ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান
‘একজন নারীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে কয়েকজনে মিলে পিটাচ্ছে’ এমন একটি ছবি গত কয়েকদিন থেকেই ফেইসবুকে ঘোরাফেরা করছিল। যারা ছবিটি ফেসবুকে পোস্ট করেন তাদের অনেকেই বিষয়টি সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছিরেন বলেই মনে হয়েছে। ছবির পাশে লেখা ছিল সেনা সদস্য কর্তৃক নির্মম নির্যাতনের শিকার গৃহবধূ ববিতা।
প্রতি মুহূর্তেই ফেসবুকে মানুষ কত কিছুই না পোস্ট করছে, ফলে ঘটনাটি প্রথমে আমার কাছে মোটেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি, বরং কোনো নাটক কিংবা সিনেমার শ্যুটিংয়ের দৃশ্যের মতোই মনে হয়েছিল। কিন্তু না, এটি যে কোনো সিনেমা কিংবা নাটকের কাল্পনিক দৃশ্য নয়, বাস্তব ঘটনা! পরে তা বুঝতে পারি গত দুইদিনে সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে।
প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে যা জানা গেল তাতে, অনার্স পড়ুয়া কলেজছাত্রী ববিতার জীবনের গল্প যেন সিনেমা টেলিফ্লিম ও নাটককেও হার মানিয়েছে। শুধু তাই নয়, তার উপর নির্যাতন যেন হার মানিয়েছে মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও, হার মানিয়েছে আইয়্যামে জালিয়াতের রীতিনীতিকেও, প্রশ্নবিদ্ধ করেছে আমাদের এই একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতা-সংস্কৃতিকেও। ফলে আজ নিজেকেই নিজে বারবার প্রশ্ন করছি- আমরা কোথায় ফিরে যাচ্ছি? আমাদের এই নষ্ট সমাজের গন্তব্য কোথায়?
সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং স্থানীয় এক সাংবাদিকের কাছ থেকে ববিতার জীবনের গল্পে যা জানা গেলো তাতে, নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের শালবরাত গ্রামের ছালাম শেখের ছেলে সেনা সদস্য শফিকুল শেখের সঙ্গে পাশের এড়েন্দা গ্রামের ইসমাইল মোল্লার মেয়ে নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্রী ববিতার (২১) মন দেয়া-নেয়া হয় বেশ কয়েক বছর আগেই। গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। এর ফাঁকে শফিকুল যা করার তাই করেছে। এরপর অনেকটা চাপের মুখেই ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর গোপনে বিয়েও করে তারা। নববধূ সেজে শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার ভাগ্যও জোটেনি ববিতার।
এরইমধ্যে বিয়ের কিছুদিন পর থেকে যেন প্রেম নাটকের ইতি টানার চেষ্টা শুরু হয় শফিকুলের। এরপর স্বামী সিলেট সেনানিবাসে কর্মরত সেনা সদস্য শফিকুল শেখ ও তার শাশুড়ি তাকে ঘরে তুলে না নিতে টালবাহানা শুরু করে। ববিতার অনেক কাকুতি-মিনতিতেও যেন মন গলেনি ওদের। একপর্যায়ে আদালতে মামলা করেন ববিতা। এতে শফিকুল ও তার পরিবারের সদস্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
ববিতার মা খাদিজা বেগমের ভাষ্য মতে, ২৯ এপ্রিল শফিকুল ছুটিতে বাড়ি এসে ববিতাকে তাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বারবার খবর দেয়। ববিতা সরল মনে স্বামীর ডাকে সাড়া দিয়ে ওই বাড়িতে যান। যাওয়ার পরপরই তাকে ঘরে আটকে ফেলা হয়। পরদিন সকাল ৭টার দিকে তার স্বামী শফিকুল, ভাসুর হাসান শেখ, শ্বশুর সালাম শেখ, শাশুড়ি জিরিন আক্তার, চাচাশ্বশুর কালাম শেখ, প্রতিবেশী নান্নু শেখ ও আজিজুর রহমান আরজু মিলে ববিতাকে বাড়ির উঠানে গাছের সঙ্গে বেঁধে বেধড়ক লাঠিপেটা করে। চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। একপর্যায়ে জ্ঞান হারায় ববিতা। গ্রামবাসী সবাই যেন সিনেমা-নাটকের ন্যায় প্রত্যক্ষ করেছে এই দৃশ্য। এরপরও কেউ এগিয়ে আসেনি।
গ্রামবাসীর ভাষ্য- ওদের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস করেনি, এগিয়ে যায়নি ববিতার সহযোগিতায়। ক্ষমতার দাপট, কেননা ওরা সবাই আওয়ামী লীগ করে। আজিজুর রহমান আরজু বড় নেতা, কাশিপুর ইউপি আওয়ামী লীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক! পরে খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে ববিতাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে।
এ ঘটনার পর থেকে শফিকুল ও তার পরিবারের লোকজন সবাই পলাতক। ঘটনার ৫ দিন পর মঙ্গলবার রাতে ববিতার মা বাদী হয়ে লোহাগড়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছেন। শুধু গ্রেপ্তার হয়েছে শফিকুলের ভাই হাসান শেখ। নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আজিজুর রহমান আরজু তো এখনো প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর অন্যদের বাঁচানোর জন্য তৎপরতা চালাচ্ছেন। এ ঘটনার জন্য অনুতপ্ত প্রকাশ তো দূরের কথা তিনি উল্টো ববিতা ও তার পরিবারকে অপবাদ দিচ্ছেন এই বলে, ‘একটি মহল ববিতার সঙ্গে বিয়ের নামে ভুয়া কাবিননামা তৈরি করে শফিকুলের চাকরি খোয়ানোর জন্য এ ঘটনা ঘটিয়েছে।’
ববিতা ও তার মায়ের সর্বশেষ ভাষ্য মতে, মামলা তুলে নিতে তাদের হুমকি দেয়া হচ্ছে। এদিকে পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। গুরুতর আহত ববিতা এখন নড়াইল সদর হাসপাতালে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।
আমরা সবাই জানি, এক সময় তথা আইয়্যামে জাহেলিয়াত যুগে কন্যা শিশুদের জীবিত কবর দেয়া হতো। আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশেও সতীদাহ প্রথার মাধ্যমে বিধবা নারীদের মৃত স্বামীর সঙ্গে আত্মাহুতি দিতে বাধ্য করা হতো। ইউরোপে নারীদের বিনাকারণে কিংবা অপবাদে ডাকিনী হওয়ার মিথ্যা অভিযোগে জীবিত আগুনে পোড়ানো হতো। কী নির্মম-বর্বর যাতনা সহ্য করতে হয়েছে নারীদের। আজ আমরা দাবি করি, পৃথিবীব্যাপী নারীর অবস্থানে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর প্রতি ধারণার পরিবর্তন হয়েছে।
কিন্তু নড়াইলের লোহাগড়ায় গাছের সঙ্গে বেঁধে গৃহবধূ ববিতাকে নির্যাতনের ঘটনা আমাদেরকে কী মেসেজ দিচ্ছে! একজন সেনা সদস্য বাবা-মা, ভাই-বোন ও স্বজনদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় ববিতার উপর বর্বর নির্যাতন চালালো, আর আমরা গ্রামবাসী সবাই এটা নীরবে প্রত্যক্ষ করলাম। কোনো প্রতিবাদ করলাম না। এর চেয়ে নির্যাতনের ঘটনা আর কত নির্মম হতে পারে! ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা সবাই প্রভাশালী হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে এর বিচার নিয়ে।
দাবি উঠেছে অবিলম্বে এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টিমূলক শাস্তির। তাই প্রশাসনের উচিৎ সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে অপরাধীদের গ্রেপ্তার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। এটি যতো তাড়াতাড়ি করা সম্ভব হবে ততোই মঙ্গল। যেন ভবিষ্যতে এমন হীন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। অন্যথা আমাদের সমাজের আরো অধপতন ঘটবে। এতে ভেঙে পড়বে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা। এছাড়া এ ঘটনায় জড়িতরা উপযুক্ত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না পেলে সমাজে এক খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকাবে। এর সুদূর প্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আমাদের গোটা সমাজ ব্যবস্থার উপর। তাই প্রশাসন এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।
কলাম লেখক ও সমাজ বিষয়ক গবেষক।
ই-মেইল:sarderanis@gmail.com
Mukter Hossan liked this on Facebook.
Abul Kashem liked this on Facebook.
Likait Ali liked this on Facebook.