বিএনপি দুর্বল হওয়ার দিন গুনছে জামায়াত

ভারতীয় জামায়াত ধর্মীয় ও ভাষাগত বহুত্ববাদ এবং উদারনৈতিক সংসদীয় গণতন্ত্র প্রায় স্বীকার করে নিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশী জামায়াত এখনও পর্যন্ত ধর্মীয় বহুত্ববাদ গ্রহণ না করতে একগুঁয়ে মনোভাব দেখিয়ে চলেছে। আর জামায়াত বুদ্ধিজীবীরা বর্তমান সংকট থেকে মুক্তি পেতে প্রধানত বিএনপির দুর্বল হয়ে পড়ার আশায় দিন গুনছে। কলকাতা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাইদুল ইসলাম লিমিটস অব ইসলামিজম বইয়ে ওই অভিমত ছাপা হয়েছে। সম্প্রতি ভারতে ক্যাম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত ওই বইয়ে লেখক বলেছেন, ভারতের জামায়াত ও বাংলাদেশ জামায়াতের মধ্যে বেশকিছু কৌতুহলোদ্দীপক ফারাক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাম্প্রতিককালে ভারতীয় জামায়াত ধর্মনিরেপেক্ষ-গণতান্ত্রিক ও বামপন্থি দলগুলোর দিকে ঘেঁষছে। অথচ বাংলাদেশ জামায়াত তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে ধর্মনিরেপেক্ষ ও বামপন্থি শক্তিসমূহকেই চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জামায়াত দুটি বিপরীতমুখী আচরণ দেখিয়ে চলেছে।
ভারতীয় জামায়াত ‘হিন্দুত্ববাদের’ মধ্যে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ এবং ‘সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ’ চিহ্নিত করেছে। আবার তারা ‘আমেরিকান হেজিমনি’, ‘নিওলিবারেল অর্থনৈতিক নীতি’ এবং ‘কর্পোরেট বিশ্বায়নের’ মধ্যে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ দেখছে। আর এ সবকে তারা কেবল ভারতীয় মুসলিমদের জন্যই নয়, ভারতের বৃহত্তর জনগণের প্রধান শত্রু হিসেবে গণ্য করে। আর বাংলাদেশ জামায়াতের প্রধান শত্রু হলো- তাদের দেশের ধর্মনিরেপক্ষ ও বামপন্থি শক্তিকে। শুধুই তাই নয়, বাংলাদেশ জামায়াতের আন্দোলন কর্মসূচির মধ্যে ‘নয়া উদারনৈতিকতাবাদ’ এবং কর্পোরেট বিশ্বায়নের মতো ইস্যু অর্থনৈতিক বিষয় তাদের কোন রাজনৈতিক এজেন্ডায় প্রায় দেখায় যায় না।
অধ্যাপক মাইদুল ইসলাম অবশ্য পরিষ্কার মন্তব্য করেছেন যে, ভারতের জামায়াত কেবল একটি প্রেসার গ্রুপ রয়ে গেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াত একটি রাজনৈতিক দল হয়ে উঠেছে। তারা অবশ্য বিরোধী দলে থাককালে তাদের সক্রিয়তা ও কার্যকরতা বেশি চোখে পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, ‘ জামায়াতে ইসলামী আন্দোলনের চরিত্র অন্যান্য মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো থেকে আলাদা। এখানে মৌলিক পার্থক্য আছে। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এটা প্রধানত আবাসন সুবিধা, পদ-পদবি ও পদোন্নতির জন্য কায়েমী স্বার্থের জন্য তারা এটা করে থাকেন। এখানে কোন বৃহত্তর সামাজিক বিষয় জড়িত নয়। আমরা ভিসির কাছে শিক্ষকদের জন্য কোন দাবি-দাওয়া তুলে ধরে কোন বিবৃতি দাখিল করি না। কারণ আমরা আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি এটা পূরণ করা হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সংগঠন দুর্বল, সেখানে সংগঠন বলতে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও নেটওয়ার্ক তৈরি করা। আমরা সাধারণত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে বিবৃতি দিয়ে থাকি।’
এখানে লক্ষণীয় যে, জামায়াতের পক্ষে এখন কেন বিএনপি নির্ভরতা মানতেই হচ্ছে তার একটা মূল কারণ ফুটে উঠেছে অধ্যাপক ওমর ফারুকের স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন, ‘আমরা ব্যাপক ভিত্তিক কোন আন্দোলনের উদ্যোগ নিতে পারি না। কারণ জনগণ আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে না। আমাদের অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ব্যাপক ভিত্তিক কোন আন্দোলন গড়ে তোলার যে মানসিক শক্তি লাগে তাও আমাদের নেই। আমরা সবসময় উৎপীড়নের ভয়ে থাকি। কারণ মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো এই রূপকথা সৃষ্টি করেছে যে, জামায়াত সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত।’
ভারতীয় জামায়াতের জ্যেষ্ঠ নেতা মাওলানা শফি মুন্সী বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে তাদের ব্যক্তিগত জীবনে খুবই ধর্মপ্রাণ এবং সে কারণেই ইসলামী আন্দোলনের জন্য উর্বর ভূমি। বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের জন্য গোলাম আযম একটি গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ভাল।’
মানারত ইন্টারনেশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক চৌধুরী মাহমুদ হাসান বলেন, জামায়াতের বড় সাফল্য হচ্ছে তারা বাংলাদেশের শিক্ষিত জনগণের একটি বড় অংশকে এটা বোঝাতে পেরেছে যে, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। অধ্যাপক মাহমুদ হাসান আরও বলেন, ‘জামায়াত যদি একাত্তরের রাজনৈতিক ভুল স্বীকার করে নিতে পারে তাহলে তার বদনাম চিরকালের জন্য ঘুচে যাবে।’ অধ্যাপক ওমর ফারুকের মন্তব্য হচ্ছে, ‘বাংলাদেশর জনগণের স্মৃতি খুবই দুর্বল।’ আর অধ্যাপক হাসান মনে করেন, ‘ বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিক স্বীকারোক্তিকে ক্ষমা করে দেয় যদি তা যথার্থ হয়ে থাকে। তাঁর আরও দাবি, জামায়াত এমপিরা জনগণের মধ্যে সর্বদাই অত্যন্ত জনপ্রিয় যদিও এ ধরনের প্রবণতা স্থানীয়ভাবে দেখা যায়। ইসলামের জন্য এটা আমরা জাতীয় ঢেউয়ে পরিণত করতে পারিনি, যা আমাদের নির্বাচনী ফলাফল থেকে স্পষ্ট। জামায়াতের অবশ্য সমৃদ্ধ গবেষণা সেলের ঘাটতি আছে।’ অধ্যাপক হাসানের মন্তব্য: ‘বিএনপি আদর্শগতভাবে শিথিল এবং একটি অসংগঠিত পার্টি। সুতরাং আমাদের চলমান সঙ্কট একমাত্র তখনই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতে পারে, বিএনপি যদি সাফল্যজনকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। কারণ এখনও পর্যন্ত বিএনপিই ভারত ও আওয়ামী লীগ বিরোধী ভাবাবেগ ধারণকারী একমাত্র রাজনৈতিক মঞ্চ।’
তবে অধ্যাপক মাইদুল ইসলাম তাঁর গবেষণার উপসংহারে বলেছেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উভয় দেশের জামায়াত পলিটিক্যাল মোবিলাইজেশন এবং তাদের রাজনীতি একটি আদর্শগত সংকটে ভুগছে। তাদের অনুসৃত ইসলামবাদ ভ্রান্তি ও স্ববিরোধিতার মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী ‘উম্মাহ’ মতবাদকে প্রাধান্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু এই ধারণা গোড়া থেকেই বিভ্রান্তিকর।’ শেষ।

৩ thoughts on “বিএনপি দুর্বল হওয়ার দিন গুনছে জামায়াত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *