ঢাকা: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বৈঠকের পরও উঠেছে কথাটি। দেশে গণতন্ত্র নেই অনুযোগ করে মোদির সহায়তা চাইলেন খালেদা জিয়া, জবাবে মোদি বললেন, মৌলবাদের পক্ষে নয় তার দেশ। এই কথার মানে কি, সে নিয়ে বিএনপিতে চলছে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। তবে কি খালেদা জিয়াকে জামায়াত এবং কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ইসলামী দলগুলোকে ছাড়তে বললেন মোদি?
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ধর্মভিত্তিক এই দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির জোট গঠন ফলপ্রসু প্রমাণ হয় নির্বাচনে। দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোট সমান, অথচ জাতীয় সংসদে আসনের ক্ষেত্রে ব্যবধান বিস্তর। আওয়ামী লীগের ৬২টি আসনের বিপরীতে বিএনপির আসন দুইশরও বেশি। তাদের শরিক জামায়াত, জাতীয় পার্টির একাংশ এবং ইসলামী ঐক্যজোটের আসনও ২০টির বেশি। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকাকালে দেশে জঙ্গি উত্থান আর এ ক্ষেত্রে জোট সরকারের মদদ, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলায় সরকারের সহায়তার অভিযোগসহ নানা কারণে এই জোট নিয়ে প্রশ্ন উঠে দেশে বিদেশে।
আবার্ একাত্তরের আলবদর বাহিনীর দুই শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে মন্ত্রিত্ব দেয়া, মুক্তিযোদ্ধিার তালিকায় জামায়াত নেতাদের নাম তোলাসহ নানা কারণে পরে এই জোট বিএনপির জন্য আর লাভজনক কি না, সে প্রশ্ন উঠে খোদ বিএনপির ভেতর।
জামায়াত এবং উগ্রপন্থি দলগুলোর সঙ্গে জোটের কারণে বিএনপি যে চাপে আছেন সেটা জানেন চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও। নানা সময় তিনি বলেওছেন যে, সময় আসলেই এই জোট ভেঙে দেবেন তিনি। খালেদা জিয়া এমন কথাও বলেছেন যে, জামায়াতের সঙ্গে তাদের জোট থাকলেও সেটা আদর্শিক কোনো জোট নয়।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপি নেতাদের ফাঁস হওয়া নানা কথোপকথনেও স্পষ্ট যে, জামায়াত ও ধর্মীয় দলগুলোর সঙ্গে জোটবন্ধ থাকায় আপত্তি আছে দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের মধ্যেই। তবে খালেদা জিয়াকে এ নিয়ে বলার ক্ষমতা নেই বলে হতাশার কথাও জানিয়েছেন নেতারা।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালের দাবিতে আন্দোলনে থাকার সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে তাকিয়ে ছিল বিএনপি। ইউরোপীয় ইউনিয়নও জামায়াত ছাড়তে বিএনপিকে আহ্বান জানিয়েছে।
অনেক আশা নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাতেও মোদি কি বিএনপিকে একই বার্তা দিলেন কি না, তা বুঝে উঠতে পারছেন না নেতারা।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত মোদির সঙ্গে খালেদার বৈঠক হয়েছে দুবার। একবার বিএনপি নেতাদের নিয়ে আর একবার দুই নেতার একান্ত সাক্ষাৎ।
বিএনপি নেতারা জানান, খালেদা জিয়া সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি লিখিত বক্তব্য মোদির হাতে দেন। এতে নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কথা হয় বিএনপির বিরুদ্ধে ভারত বিরোধিতার অভিযোগ প্রসঙ্গে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথাও উঠে আসে। বৈঠকের ছবিতে খালেদা জিয়াকে একটি কাগজ পড়ে শোনাতেও দেখা গেছে। একইসঙ্গে বৈঠকে বিএনপির বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয়ার বিষয়েও কথা হয়। তবে দলটির পক্ষ থেকে মোদিকে আশ্বস্ত করা হয়, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। বিএনপি কখনও জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি, ভবিষ্যতেও দেবে না।
তবে মোদি বলেছেন, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের সঙ্গে থাকলেও ভারত যেকোনো ধরনের সন্ত্রাস ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে। যদিও মোদিকে বিএনপির তরফ থেকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেয়া হয় না বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে।
মোদির এই বক্তব্যের পর গুঞ্জন ওঠেছে, ভারতকে পাশে পেতে বিএনপি কি তাহলে জামায়াত ছেড়ে দিচ্ছে! কারণ জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতের ওপর আগেই স্বাধীনতাবিরোধী ও ‘সন্ত্রাসী সংগঠনের’ তকমা লেগে আছে। বলা হচ্ছে, বিএনপি মধ্যমপন্থি একটি দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমান জোটে জামায়াতসহ বেশ কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠনকে রাখা হয়েছে। এরফলে বিএনপি এখন ডানপন্থি দল হিসেবে পরিচিত হচ্ছে।
অন্যদিকে প্রকাশ্যে না বললেও বিএনপি নেতাদের কারো কারো দাবি, জামায়াতের কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আন্দোলন সংগ্রামে বেশি সহিংসতা হচ্ছে। যাতে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরাই বেশি জড়িত।
প্রসঙ্গত, গত মে মাসের শুরুর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসের এক শুনানিতে জামায়াত-শিবিরকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে তাদের নেতাকর্মীদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার পক্ষে প্রস্তাব দেয়া হয়। যদিও বরাবরই জামায়াত-শিবির এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান ঢাকাটাইমসকে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাকিস্তান, আফগানিস্তান এমনকি ভারতেও জঙ্গি উত্থানের ঘটনা ঘটছে। তাই নরেন্দ্র মোদির একটি সার্বজনীন বক্তব্য দিয়েছেন। আমরাও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে।”
ভারতকে পাশে পেতে বিএনপি জামায়াতকে ছাড়বে কিনা এমন প্রশ্নে সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেন, “সেটা সময় বলে দেবে’। অবস্থার উত্তরণ হলে তারা চলে যাবে আর যদি আগে যেতে চায় তাও যেতে পারবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোরকে বলেন, “সরাসরি না বললেও মোদি বিএনপিকে জামায়াত তথা ধর্মভিত্তিক দলগুলো ত্যাগ করার বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কারণ মধ্যমপন্থার দলটি এখন অনেকটা ডানপন্থি হয়ে গেছে। আর এটা বিএনপিকে ঢেলে সাজানোর জন্য একটি সুযোগও বটে। যদি তারা সুযোগটি কাজে লাগাতে পারে তাহলে তাদের জনসমর্থন বাড়বে।” তিনি বলেন, “বিষয়টি খুবই স্পষ্ট যে, মোদি এই অঞ্চলের উন্নয়ন, শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। তারমধ্যে অন্যতম হলো সন্ত্রাস ও উগ্র মৌলবাদ। তাই প্রভাবশালী পার্শ্ববর্তী দেশটির আনুকূল্য পেতে বিএনপিকে বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়া উচিত।”