সন্তানদের পড়াশুনা বন্ধ করে দিন

‘শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড’ এই কথাটি শুনে শুনে ছোট থেকে বড় হয়েছি। তার মানে ছোট থেকেই বুঝতে শিখেছি যদি কোন ভাবে এই মেরুদন্ডটি ভেঙ্গে দেয়া যায় তাহলে জাতি আর দাঁড়াতে পারবে না।
প্রতিটি জাতি তাদের সন্তান পড়াশুনা করান যেন জাতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়ে না যায়। কিন্তু এদেশের ৯৫ ভাগ অবিভাবক চান তার সন্তান পড়াশুনা করে ভাল একটা চাকরি করুক। তারা চায় না কখনোই তাদের সন্তান শিক্ষা অর্জন করুক। এখানে তাদেরকে কোন ভাবেই দোষ দেয়া যাবে না। কারন আমাদের সমাজ ব্যবস্থাটাই এমন।

শিক্ষা অর্জন বলতে আমরা শুধুই বুঝি গতানুগতিক কিছু বই মুখস্ত করে বছরের শেষে পরীক্ষা দিয়ে ভাল ফলাফল করে আবারো পরের বছরের জন্য একইভাবে শুরু করা। ভাল ফলাফল করলে অভিভাবকরা খুব খুশি নাহয় কপালে ধোলাই এর সাথে জোটে ফ্রি বকাঝকা।

আসলে আমরা মুখস্ত করে কি শিখছি! সমাজে একটা ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যারা ভাল ফল করছে তারাই ভাল আর বাকি সব উচ্ছন্নে গেছে। তাদের দিয়ে কিছুই হবে না। আমরা কখনও ভেবে দেখিনি যারা ভাল ছাত্র ছিল না কিংবা পড়া শুনাই করেনি তাদের লেখা বইই আমরা পড়ছি কিংবা তাদের আবিষ্কৃত বিষয় পড়ছি। এসব ভাবের কথা বললাম এবার বাস্তবে আসি ।

আমি সবসময় একটা কথা বলি, পাঠ্যবই হিসেবে যদি হুমায়ন আহমেদের বই থাকতো তাহলে আমি তা একবারের বেশি পড়তাম না। কারন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটা এমন যে একটা মজার বিষয়কেও কঠিন করে তোলা হয় ফলাফল শিক্ষার্থীরা হারায় তাদের পড়াশুনার আনন্দ। তারপর বিষয়টা এমন হয় যে, ছোটবেলায় যেমন খেতে না চাইলে মা জোর করে যেভাবে খাবার খাওয়াতো ঠিক একই অবস্থা হয় তখন শিক্ষার্থীদের। পড়তে ইচ্ছা না করলেও বাব-মা এর ভয়ে দায়সারা ভাবে মুখস্ত করে পাশ অথবা ভাল ফলাফল করতে হয়। আমাদের পড়াশুনা সম্পুর্ন মুখস্ত নির্ভর। আমরা কোন বিষয় হাতে কলমে শেখার সুযোগ পাই না। কম্পিউটার বিষয়টাও ছেলে-মেয়ে বই মুখস্ত করেই শিখতে হচ্ছে। আমার মনে আছে আমার কৃষি যে বিষয়টা ছিল তা কখনও আমি বই এর বাইরে হাতে-কলমে শিখি না বা শেখানো হয়নি।

অনেকে এখানে আমার সাথে দ্বিমত করবেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে আমরা হাতে-কলমে শিখি। মানলাম সেই কথা। কিন্তু ভাই আপনাদের গোড়া যদি হয় রানা প্লাজার মত নড়বড়ে আর উপরে রানার রুমের মত করে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখেন তবে কি মনে করেন ধসের হাত থেকে রেহায় পাবেন! পাবেন না কখনওই।

এটা তো গেলো মুখস্ত আর হাতে-কলমের লড়াই।এবার আসি আধুনিক শিক্ষ ব্যবস্থায়। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা বলতে এখন বুঝায় পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন পত্রে হাতে পাওয়া সেটা মাস্টার্সের পরীক্ষা হোক আর বাচ্চাদের পিএসসি পরীক্ষা হোক। যেন বিষয়টা ঘটছে খুব স্বাভাবিকভাবে। সরকার থেকে শুরু করে অভিভাবক কারো যেন মাথা ব্যাথা নেই প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে। সবার টার্গেট যেন সন্তান যেন GPA-5 পায়। সন্তানরাও ছুটছে প্রশ্নপত্রের পেছনে বাবা-মার সম্মান রক্ষা করতে আর বোকার হাত থেকে রক্ষা পেতে।

পড়াশুনা না করেও কেউ করছে ভাল ফলাফল আর অনেকে করছে অপ্রত্যাশিত বাজে ফলাফল। এর অন্যতম কারণ দ্রুত ফলাফল প্রকাশ। এত দ্রুত ফলাফল প্রকাশের মাধ্যমে সরকার চাচ্ছে তাদের ক্রেডিট জাহির করতে। কিন্তু তাদের এই ক্রেডিট অর্জনের জন্য শেষ হয়ে যাচ্ছে দেশের কোমল মতি সুন্দর ভবিষ্যতগুলি।

সেদিন দেখলাম একটি ছেলে এসএসসিতে A+ না পাওয়ায় বাব-মার বোকা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। ছেলেটা আসলেই কত বোকা ও জানলোই না পুরো একটা মিথ্যের মধ্যে দিয়ে তার জীবনটা সে শেষ করে দিলো।

আমার এভাবে বলাটা ঠিক হবে কিনা জানি না তবে না বলে পারছি না সময় এসেছে এদেশের সন্তানদের আগে অভিভাবকদের শিক্ষা নেয়া কিভাবে তাদের সন্তানদের শিক্ষা অর্জন করাবেন। কারন তারা যা চায় সেটা পুরো ভুল এবং দেশের জন্য একটি ক্ষতিকর বিষয়। সন্তানদেরকে তারা সন্তানের মত নয় একটা রেসের ঘোড়ার চোখে দেখেন শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্য। কারন তারা চায় ওমুকের চেয়ে তার সন্তান ভাল ফল করুন তা সে যেকোন মূল্যে।

এবার একটা কথা বলি যেটা কে কিভাবে নিবেন জানি না কিন্তু আমার মনে হচ্ছে বলাটা খুব দরকার। আমাদের জাতি যদি শিক্ষিত হয় তাহলে খুব ক্ষতি হবে আমাদের আশেপাশের কিছু দেশের। তখন তারা আর আমাদের কোন ভাবে ব্যবহার কুরতে পারবে না। কাজেই এরা কাজ চালাচ্ছে খুব কৌশলে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য। আর আমদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন পুরোই ভেঙ্গে পড়েছে। আমাদের দেশের অভিভাবকরা যেন কিছুই বুঝছে না তারা তাদের সন্তানদের সেই ভুল শিক্ষাই নিতে বাধ্য করছেন। ভুল শিক্ষা নিতে বাধ্য করার চেয়ে অভিভাবকদের উচিত এই ভুল পড়াশুনা বন্ধ করে দেয়া। নিজের সন্তানের জীবন নিজের হাতে ধ্বংস করার চেয়ে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাটাই এখন দায়িত্ব হওয়া উচিৎ বাবা মায়ের।

মুনওয়ার আলম নির্ঝর
লেখক: সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *