পদ্মা সেতুর টাকায় চীন ও হংকং সফরে গেছেন ছয় সাংসদ ও তাদের স্ত্রীরা!

নির্মাণকাজ দেখতে পদ্মা সেতু প্রকল্পের টাকায় চীন ও হংকং সফরে গেছেন ছয় সাংসদ। চার সাংসদের সঙ্গে গেছেন স্ত্রীরাও। সফরসঙ্গী হয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির একান্ত ব্যক্তিগত কর্মকর্তাও। তাঁদের দেখভাল করতে গেছেন সেতু বিভাগের দুই কর্মকর্তা।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, সব মিলিয়ে ১৩ জন এই সফরে গেছেন। ২২ মে তাঁরা ঢাকা ছেড়েছেন, ফেরার কথা ২৯ মে। এই সফরের আনুষ্ঠানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ লাখ টাকা। পুরোটাই বহন করা হচ্ছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রশিক্ষণ খাত থেকে। চার সাংসদের স্ত্রীর ব্যয়ভার তাঁরা নিজেরাই বহন করবেন বলে সরকারি আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে।
আদেশ অনুসারে সফরের উদ্দেশ্য হচ্ছে, পদ্মার মূল কাজ পাওয়া চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির নির্মাণ করা নানা অবকাঠামো পরিদর্শন।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, সাংসদেরা সেখানে চীনের বিভিন্ন শহর ঘুরছেন। থাকছেন দামি হোটেলে। যাতায়াতের জন্য গাড়ি ও গাইড সরবরাহ করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্মাণাধীন হংকং-ঝুহাই-ম্যাকাও সেতুও দেখতে যাবেন তাঁরা। প্রায় ৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুর একাংশের কাজ করেছে চায়না মেজর ব্রিজ।
তবে সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, সরকারিভাবে যে ব্যয় ধরা হয়েছে, তা দিয়ে সফর সম্পন্ন করা যাবে না। বাড়তি ব্যয় প্রয়োজন হতে পারে এবং তা প্রকল্পের ঠিকাদারদের কাছ থেকে নেওয়া হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, সরাসরি কাজ তদারক করেন, এমন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্যই এই বরাদ্দ। অথচ ভ্রমণ করছেন কারিগরি জ্ঞানহীন এবং প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট নন এমন ব্যক্তিরা।
চীন ও হংকংয়ের সেতু নির্মাণ কার্যক্রম দেখতে সেতু বিভাগের প্রকৌশলী ও পরামর্শকদের নিয়ে আটজনের আরেকটি দল ২৮ মে রওনা হবে। অবশ্য তাঁরা যাবেন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের (সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো) জন্য ধরা ব্যয় থেকে। এ ছাড়া পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চীনে যাওয়া-আসার মধ্যেই আছেন।
পদ্মা সেতু প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেতু বিভাগ। এটি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন। জানতে চাইলে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, সব মন্ত্রণালয়েই সংসদীয় কমিটির সদস্যদের ভ্রমণের রেওয়াজ আছে। তিনি এত দিন সেই সুযোগ দেননি। সাংসদদের পীড়াপীড়িতে রাজি হয়েছেন।
সরকারি ব্যয়ের বাইরে ঠিকাদারদের কাছ থেকে সুযোগ নেওয়ার বিষয় থাকে। এতে ভবিষ্যতে ঠিকাদারের কাজের মান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘাত তৈরি হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ঠিকাদারের টাকায় কিছু করা হবে না।
কারিগরি ও প্রশিক্ষণের টাকায় সাংসদদের ভ্রমণ প্রকল্পের কী কাজে আসবে জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তাঁরা বড় বড় প্রকল্প দেখে আমাদের মিটিংয়ে তা শেয়ার করবেন। অভিজ্ঞতা বিনিময় হবে।’
বর্তমানে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বড় তিন ঠিকাদার হচ্ছে মূল সেতুর চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি, নদী শাসনের চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন এবং সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামোর বাংলাদেশি আবদুল মোনেম লিমিটেড। এই তিন ঠিকাদার মিলে প্রকল্পের ২২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকার কাজ করছে, যা মোট ব্যয়ের প্রায় ৭৮ শতাংশ। চীনের দুটি কোম্পানি পেয়েছে ৭২ শতাংশ কাজ। গত এপ্রিল পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ১৮ শতাংশ।
