করমর্দনে কী বার্তা রাজনীতিতে?

ঢাকা : দুদিন ব্যস্ত সময় পার করে ঢাকা ত্যাগ করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার এই সফরে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদার জিয়ার সঙ্গে বৈঠক নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে ‘সুন্দরভাবে আলোচনা হয়েছে’। খালেদা-মোদি বৈঠক বাংলাদেশের রাজনীতিতে কী বার্তা দিল? আর এ থেকে বিএনপিরই বা কী অর্জন হলো এ নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই।

হোটেল সোনারগাঁওয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বিকেল ৪টার দিকে প্রথমে খালেদা জিয়া দলের পাঁচ নেতাকে নিয়ে মোদির সঙ্গে বৈঠক করেন পরে ১০ মিনিট খালেদা-মোদি একান্ত বৈঠক হয়।

এসব জানিয়ে বৈঠক শেষে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘সুন্দরভাবে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে যে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, সেটি নিয়ে কথা হয়েছে। ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেভাবে আঞ্চলিক উন্নয়নের প্রতি জোর দিয়েছেন, সেটাকে বাস্তবায়ন করতে হলে উন্নয়নকে গণতন্ত্রের ভিত্তির ওপর শক্তিশালী করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘কোন দেশে কোন সরকার আছে সেটা মূল কথা নয়, কেননা সরকার আসবে এবং যাবে। কিন্তু দেশের মানুষ চিরদিন দেশেই থাকবে।’

তবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে কী জবাব দিয়েছেন জানতে চাইলে মঈন খান তা এড়িয়ে যান। পরে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুব্রাহ্মনিয়াম জয়শঙ্কর সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্পষ্টভাবেই জানিয়েছেন যে, আমরা গণতন্ত্র সমর্থন করি এবং সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গিবাদের বিরোধী।’

নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর বাংলাদেশের রাজনীতিতে কী ধরনের বার্তা দিচ্ছে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘আমি যেটা বুঝি যে, এটা শুধু বাংলাদেশের রাজনীতি নয়, ভারতীয় রাজনীতিতেও একটা বার্তা বটে। সেটা হলো যে পুরনো ধাঁচে প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে যদি ষড়যন্ত্র করতে পারি বা আটকিয়ে রাখতে পারি তাহলে লাভ বেশি- এই জায়গা থেকে শিফট হচ্ছে। উভয় দেশই একটা স্মার্ট ফরেন পলিসির দিকে যাচ্ছে। আর তা হলো পুরনো ধাঁচের সেকেলে টেকনিকের চেয়ে বরং লাভজনক হচ্ছে উভয় উভয়ের প্রফিট দেখা। কারণ তাহলে দুটো যোগফল করলে দুই দিয়ে ভাগ করলে যে প্রফিটটা হয়। সেটা পুরনো ধাঁচের সেকেলে টেকনিকের মধ্যে সেই প্রফিটটা হয় না। সাউথ এশিয়ান পলিটিক্সে গ্রেট ইমপ্যাক্ট আসতে পারে। সাউথ এশিয়ান পলিটিক্সের মর্মান্তিক দিক হচ্ছে যে, প্রতিবেশিদের মধ্যে সম্পর্ক মানেই এক ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক। আমি বলবো কায়েমি স্বার্থবাদী মহল এ বিষয়গুলোকে একেবারে টাইট করে রেখেছিল।’

ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তনের আভাস কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘(ভারতের) ইলেকশনের আগে এবং পরে হচ্ছে রূপান্তরিত মোদি। আমরা সবাই মনে করতে পারি, ইলেকশনের আগে উনার বাংলাদেশ বিষয়ক কিছু মন্তব্য বাংলাদেশের মানুষ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে নাই। কিন্তু উনি নির্বাচনে জয়লাভ করার পরে আমরা দেখলাম যে, প্রতিবেশীদের সুসম্পর্কের ভিত্তিতে উন্নয়ন- এই ধরনের একটা নীতি তারা গ্রহণ করেছে। এবং এখনও পর্যন্ত, সামনে কী হবে? আশা করি, ভালোর দিকে যাবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি যে প্রতিবেশীর প্রতি সেই নীতির প্রতিফল মোদির সফরগুলোতে দেখা যাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্যান্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে দেখা হচ্ছে কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক যেভাবেই বলি না কেন। আমার কাছে যেটা মনে হয় এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নিয়ে বলবো না, উভয় দেশের যে মহলটি দশকের পর দশক নানা রকমের উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রপাগান্ডার ভিত্তিতে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে। সেই জিনিসটা সরে গিয়ে ন্যায্য হিস্যা এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ সম্মান রক্ষার বাংলাদেশের পলিটিক্সে সে ধরনের হাওয়া তৈরি হচ্ছে। ভারতের মিডিয়া বা সিভিল সোসাইটির ক্ষেত্রে যদি আমরা দেখি দেখবো এতোদিন যে কায়েমি স্বার্থবাদী যে ব্যাপারগুলো ছিল, সেটা আস্তে আস্তে দুর্বল হচ্ছে। খোদ মোদির দলের রাজনীতির মধ্যেও পরিবর্তনটা দেখা যাচ্ছে। যা বেশ একটা আশাবাদ যোগায়।’

খালেদা-মোদি বৈঠকের মধ্য দিয়ে বিএনপির অর্জন প্রশ্নে এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘এটাকে আমি মনে করি যে এতে করে কিছুটা হলেও বিএনপির মান রক্ষা করেছে। কারণ বিএনপি গত কয়েকদিনে যে ধরনের ভারতপ্রীতির নমুনা দেখিয়েছে তাতে করে এ সাক্ষাৎকারটা না হলে এমব্যারাসিং হতে হতো। এমব্র্যাসমেন্টের হাত থেকে তারা বেঁচেছে। এবং আমার কাছে আশ্চর্য লেগেছে সেখানে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ব্যাপারে ভারতকে এক ধরনের মুরব্বি মানার মতো কথাবার্তা দেখলাম যা আমার পছন্দ নয়। আমি সব সময়ই দেখতে চাই বাংলাদেশের পলিটিক্স বাংলাদেশেই নির্ধারণ হবে। এখানে বৃহৎ কোনো ইঙ্গিত আছে বলে আমি মনে করি না। খালেদা জিয়ার অর্জন গুরুত্বহীন বা গুরুত্বপূর্ণ কোনোটাই মনে হয় না।’

খালেদা-মোদি বৈঠকে বিএনপি অর্জন প্রসঙ্গে রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন খান মোহন বলেন, ‘বৈঠক নয় আমার কাছে মনে হয়েছে এটা সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছে। এ নিয়ে দু’পক্ষ থেকে তেমন কিছু বলাও হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্রসচিব যেটা বলছেন, তাতে আমার কাছে মনে হয়েছে বিএনপিকে তারা মৌলবাদী সংগঠন হিসেবে ট্রিট করছে। তারা গণতন্ত্র চায় তবে মৌলবাদ সমর্থন করে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী যিনি বাংলাদেশ সফরে আসছেন তিনি কট্টর হিন্দু মৌলবাদী। হিন্দু মৌলবাদী রাজনৈতিক দল ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। আমার প্রশ্ন হলো, তাদের পররাষ্ট্র সচিব কীভাবে বিএনপির মতো মডারেট ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে মৌলবাদে অভিযুক্ত করে?’

তিনি আরো বলেন, ‘এখানে রাজনৈতিক কোনো অর্জন হয়নি, সান্ত্বনা আছে। সাক্ষাৎটি যাতে না হয় তার জন্য সরকার থেকে বাধার চেষ্টা ছিল। সেক্ষেত্রে বৈঠকটা হয়েছে এটা একটা সান্ত্বনা বিএনপির জন্য। বৈঠক হওয়াটা ছিল বিএনপির জন্য প্রেসটিজ ইস্যু। আর ড. মঈন খান গণতন্ত্র পুনঃরুদ্ধারের জন্য যে কথাবার্তা ভারত সরকারকে বলেছে আমি মনে করি এটা মোটেও ঠিক হয়নি। ভারতের পরাষ্ট্রসচিবের কথায় মনে হয়েছে তারা বিএনপিকে পাত্তাই দেয়নি।’

তবে খালেদা-মোদির বৈঠকে বিএনপির অর্জন প্রশ্নে দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রফিক শিকদার এখানে অনেক অর্জন দেখছেন। তিনি বলেন, ‘বৈঠক যাতে না হয় তা নিয়ে এক ধরনের চক্রান্ত ছিল। তাই এই বৈঠক হওয়াটাই একটা অর্জন। আর এ বৈঠকের ফলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ-ভারত এবং বিএনপি-বিজেপি সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হবে।’

বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘আমি মিটিংয়ে ছিলাম না। অর্জন প্রশ্নে আমি মনে করি, দু’পক্ষের আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *