বেশি চোখে লাগছে। বেগুনী রঙের পাতলা সিল্কের একটি শাড়ি পরে আছেন। মাথায় শাড়ির রঙের সাথে মিল করে সিল্কের হিজাব পরেছেন। পুরো হিজাবের ছাপা জুড়ে গোলাপ ফুলের কারুকাজ করা। সেটাকে আবার প্রজাপতির আকৃতির একটা ক্লীপ দিয়ে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। ক্লীপে আলো পড়তেই রঙবেরঙের আলোতে জ্বল জ্বল করে উঠছে।
টক-শো শেষ হতেই রত্না ফয়েজের বুকের উপর মাথা রেখে আহ্লাদের সুরে বলে, এই শোন না ! আমিনা একটা ছোট খাটো বিউটি পার্লার দিতে চাচ্ছি। ফয়েজ মনে মনে ঠিক এই আশঙ্কাটাই করছিলো।
পার্লার দিতে অনেক টাকার প্রয়োজন। এত টাকা পাব কোথায় ?
ব্যাংক থেকে লোনের ব্যবস্থা করে দেবে।
আমি ছোট খাটো চাকরী করি। আমাকে কেন ব্যাংক লোন দেবে ?
তোমাকে না দিলেও, আমাকেত দিবে। শুনেছি নারীদের জন্য ব্যাংক থেকে ব্যবসায়িক লোন নেয়ার ব্যবস্থা আছে। আমাকে তেমনই একটা লোনের ব্যবস্থা করে দাও।
আচ্ছা ! কিন্তু তোমারত বিউটি পার্লার সম্পর্কে কোন অভিজ্ঞতা নেই।
অভিজ্ঞতা নেইত কি হয়েছে ? শিখে নিব।
কোথা থেকে শিখবা ?
ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা। পাশের বাসার ভাবী একটা ট্রেনিং সেন্টার থেকে কোর্স করতেছে পার্লারের উপরে। আমি তার সাথে সব আলাপ করে রেখেছি। এখন তুমি রাজী হলেই আমিও ভাবীর সাথে গিয়ে কোর্সে ভর্তি হব।
হুম !
কি হুম ? তুমি কালকেই দেখ আমার জন্য ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে পার কিনা ?
হুম ! দেখব।
শোন, আমি যদি বিউটি পার্লারটা দিতে পারি; ভেবে দেখ কত টাকা প্রতিদিন ইনকাম করতে পারব। আমাদের আর কোন অভাব থাকবেনা। তোমার উপর থেকেও অনেক প্রেসার কমে যাবে।
হুম !!
আবার হুম !
না না মানে দেখছি কি করা যায় !
দেখছি না, তুমি অবশ্যই কালকে ব্যাংকে যাবে।
আচ্ছা যাব ! চল এখন ঘুমাই। অনেক রাত হয়েছে।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠার আগেই মাথার কাছে চায়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রত্না। রত্নার চেহারায় আজকে বিশেষ কিছু একটার পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। হিজাব !!! রত্না হিজাব পরেছে। কিন্তু ফয়েজত হিজাব কিনে দেয়নি ! তাহলে এই হিজাব সে পেল কোথায় ? ভাল করে খেয়াল করে দেখল; বিয়েতে যে সবুজ সিল্কের শাড়িটি সে দিয়েছিলো ওটাই কেটে হিজাব বানান হয়েছে। প্রথমটায় মনঃটা কিছুটা খারাপ হলেও মনে মনে সান্ত্বনা নেয় ফয়েজ। যাক ! শাড়িটা রত্না আর না পরলেও; এখন হিজাব আকারে হলেও অন্তত পরছেত সে। সেই বিয়ের পর আজকে রত্নাকে আবারও সাঁজতে দেখল ফয়েজ। মেকআপে একেবারে খারাপ লাগছেনা তার চিরচেনা সাদাসিধা রত্নাকে।
শোন আমি একটু ভাবীর সাথে পার্লারের কোর্সে ভর্তি হতে যাচ্ছি। সাথে আজকে থেকেই ক্লাস করা শুরু করে দিব। তুমি কিন্তু যে করেই হোক আজকে ব্যাংক থেকে লোনের একটা ব্যবস্থা করবে ?
ফয়েজ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে শ্বায় দেয়। আজকে আর তার অফিসে যাওয়া হচ্ছেনা। ফোন দিয়ে স্যারকে বলে দেয় তার ভীষণ জ্বর। আজকে আর অফিসে আসতে পারবেনা। স্যার অফিসের জরুরী কাজের কথা বললেও ফয়েজ তার অপারগতার কথা জানিয়ে দেয়। এই মুহূর্তে তার কাছে অফিসের কাজের চেয়েও স্ত্রীর কাজটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে কোন পুরুষই তার সংসারে কোন রুপ অশান্তির সৃষ্টি হোক তা চায় না।
সারাদিন ব্যাংকে ঘোরাঘুরি করে লোনের একটা ব্যবস্থা করে ফেলে ফয়েজ। বাড়ি ফেরার পথে মার্কেটে যায় হিজাব কেনার জন্য। দোকানে দোকানে নানা রকমের হিজাব দেখে মাথা ঘুরাতে থাকে তার। মনে হয় মেয়েদের পরনের সালোয়ার-কামিজ কিংবা শাড়িও এত জমকাল হয়না ! শেষে দুটি হিজাব কিনে মার্কেট থেকে বের হয়ে এসে সিগারেট ধরায় ফয়েজ। হঠাৎ দেয়ালে সিস্টার হেরার পোস্টারের দিকে চোখ পড়ে তার। মুখে ভারী মেকআপ, পরনে পাতলা সিল্কের শাড়ি, শাড়ির রঙের সাথে মিল করে মাথায় হিজাব। পোস্টারে বড় বড় অক্ষরে লেখা সিস্টার হেরার পক্ষ থেকে সবাইকে শুভেচ্ছা। সফল নারী উদ্যোক্তা, বিশিষ্ট সমাজ সেবিকা ইত্যাদি আরও অনেক বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়েছে সিস্টার হেরাকে। ফয়েজ ভাবে, আহা ! তার স্ত্রী রত্নাও বুঝি একদিন সিস্টার হেরার মতই হয়ে উঠবে। ফয়েজ ভাবে আর সিগারেটে টান দেয়।
হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়। আজ কদিন ধরেই বৃষ্টির কোন ঠিক ঠিকানা নেই। এই প্রচন্ড রোদ। বলা নেই, কওয়া নেই অমনি বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। অগ্যতা বৃষ্টিতে ভিজেই তাকে বাড়ি ফিরতে হলো। দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে পুরুষ কণ্ঠ শুনতে পেয়ে ফয়েজের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। দরজা খুলে দিয়ে রত্না মিষ্টি করে হাসি দিয়ে বলে, এসো পরিচয় করিয়ে দেই। ইনি হচ্ছেন রকি। রকি ভাইয়াকে নিয়ে এসেছি আমার বিউটি পার্লারের ইন্টেরিওর ডেকোরেশনের কাজ করানোর জন্য। রকি ভাইয়া খুব দারুণ কাজ করেন। তুমি ভাইয়ার কাজ দেখলে অবাক হয়ে যাবে।
রকি ফয়েজের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। বৃষ্টিতে ভেজার জন্য ফয়েজের মাথাটা প্রচন্ড ধরেছে। আজকাল একটু বৃষ্টিতে ভিজলেই তার প্রচন্ড মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায়। রত্না তুমি রকি সাহেবের সাথে বসে আলাপ কর। আমি দেখি একটু চা বানাতে পারি কিনা ! মাথাটা খুব ধরেছে, বলেই রান্না ঘরের দিকে চলে যায় ফয়েজ।
লেখক ঃ কাণ্ডারি অথর্ব