স্বামী মারা গেছে বছর কয়েক আগে। দেবর রাকিবের বাসাতেই ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে থাকতেন জেরিন সোহেলী ওরফে লাকী। একসঙ্গে থাকতে থাকতেই ভাল লেগে যায় দেবর রাকিবকে। কিন্তু দেবরের স্ত্রী-সন্তান রয়েছে। তাই পরিকল্পনা করেন দেবরের স্ত্রী রোকেয়াকে হত্যার। তাহলে পারিবারিকভাবেই দেবরকে বিয়ে করা যাবে। এই স্বপ্ন ছিল তার। এজন্য মাহমুদুল হাসান ওরফে কাউসার মোল্লা নামে পরিচিত একজনের সঙ্গে করেছিলেন ৩ লাখ টাকার চুক্তি। মাহমুদুল হাসান তার দুই সহযোগী সাখাওয়াতুল ইসলাম জয় ও অপর একজনকে সঙ্গে নিয়ে হত্যাকাণ্ডটি ঘটায়।
আগেই পরিকল্পনা ছিল খুনের ঘটনাটি সাজানো হবে ডাকাতির ঘটনায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী সব হয়েছে, কিন্তু পার পাননি জেরিন সোহেলী ওরফে লাকী। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে খুনের পরিকল্পনাকারী লাকী এবং ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া জয়কে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদের তারা হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে।
গত ১৬ই এপ্রিল রাজধানীর ১৯/১/এ কল্যাণপুর শাহী মসজিদ রোডের বাসা থেকে রোকেয়া বেগম দিনা (৩০) নামে এক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘাতকরা তার মুখমণ্ডলে স্কচটেপ পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে। পরে বাসা থেকে মূল্যবান স্বর্ণালঙ্কার ও জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। ঘটনার সময় ঘাতকরা গৃহবধূর সন্তান ও গৃহকর্মী মরিয়মকে পাশের রুমে বেঁধে রাখে। এ ঘটনায় নিহত রোকেয়ার স্বামী রাকিব হোসেন মিরপুর থানায় ডাকাতি ও হত্যার ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি থানা পুলিশের পর বর্তমানে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পশ্চিম বিভাগ তদন্ত করছে।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির (পশ্চিম) সহকারী পুলিশ কমিশনার মহররম আলী জানান, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটির রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য পরিকল্পনকারী হলো জেরিন সোহেলী ওরফে লাকী। সে তার পুরনো সহকর্মী মাহমুদুল হাসানের মাধ্যমে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভাই মারা যাওয়ার পর ভাবী জেরিন ও তার সন্তান সুয়াদকে নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে একই বাসায় বসবাস করছিলেন। এ কারণে প্রায়ই স্ত্রীর সঙ্গে রাকিবের ঝগড়া-ঝাঁটি হতো। এনিয়ে রাকিবের স্ত্রী রোকেয়ার সঙ্গে জেরিনেরও ঝগড়া হয়েছে। সর্বশেষ ঘটনার ১০ দিন আগে জেরিনের একসঙ্গে থাকা নিয়ে রাকিব-রোকেয়া দম্পতির মধ্যে ঝগড়া হলে দুই পরিবার আলাদা থাকা ও খাওয়া শুরু করেন। এই ক্ষোভ থেকেই জেরিন তার দেবরের স্ত্রী রোকেয়াকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। সূত্র জানায়, জেরিন আগে আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিস নামে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। সেই চাকরির সুবাদে মাহমুদুল হাসান ওরফে কাউসার মোল্লা নামে এক যুবকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
জেরিন কাউছারকে পারিবারিক কলহের কারণ জানিয়ে তার কাছে সহযোগিতা চায়। এ সময় কাউসার ও জেরিন মিলে রোকেয়াকে হত্যার পরিকল্পনা করে। হত্যার জন্য চুক্তি হয় তিন লাখ টাকা। কাউসার তার দুই সহযোগী জয় ও অপর একজনকে সঙ্গে নেয়। জেরিনের বাসায় আগে থেকেই যাতায়াত ছিল মাহমদিুল হাসানের। সেই সুবাদে ঘটনার দিন সবার আগে বাসায় ঢুকে হাসান। পরে তার দুই সহযোগী জয় ও অপরজন ঢোকে। তারা বাসায় রোকেয়ার সন্তান ও কাজের মেয়েকে ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে পাশের রুমে আটকে রাখে। রোকেয়াকে ধারালো অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মুখে স্কচটেপ পেঁচায়। নাক-মুখসহ পুরো মাথা কস্টেপ পেঁচানোর কারণে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায় রোকেয়া। ঘাতকরা এ সময় আলমারি থেকে স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে বাসায় ফিরে জেরিনই বিষয়টি তার দেবরকে জানায়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, জেরিন কিছুটা ধূর্ত প্রকৃতির। সে এমনভাবে ঘটনার পরিকল্পনা করেছে যাতে তাকে কেউ সন্দেহ না করে। তার উদ্দেশ্য ছিল রাকিবের স্ত্রী খুন হয়ে গেলে সে রাকিবকে বিয়ে করে এক সঙ্গে থাকবে। ডিবির ওই কর্মকর্তা জানান, তারা প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে হত্যাকাণ্ডের রহস্যটি উদ্ঘাটন করেছেন। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া মূল ঘাতক মাহমুদুল হাছান পলাতক রয়েছে। তাকে গ্রেপ্তার করতে তার ঝালকাঠির গ্রামের বাড়িতে একাধিকবার অভিযান চালানো হয়েছে। আর গ্রেপ্তারকৃত জয় হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করেছে।
আতিক/প্রবাস