থাকব না কেউ পেছনে, গড়ব সমাজ এক সনে। তেমনিভাবে আমাদের ভালো রেজাল্ট করা শিক্ষার্থীরা চাইবে মানসম্মত একটি কলেজে অধ্যয়ন করতে। এদিকে এসএসসি ফলাফল পাওয়ার পর হতেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে বেড়েছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তা। কারণ জিপিএ-৫ পেয়েও ভালো মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাবেন না অনেক শিক্ষার্থী। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে আসন সঙ্কট না থাকলেও সঙ্কট রয়েছে ভালো মানের কলেজের। এই নিয়েই বিপাকে পড়তে হবে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে। তীব্র প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বীতায় অবতীর্ণ হতে হবে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য। পরীক্ষায় সেরা সাফল্য অর্জন করেও অনেক শিক্ষর্থীকে ভর্তি হতে হবে মানহীন কলেজে।
ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল। আমরা জানি ফলাফল প্রকাশের পর শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকরা বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন। ভালো ফলাফল করা অর্থাৎ শতভাগ পাস করা স্কুলগুলোর কথা গণমাধ্যমেও ফলাও করে প্রচারিত হয়। জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের ছবি ও সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে। কিন্তু এসএসসিতে ভালো ফল করলেই শিক্ষা জীবন শেষ হয়ে যায় না। এরপরে রয়েছে শিক্ষা জীবনের আরো অনেক স্থর। স্বাভাবিকভাবেই এর পরের স্থর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে তাদেরকে ভর্তি হতে হবে।
আর সবাই চাইবে মানসম্মত একটি কলেজে ভর্তি হতে। অতপর সবার ইচ্ছা বা স্বপ্ন পূরণ হবে না। কেননা কাগজে-কলমে উচ্চ মাধ্যমিকে আসন সংকট না থাকলেও, বাস্তবে আসন সংকট রয়েছে। কেননা অধিকাংশ কলেজগুলোতে আসন থাকলেও ভালো ও সেরা এবং সরকারি কলেজে আসন সংকট রয়েছে। বোধগম্য কারণে ভালো ফলাফল করা শিক্ষার্থীরা ভালো কলেজকেই বেছে নিতে চাইবে। আর এ কারণে ভালো কলেজে ভর্তির জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা থাকলেও মানহীন কলেজগুলোতে অধিকাংশ আসন ফাঁকাই থেকে যায়। আর তাই এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর এখন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে দুশ্চিন্তা।
এদিকে আমাদের মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী বলেছেন, উচ্চমাধ্যমিকে কোনো আসন সংকট নেই। আর একথাও সত্য যে, আসন সংকট নেই কিন্তু মানসম্মত কলেজে শিক্ষার্থীদের আসন সংকট রয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী আরো বলেছেন, সামনে থেকে সেরা ১০ বা সেরা ২০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা হবে না। কেননা এর পেছনে কিছু অসাদুপায় শিক্ষক ও কর্মকর্তাগণ সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুনাম অর্জনের জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। আর এসব অনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রকৃত জ্ঞান অর্জন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে সদ্য প্রকাশিত হওয়া এসএসসিতে জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরা ভালো একটি কলেজে পড়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু যারা এ প্লাস পায়নি তারা কি স্বপ্ন দেখে না ভালো একটি কলেজে পড়ার? তাই বলতেই হয় স্বপ্ন দেখা সহজ কিন্তু বাস্তবে পরিণত করা অনেক কঠিন। স্বপ্ন সবাই দেখতে পারে কিন্তু সেই স্বপ্ন সবাই বাস্তবে পরিণত করতে পারে না।
এবার এসএসসিতে পাস করেছে ৯ লাখ ৬১ হাজার ৪০৫ শিক্ষার্থী। আর একাদশ শ্রেণিতে সারাদেশে আসন রয়েছে ১২ লাখ ৩৭ হাজার ৫৬৯টি। অপরদিকে মাদরাসায় দাখিল পাস করেছে ২ লাখ ২৯ হাজার ৬৬৬ জন। আর মাদরাসায় ফাজিল স্তরে আসন রয়েছে সোয়া দুই লাখ। কারিগরি স্তরে এসএসসি (ভোকেশনাল) পাস করেছে ৯১ হাজার ৪৫৭ জন। আর এই স্তরে আসন রয়েছে এক লাখ ৩০ হাজারের মতো।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য মতে, সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩ হাজার ৭৫৭টি। যার মধ্যে মানসম্মত কলেজের সংখ্যা মাত্র পৌনে ২০০ এর মত। এসব কলেজে আসন সংখ্যা ৫০ হাজারের মতো। অথচ এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় ৯৩ হাজার ৬৩১ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। এছাড়া মাদরাসা বোর্ডে ১১ হাজার ৩৩৮ জন। আর কারিগরি বোর্ডে ৬ হাজার ৯৩২ জন। সবমিলে এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ-৫-ধারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা সর্বমোট ১ লাখ ১১ হাজার ৯০১ জন। এছাড়া রাজধানীতে ভাল মানের কলেজ আছে মাত্র ২০-২২টি, যেখানে আসন সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি নীতিমালা অনুযায়ী, ৩০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর অনুমতি আছে এমন সব কলেজগুলো অনলাইনে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করার ব্যবস্থা নেবে। না পারলে সনাতন নিয়মে ভর্তি নিতে পারবে। তবে ৫০০ জনের বেশি ভর্তি আসন হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবশ্যই অনলাইনে ভর্তি নিতে হবে। সমান জিপিএ ৫ নিয়ে আবেদনকারীদের মধ্য থেকে যাদের নম্বর বেশি, তারা ভর্তির সুযোগ পাবে। শিক্ষার্থীরা নিজেদের নম্বর না জানলেও প্রত্যেক শিক্ষার্থীর নম্বর সংরক্ষণ করে নিজ নিজ শিক্ষা বোর্ড। অন্যদিকে একজন শিক্ষার্থী ৫টি কলেজে ভর্তির আবেদন করতে পারবে।
তাই একটি বিষয় এখন ভাবিয়ে তুলছে আর সেটি হচ্ছে,যে সব শিক্ষার্থীরা ভালো রেজাল্ট করে মানসম্মত কলেজে ভর্তি হতে পারবেন না তারা কোথায় ভর্তি হবেন?
তথ্যের ভিত্তিতে এবার মানসম্মত কলেজে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে প্রায় ৬২ হাজার শিক্ষার্থী। অর্থাৎ বলাই যায় মানহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব শিক্ষার্থীদের ভর্তি হতে হবে।
এই চিত্র যারা এবার এসএসসিতে এ প্লাস পেয়েছে শুধু তাদের। অন্যদিকে সকল শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় থাকে রাজধানীর নাম করা কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যে শিক্ষার্থীরা এপ্লাস পেয়েছে তারাও রাজধানীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধ্যায়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। এই প্রশ্নের উত্তর হয়ত কারো কাছেই নেই। কেননা বাংলায় একটা প্রবাদ আছে,সব ইচ্ছা হয় না পূরণ। ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা পছন্দের কলেজে পড়া থেকে বঞ্চিত হবে।
পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ মানবসম্পদ। এই সম্পদ রক্ষা করা ও তার উন্নয়নের প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানুষ কতদূর লেখাপড়া করছে, মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, তার ওপর। আজকের দুনিয়ার প্রায় সব দেশেই শিক্ষা প্রসারের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। তাইতো ভারতের বিখ্যাত রাজনীতিক গোপালকৃঞ্চ গোখলের কথায়, ‘‘একটি সরকার ভালো কী মন্দ তা তার শিক্ষানীতি দিয়েই বিচার করা যায়।’’
এদিকে ৩০ মে এসএসসি ফল প্রকাশের পর গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাওয়া ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর মা বলেছেন, তিনি তার মেয়েকে ‘ক্লাস নাইন থেকে দুটি বছর টানা কোচিং করিয়েছেন। এর জন্য প্রতি মাসে খরচ হয়েছে ২০ হাজার টাকা। গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাওয়া মেয়ের এই সাফল্যের পেছনে স্কুলের নয়, কৃতিত্ব আমাদের। আবার একথা বলার সময় তিনি কখনো হাসছিলেন আবার কখনোবা ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন।
তাই এখানে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়? আর সেটি হচ্ছে.. আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কি একটুও উন্নয়ন হয়নি? নাকি আমরা সেই আগের স্থানেই আছি। যে শিক্ষা অর্জন করে একজন শিক্ষার্থী সুশিক্ষায় শিক্ষিত হবে কিন্তু আসলে কি সেই শিক্ষার্থী প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করতে পারছে? একজন মেধাবী শিক্ষার্থীকে কতোটুকু মূল্যায়ন করা হচ্ছে সেটাই আজ ভাবার বিষয়?
আসলে কি আমাদের কোমল মতি শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা কিংবা জ্ঞান অর্জন করছে? সেটি কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? আমাদের শিক্ষার্থীরা যতটুকু শিক্ষা গ্রহণ করছে, তারচেয়ে বেশি পরিমাণ তারা পরীক্ষা দিচ্ছে।
উল্লেখ্য জাপানের মত একটি দেশে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত কোন শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা দিতে হয় না। কেননা তাদেরকে এই বয়স পর্যন্ত শুধু নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে প্লে গ্রুপের ছাত্র-ছাত্রীদের কতগুলো পরীক্ষা নেওয়া হয় তা আমরা কমবেশি সবাই জানি। এতে এই কমল মস্তিস্কে কি পরিমাণ চাপ পড়ে তা কি আমরা কখনো ভেবেছি? কিন্তু এর মানে এই নয় যে আমি পরীক্ষার ঘোর বিরোধীতা করছি।
যে হারে জিপিএ এর সংখ্যা বাড়ছে সেহারে কি আধৌ মেধাবীদের সংখ্যা বাড়ছে। যদিও গতবারের তুলনায় এ বছর জিপিএ এর সংখ্যা কমেছে। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ৯০১ জন, গতবছর এ সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪২ হাজার ২৭৬ । জিপিএ এর সংখ্যা বাড়লেই মেধাবীদের সংখ্যা বাড়ে না। কারণ আমরা মেধাবীদের যোগ্য মানুষ হিসেবে তৈরি করতে পারছি না।
কথায় বলে, ‘জলই জীবন’ কিন্তু কথা হল, বিশুদ্ধ জলই জীবন। কেননা যে জল জীবন দায়ী সেই জল বিশুদ্ধ না হলে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তাই আমরা চাই শহর ও গ্রামের সব স্কুলই ন্যূনতম মানসম্মত হোক। সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়া জরুরি নয়। শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা অর্থাৎ জ্ঞান অর্জন করছে কিনা সেটাই দেখার বিষয়!
তাই বলাই যেতে পারে ভালো রেজাল্ট করা শিক্ষার্থীদের কপালে এখন দুশ্চিন্তার ভাজ পড়তে শুরু করেছে। কেননা মানসম্মত কলেজের অভাবে অনেক শিক্ষার্থীর স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।
লেখক: শেখ জাহিদুজ্জামান
সাংবাদিক এবং কলামিস্ট
ফেনী থানা ছাত্র দল liked this on Facebook.