সংসদীয় দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থায়ী কমিটির সভাপতি একাব্বর হোসেন। অন্য সদস্যরা হলেন এ কে এম এ আউয়াল, নাজমুল হক প্রধান, লুৎফুন্নেছা, মনিরুল ইসলাম ও নুরুজ্জামান আহমেদ। আরও আছেন একাব্বর হোসেনের স্ত্রী ঝর্ণা হোসেন, আউয়ালের স্ত্রী লায়লা পারভীন, নাজমুল হকের স্ত্রী জাহানারা প্রধান, লুৎফুন্নেছার স্বামী সুলতান আহমেদ মৃধা, একাব্বর হোসেনের একান্ত ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) ইকবাল বিন মতিন, সেতু বিভাগের উপপরিচালক এস এম লাবলুর রহমান ও পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মোহাম্মদ আবদুল কাদের।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রস্তাবে প্রশিক্ষণ বাবদ ১৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা। কিন্তু প্রশিক্ষণের এই টাকা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণেই ব্যয় হবে বলে প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান।
সূত্র জানায়, সাংসদদের পর সরকারের বাস্তবায়ন, মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ অধিদপ্তর (আইএমইডি), পরিকল্পনা কমিশন ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তাদের পর্যায়ক্রমে ভ্রমণে পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, প্রকল্প প্রস্তাবে প্রশিক্ষণ বাবদ রাখা অর্থের বাইরেও ঠিকাদার ও পরামর্শক নিয়োগের সময় প্রতিটিতে কারিগরি জ্ঞান বিনিময়ের নামে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে মূল সেতু ও নদী শাসন কাজে এ ধরনের সফরের কথা সবচেয়ে বেশি উল্লেখ রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে প্রকল্প বাস্তবায়নের পুরো সময়টাতেই প্রকল্প কর্মকর্তাদের পাশাপাশি অন্যদের ভ্রমণে পাঠানো হবে।
আরও ভ্রমণ: পদ্মা সেতু প্রকল্পের মালামালের গুণাগুণ পরীক্ষার জন্য এক সপ্তাহ চীনে ভ্রমণ করে এসেছেন প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, প্রকল্পের কর্মকর্তাদের ভ্রমণের এই ব্যয় বহন করছে চায়না মেজর ব্রিজ। কারণ, মেজর ব্রিজ পদ্মা সেতুর পিলারের ওপর যে স্টিলের কাঠামো বসাবে, এর কিছু কাজ চীনে সম্পন্ন করছে।
পদ্মা সেতুর প্রতিটি স্প্যান বা স্টিলের কাঠামো হবে ১৫০ মিটার। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি প্রতিটি স্প্যান চার ভাগের এক অংশ অর্থাৎ সাড়ে ৩৭ মিটারের একটি কাঠামো তৈরি করবে চীনে। এগুলো বাংলাদেশে এনে জোড়া দিয়ে একটি স্প্যান তৈরি করে বসানো হবে।
প্রকল্প কর্মকর্তা ও অন্য কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন প্রকৌশলীরা সেখানে গিয়ে স্টিলের মান, জোড়া লাগানোর প্রক্রিয়া ও ওয়েল্ডিং পর্যবেক্ষণ করবেন। যেহেতু ঠিকাদারের এ দেশেই এসব কাজ করার কথা, তাই প্রকৌশলীদের নেওয়ার খরচ তাদেরই বহন করতে হচ্ছে।
এর বাইরে ২৮ মে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কর্মকর্তা ও পরামর্শকদের নিয়ে গড়া আটজনের আরেকটি দল চীন ও হংকং যাবে। এই দলটিও সেখানে এক সপ্তাহ অবস্থান করবে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, আট কর্মকর্তার সফরের পুরো খরচ বহন করা হবে সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ তদারক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জন্য ধরা ব্যয় থেকে। এই দলটি হংকং-ঝুহাই-ম্যাকাও সাগরের ওপর নির্মাণাধীন সেতুর নির্মাণ কার্যক্রম ও ব্যবস্থাপনা বিষয়াদি দেখবে।সুত্রঃপ্রথম আলো

আতিক/প্রবাস

২৭ thoughts on “পদ্মা সেতুর টাকায় চীন ও হংকং সফরে গেছেন ছয় সাংসদ ও তাদের স্ত্রীরা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *