মালয়েশিয়ার উত্তরে থাইল্যান্ডের সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ি জঙ্গলে ২৮টি পরিত্যক্ত বন্দিশিবিরসহ ১৩৯টি গণকবরের সন্ধান মিলেছে। এসব গণকবরে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে সাগরপথে পাচারের শিকার শত শত বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গার লাশ। গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে দেশটির জাতীয় পুলিশ বাহিনীর মহাপরিদর্শক খালিদ আবু বকর এসব তথ্য জানান। দেশটির অভ্যন্তরে এতসংখ্যক গণকবর ও বন্দিশিবিরের সন্ধান মানব পাচার বাণিজ্যের ভয়ঙ্কর চিত্রই তুলে ধরে। এদিকে, এ ঘটনায় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এ জন্য দায়ীদের খুঁজে বের করা হবে। মানব পাচারে জড়িতরা পার পাবে না।
সাগরভাসা অভিবাসী সংকট সমাধানে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা চেয়েছেন। এদিকে, ইন্দোনেশিয়ায় উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে দেশটি। খবর বারনামা, ব্যাংকক পোস্ট, এএফপি, রয়টার্স, বিবিসি ও আলজাজিরার।
মালয়েশিয়ার পুলিশপ্রধান খালিদ আবু বকর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত ১৩৯টি গণকবরের সন্ধান পেয়েছে। ১১ থেকে ২৩ মে পরিচালিত অভিযানে এসব কবর চিহ্নিত করা হয়েছে, যার কোনো কোনোটিতে একাধিক দেহাবশেষ থাকতে পারে। এটি খুবই দুঃখজনক দৃশ্য। তিনি জানান, কবরগুলো থেকে দেহাবশেষ তোলার কাজ চলছে। প্রতিটিতে ঠিক কত লাশ রয়েছে, সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এর মধ্যে একটি গণকবরের অবস্থান গত মাসে থাইল্যান্ডে পাওয়া কবর থেকে মাত্র ১০০ মিটার দূরে।
রোববার মালয়েশিয়ার পেরলিস রাজ্যের পেদাং বেসার ও ওয়াং কেলিয়ান অঞ্চলের জঙ্গলে ৩০টি গণকবর পাওয়ার কথা প্রথম জানায় পুলিশ। গতকাল সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়ার পুলিশপ্রধান আরও বলেন, খুবই দুর্গম জঙ্গলময় ও পাহাড়ি এলাকায় এসব গণকবরের আশপাশে ২৮টি পরিত্যক্ত ক্যাম্পের সন্ধান মিলেছে। খালিদ আবু বকর জানান, ২৮ ক্যাম্পের মধ্যে বড়গুলোতে প্রায় ৩০০, মাঝারিগুলোর প্রতিটিতে শতাধিক এবং একেবারে ছোট ক্যাম্পে ২০ জন করে লোক রাখা যেত। কোনো কোনো ক্যাম্পে সপ্তাহ দুয়েক আগেও মানুষ থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
চলতি মাসের শুরুতে থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের গণকবর ও বন্দিশিবিরের সন্ধান পায় পুলিশ। দেশটির শংখলা প্রদেশের পাহাড়ি এলাকায় পাচারকারীদের ক্যাম্পে ওই গণকবরে ৩৫টি দেহাবশেষ পাওয়া যায়। এসব লাশ ছিল সমুদ্রপথে থাইল্যান্ড আসা বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের মরদেহ। এর পরই সাগরপথে মানব পাচারের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনায় আসে। তখন প্রতিবেশী মালয়েশিয়ার কর্মকর্তারা তাদের দেশে গণকবর ও বন্দিশিবির থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে। তবে শেষ পর্যন্ত পুলিশের কঠোর অভিযানে থাই সীমান্তঘেঁষা অঞ্চলেই মিলল এতসংখ্যক গণকবর।
ধারণা করা হয়, বিভিন্ন স্থান থেকে সাগরপথে আসা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের প্রথমে আনা হয় থাইল্যান্ডে। সেখানে জঙ্গলের মধ্যে পাচারকারীদের বিভিন্ন ক্যাম্পে তাদের রাখা হয়। পরে সময়-সুযোগমতো তাদের আবার নৌকায় করে অথবা স্থলপথে মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ায় পাঠানো হয়। থাইল্যান্ডের শংখলা প্রদেশ ও মালয়েশিয়ার পেদাং বেসারের ওই দুর্গম এলাকা ছিল পাচারকারীদের সেই রুট।
উদ্বিগ্ন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী: মালয়েশিয়ায় গণকবর পাওয়ায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার প্রত্যয় জানিয়েছেন তিনি। গতকাল সোমবার নিজের ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্টে নাজিব লিখেছেন, মালয়েশিয়ায় গণকবর পাওয়ায় আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এটা মানব পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে ধারণা করা হচ্ছে। নাজিব বলেন, মানব পাচারে জড়িতরা পার পাবে না। আমরা দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করব। তিন দিনের সফরে টোকিওতে অবস্থানরত নাজিব রাজাক জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে এক বৈঠকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই অভিবাসী সংকট থেকে উত্তরণে জাপানসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা চান।
লাশের হবে ফরেনসিক পরীক্ষা: এদিকে, মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমাদ জাহিদ হামিদি জানিয়েছেন, রয়াল মালয়েশিয়ান পুলিশের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা কবর থেকে লাশ তুলছেন। লাশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিহ্নিত করা হবে কারা বাংলাদেশি এবং কারা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা। তা ছাড়া গণকবরগুলোতে প্রকৃত কতগুলো লাশ রয়েছে, তা-ও নিশ্চিত হওয়া যাবে। লাশ উদ্ধারে ৬৯ জন পুলিশ কমান্ডো রয়েছেন। গতকাল দেশটির পার্লামেন্টে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ফরেনসিক ইউনিট লাশ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অভিজ্ঞ। তারা সম্প্রতি এ ধরনের একটি কাজে ইউক্রেন সফর করেছে।
বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠাচ্ছে ইন্দোনেশিয়া: এদিকে, সাগর থেকে উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে ইন্দোনেশিয়া। দেশটির আচেহ প্রদেশের আশ্রয়শিবিরে এক হাজার ৭২২ জন সাগরভাসা রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি রয়েছে। এদের ২৪৪ জন নারী ও ২৩৮টি শিশু। আচেহ কর্তৃপক্ষ বলছে, এদের মধ্যে সাত শতাধিক বাংলাদেশি নাগরিক রয়েছেন। ইন্দোনেশিয়ার সমাজকল্যাণমন্ত্রী খাফিফা ইন্দার পারাবানসা বলেন, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ‘নিবিড় যোগাযোগ’ রয়েছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশিদের পাঠানোর ব্যবস্থা করব। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশিদের ভ্রমণের কাগজপত্র ঠিক করা হচ্ছে। কাগজপত্র ঠিক করা হয়ে গেলেই দু-তিন দিনের মধ্যে বিমানে তুলে দেওয়া হবে। সব খরচ বহন করবে আইওএম।
সাগরে মেডিকেল টিম পাঠিয়েছে থাইল্যান্ড: সাগরভাসাদের জীবন রক্ষায় নিজেদের জলসীমায় হেলিকপ্টারে মেডিকেল টিম পাঠিয়েছে থাইল্যান্ড। থাই প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুত চান ওচা বলেন, সাগরে মেডিকেল টিম ও পুলিশ পাঠানো হয়েছে। কোনো অভিবাসীবাহী নৌকা দেখা গেলেই তাদের উদ্ধার ও তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেবে এই মেডিকেল টিম। ধারণা করা হচ্ছে, সাগরে এখনও আড়াই হাজারের বেশি অভিবাসী নৌকায় ভাসছে।
Sadeq Hasan Mridha liked this on Facebook.