A+ না পেয়ে কিশোরের আত্নহত্যা এবং কিছু প্রশ্ন

‘ভালো করতেই হবে, না হলে রক্ষা নেই’, এমনই এক প্রচলিত চাপের মধ্যে দিয়ে শিক্ষাজীবনের কঠিন পথ পাড়ি দিচ্ছে দেশের কয়েক কোটি শিশু শিক্ষার্থী। জন্মের পর ‘অ আ ক খ’ শেখার পরই ক্লাস ১ এ ভর্তির অসম প্রতিযোগিতায় নাম লেখাতে হয় শিশুদের, বিশেষ করে শহুরে শিশুদের।

কোনো রকমে ক্লাস ১ ভর্তির সেতু পার হয়ে, নতুন বই এর ঘ্রাণ আর পড়া-লেখার মজা নিতে নিতেই এসে পড়ে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা (পিইসি)। সেখান থেকেই শুরু হয় A+ নামের মাইলফলক ছোয়ার ‘মাষ্ট উইন’ প্রতিযোগিতা। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাছে ওই A+ এর মাইলফলক বিষয়টা কতোটুকু গুরুত্বপূর্ণ/বোধোগম্য তা জানি না, কিন্তু অভিভাবকদের কাছে তা জীবন-মরণের চেয়ে মান-সন্মানের পরীক্ষা।

একই ধারায় কিছুদিন পরে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি), তারপরে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি)। এ যেনো চলমান এক ডিটেনশন।

সম্প্রতি এমনই কঠিন অবস্থার শিকার ‘আরাফাত শাওন’ নামের এক শিক্ষার্থী। ফেনী সদর উপজেলার কালিদহ ইউনিয়নের গোবিন্দপুরের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান শাওন। সে এবছর ফেনী সেন্ট্রাল হাইস্কুল থেকে বাণিজ্য বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলো। গত ৩০ মে প্রকাশিত ফলাফলে জিপিএ ৪.৮৩ পেয়ে উত্তীর্ণও হয় শাওন। কিন্তু জিপিএ ৫ বা A+ না পাওয়ায় বাবা-মায়ের বকুনি আর অবহেলায় শেষ পর্যন্ত তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে।

শুধু তাই নয়, আত্মহত্যার কারণ, পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগে-পরের অসহনীয় চাপ,  আর শিক্ষা ব্যবস্থার কিছু বিষয় কিশোর ভাষায় লিখে রেখে গেছে শাওন।

কতোই বা বয়স হয়েছিল শাওনের? ১৫ অথবা ১৬? পাঠক একবার মনে করুনতো দয়া করে, শাওনের ওই বয়সে আপনি ঠিক কী কী করেছিলেন? পড়ার পাশাপাশি শিশু সংগঠন, সাংস্কৃতিক-ক্রীড়া সংগঠনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড আর গ্রাম-পাড়া-মহল্লার দুরন্ত জীবনের মধ্যে দিয়ে কেটেছে নিশ্চয়? অথচ কী এক নির্মম মানসিক নির্যাতন আর বদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে সময় পার করে, আত্নহত্যার মতো পথ বেছে নিয়েছে কিশোর শাওন। কালো কলমে মনের মধ্য ঝরা রক্ত দিয়ে ডায়েরির পাতায় লিখে রেখে গেছে ‘সুইসাইড নোট’।

পাঠক, একবার দেখে নিন কী লিখে গেছে হতভাগ্য শাওন সু্ইসাইড নোটে (হুবহু রাখা হয়েছে তার লেখা)…

আর আমি আদো জানি না যে আমি কি? এই পরিবারের বা আমার মা-বাবার সন্তান, তা না হলে সব সময় এ রকম শাসন আর কড়া শাসনের উপর আমাকে রাখা হয়েছে। কোন বাবা-মা তার সন্তানকে পড়া লিখার খরচে খোটা দেয় না। কিন্তু আমার মা বাবা সব সময় আমাকে বলে তোর জন্য মাসে মাসে হাজার হাজার টাকা খরচ করছি। এভাবেই প্রতি নয়ত বকাঝযকা করা হয়। সব সময় বাবার থেকে শুধু খারাপ ভাষার গালি আর গালি শুনতে হয়। যা আমার একটু বালো লাগতো না। কিন্তু আমি এতো দিন সহ্য করে ছিলাম। কারণ কোন কিছু করার কথা ভাবলে মনে হতো এ দুনিয়ায় তো বাবা-মায়ের আদর ভালোবাসা পেলাম না। পেলাম না শুখ শান্তি। আসলে মানুষ বলে যে ঠিক টাকা পয়সা ও ধন সম্পদ মানুষকে সুখী করতে পারে না। আর যদি আমি নিজের হাতে আত্মহত্যা করি তা হলে মরর পরও শান্তি পাবো না। আর মরার পর আমাকে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হতো। তাই এখন আমার আর এসব কিছু সহ্য হচ্ছে না। …

AwNnXBRk0KWY

 

আমাদের ছাত্রদের কি দোষ বলুন আমরা তো আমাদের মতো চেষ্টা করে যাই। তবে আমাদের দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড গুলো কারণে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এমন হাল। এর আগের বছর সরকার তার নিজের স্বার্থের জন্য শিক্ষার হার বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এবার হরতাল-অবরোধ দেয়ার ফলে বর্তমান সরকার বিরোধী দলিয় সরকারকে গালি দেওয়ার জন্য পাশের হার কমিয়ে দিয়েছে, যাতে দেশে ফেল এর হার বেড়েছে। বলুন আমরা আর কি ভাবে ভালো রেজাল্ট করতে পারি!!!???

2

 

আমাদের মা-বাবা চায় আমরা ভালো রেজাল্ট করি। কিন্তু দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে ও তো দেখতে হবে। আমার বাবা ও আমার আত্ত্বীয়-স্বজন আমার এ রেজাল্ট (৪.৮৩) এর উপর খুশিনা। সবাই আমাকে বকাবকি করছে। কিন্তু আমার স্কুলের মধ্যে ২য় স্থান পাওয়ার পরও কিন্তু তারা অন্যদের রেজাল্ট এর কথা দেখে না, ভাবে না। তাদের কথা আমাকে A+ পেতেই হবে। A+ কি গাছে ধরে যে আমি পেড়ে আনবো।

3

 

আরো অনেক কথা যা মনের ভিতর জমা করে রেখেছি। কিন্তু বললে শেষ হবে না। থাক। যদিও আমি মারা যাই … তা হলে সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আর যদিও বেঁচে যাই….!!!

4

 

আমার কিছু ঋণ রয়েছে
DJ Flower Tuch= সূর্য ৯০০
আমার বন্ধু শুভ= ১০০ (টাকা)
ইসমাইল= ২০০/পূবালী ইলেকট্রনিক শহীদ মার্কেট।

এই সুইসাইড নোট পড়ে কিছু সময়ের জন্য হয়তো মন খারাপ হচ্ছে, হয়তো কিশোরটিকে বোকা মনে হচ্ছে, হয়তো শিক্ষা ব্যবস্থাকে গালি দিচ্ছি, হয়তো ভাবছি বিচ্ছিন্ন ঘটনা অথবা কিছু ভাবার শক্তি হারিয়ে ফেলছি আমরা। বিগত কয়েক বছর হলো এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে বলে আমাদের অনুভূতিতে এবং প্রতিক্রিয়াতে প্রভাব হয়তো ফেলছে না।

কিন্তু আমরা কি চিন্তা করেছি, বয়:সন্ধির এক চ্যালেঞ্জিং সময়ের পুরোটাই ৩/৪টি পরীক্ষার চাপ নিয়ে বেড়ে উঠছে প্রজন্ম? চাপের ফলে তাদের মন-চিন্তায় কী প্রভাব পড়ছে?

আসুন সবাই মিলে ভাবি বিষয়টি নিয়ে। তবে বেশি সময় নিয়ে ভাবার আগে খেয়াল রাখতে হবে, ওই পরিস্থিতি যেনো নিজের ঘরে/পরিবারে চলে না আসে!

রাজ / প্রবাস নিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *