কয়েদির মা

সেদিন ৮ মে। পাটগাতী বাসস্ট্যান্ড থেকে ঢাকাগামী লঞ্চ পারাপার বাসে উঠলাম হোস্টেলের উদ্দেশে। গাড়ি ছাড়ার ৩০ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম। চোখ থেকে যখন নিদ্রা বিদায় হলো, তখন বুঝতে পারলাম, আমি মাওয়া ফেরিঘাটে। গাড়ি থেকে নামলাম লঞ্চের উদ্দেশে। হঠাৎ দেখতে পেলাম, তিনজন বেড়ি পরা কয়েদিও আমার বাসের সহযাত্রী। একজন পুলিশের কাছ থেকে জানতে পারলাম, ওই তিনজনকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হচ্ছে।
সাধারণ মানুষ হাতকড়া পরা অবস্থায় আসামিদের অন্য জাতের গণ্য করে, আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। লঞ্চে বসে নিজেরই অজান্তে ওই তিনজন কয়েদির করুণ মুখের দিকে আমার চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল। তিনজনের দুজন স্থির অবস্থায় বসে ছিল। কিন্তু কালো শার্ট পরা লোকটিকে বেশ অস্থির মনে হচ্ছিল এবং পকেট থেকে একখানি সাদা কাগজ বের করে তার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল।
আমি বসেছিলাম লঞ্চের ভেতরে সামনের দিকে। আমার ডানে ছিল একজন পুলিশ আর বামে অপরিচিত একজন। কয়েদি তিনজনকে বসানো হয়েছিল পেছনের সারির এক সারি আগের সিটে।
কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে পুলিশের কাছে আবার প্রশ্ন করলাম, ‘কালো শার্ট পরা লোকটি কিসের আসামি?’ পুলিশ বলল, খুনের আসামি। শুনে আমার গা শিউরে উঠল। আবার পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেলাম কালো শার্ট পরা কয়েদির হাতে সেই সাদা কাগজ এখনো আছে।
আর বসে থাকতে পারলাম না। আমার সিট ছেড়ে কয়েদি তিনজনের পেছনের ফাঁকা সিটে গিয়ে বসে পড়লাম। উঁকি দিয়ে দেখলাম, কয়েদির হাতের কাগজটি একটি চিঠি। তাতে লেখা, ‘বাপ, তুই মন খারাপ করিস না, তোরে দেখতে আমার মন চায়, কিন্তু আসতে পারি না, তুই ভাবিস না, তোকে আমি ছাড়াবই। যে যা-ই বলুক, মনে রাখবি, তোর “মা” ছিল, তোর মা আছে, তোর মা তোর সাথে থাকবে।’ লঞ্চ থেকে নেমে আবার যখন বাসে উঠলাম, তখন আর ওই কয়েদিদের দেখতে পেলাম না।
বাসের মধ্যে হকারের কাছ থেকে একটি পত্রিকা কিনে পড়তে লাগলাম। তার প্রথম পাতায় লেখা, ‘আজ মা দিবস’! বুকের ভেতর কেন যেন ঝড় উঠল। চোখের অশ্রু আর বাঁধ মানে না। কার জন্য? হয়তো ওই হতভাগা কয়েদির জন্য, হয়তো তিনি মনে রেখেছিলেন, সেদিন মা দিবস। তাই হয়তো মায়ের স্মরণে চোখের জল উৎসর্গ করেছিলেন সবার অজান্তে। জানি না, এই সমাজের দণ্ডদাতারা তাঁকে কী সাজা দিয়েছেন। তবে হলফ করে বলতে পারি, মায়ের স্মরণে ওই দণ্ডিতের চোখের জলই তাঁর জন্য বড় সাজা হয়েছিল।

৩ thoughts on “কয়েদির মা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *