সালমানের আগে আরেক শক্তিমান অভিনেতা সঞ্জয় দত্তও জেল জীবন বরণ করেছেন। এখনও তিনি জেলে। সঞ্জয় জেলে গেলেও বলিউড তার পাশে ছিল, সালমানের পাশেও আছে। তবে সালমানের ব্যাপারটি অন্য রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। চোখের জলে ভাসছেন তার ভক্তরা। বলিউড জুড়ে বিরাজ করছে অন্যরকম শূন্যতা। ভক্তদের অভিযোগ, ‘চুলবুল পাণ্ডে’র সাজাটা বেশি হয়ে গেছে।
ভারতের বিচার ব্যবস্থা এমনিতে শক্তিশালী। হয়তো লোকচক্ষুর আড়ালে সেখানে কেউ কেউ বড় অপরাধ করে বেঁচে যান। তবে কোনো মামলা যদি একবার আলোচনায় চলে আসে, তাহলে সেখানে ‘নয়-ছয়’ হয় না বললেই চলে। রুবেল হোসেনের মামলার মতো সেখানে বিচার শেষ হওয়ার আগেই ‘কোনো তারকা ক্রিকেটার’কে নির্দোষ বলে দেয়া হয় না।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সালমানের সাজা এতটুকু বেশি হয়নি। সাধারণ কোনো মানুষ হলে সাজা হতো দশ বছর। সেক্ষেত্রে ‘অনিচ্ছাকৃত হত্যা’ প্রমাণ করতে না পারলে ফাঁসি কিংবা যাবজ্জীবন হত।
আপনি আজ যে কোমল সালমানকে দেখছেন, গাড়ি চাপা দেয়ার দিনগুলোতে সালমান কিন্তু এমন ছিলেন না। বেপরোয়া জীবন-যাপনে তখন তার কাছে সবাই ছিলেন শিশু। ২০০৭ সালে সালমানের নামে মামলা হওয়ার পর এক সাক্ষাৎকারে সালমান বলেন, ‘আমি যা করেছি, জেনেই করেছি। জানতাম শাস্তি পেতে হবে। ক্যামেরার সামনে চোখের জেল ফেলার মতো মানুষ আমি নই। জেলে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই যাব।’
আসলে সেদিন কী ঘটেছিল?
নাটকের শুরু ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। রাত তখন প্রায় দুইটা। জুহুর ‘রেন বার’ থেকে বেশ কয়েক পেগ বাকার্ডি সাদা রাম, আরও কিছু ককটেল আর চিংড়ি ও মুরগির ভাজাভুজি খেয়ে নিজের সাদা ল্যান্ডক্রুজারে উঠলেন সালমান। বসলেন ড্রাইভারের সিটে। সঙ্গে দেহরক্ষী পাটিল। প্রথমে গেলেন জুহুর পাঁচ তারা জে ডব্লিউ ম্যারিয়ট হোটেলে। সেখানে কিছুক্ষণ কাটানোর পরে গাড়ি এগোল বান্দ্রার দিকে। তখনও চালকের আসনে সালমান। এই বান্দ্রাতেই সমুদ্রের সামনে সালমানের ফ্ল্যাট— গ্যালাক্সি অ্যাপার্টমেন্ট। তার খুব কাছে আমেরিকান এক্সপ্রেস বেকারি। বেসামাল চালক হঠাৎ গাড়ি তুলে দিলেন বেকারির সামনের ফুটপাথে। সেখানে শুয়ে কয়েক জন ফুটপাথবাসী। নিমেষে তাঁরা পিষ্ট হলেন সালমানের এসইউভি-র তলায়। চাপা পড়ে মারা গেলেন এক জন। জখম চার। তাঁদের মধ্যে তিন জনের অবস্থা বেশ গুরুতর।
পাটিল ছিলেন সেই ঘটনার প্রথম ও প্রধান সাক্ষী। ঘটনার কিছু দিন আগেই সালমান খান পুলিশের কাছে নিরাপত্তা দাবি করে জানিয়েছিলেন, তাঁর প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। তখন পাটিলকে সালমানের দেহরক্ষী নিয়োগ করা হয়। সেই রাতেই পাটিল থানায় গিয়ে পুলিশকে জানিয়েছিলেন, তিনি সেদিন সালমানকে মদ্যপান না করতে অনুরোধ করেছিলেন। কারণ, তিনি নিজে গাড়ি চালাতে পারেন না। গাড়ি সালমানকেই চালাতে হবে। সালমান তাঁর কথায় কান দেননি। সালমানকে গ্রেফতার করা হলেও সে দিনই তাঁকে জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়। নয়দিন পরে অবশ্য আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন সালমান। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে মুম্বাই পুলিশ। ১৭ দিন পরে পাকাপাকি ভাবে জামিন পান তিনি।
চলতে থাকে মামলা। ২০০৬ সালে যখন প্রত্যক্ষদর্শীদের জেরা করা হচ্ছে, তখন আচমকা উধাও হয়ে যান পাটিল। তাঁর পরিবার নিখোঁজ মামলা দায়ের করে। আদালতে পাঁচ দিন হাজিরা না-দেওয়ার পরে বিচারক নির্দেশ দেন, পাটিলকে গ্রেফতার করে আদালতে পেশ করতে হবে। ২০০৬-এর মার্চে মহাবালেশ্বর থেকে পাটিলকে গ্রেফতার করে ক্রাইম ব্রাঞ্চ। কিন্তু ঘটনার পরে যে পাটিল প্রথম পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন, সেই তিনিই হঠাৎ কেন আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময়ে ‘গা ঢাকা’ দিলেন, সে প্রশ্ন তুললেন না প্রশাসনের কেউই। হাই প্রোফাইল মামলায় অনেক সময়েই সাক্ষীদের যে নিরাপত্তা দেওয়া হয়, তা-ও দেওয়া হয়নি পাটিলকে। কিছু সাংবাদিক দাবি করেছিলেন, বয়ান পাল্টানোর জন্য পাটিলের ওপর ভয়ঙ্কর চাপ দিত সালমানের পরিবার। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কেউ প্রমাণ দিতে পারেননি।
গ্রেফতারের পরে দাগী অপরাধীদের সঙ্গে পাটিলকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আর্থার রোড জেলে। কয়েক মাস পরে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে পাটিল দেখেন, তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁর পরিবারও তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে অস্বীকার করে। আবার নিরুদ্দেশ হয়ে যান পাটিল। ২০০৭ সালে সেওরি মিউনিসিপ্যাল হাসপাতালে খুঁজে পাওয়া যায় তাঁকে। খারাপ ধরনের যক্ষ্মায় আক্রান্ত। সে বছরই ৪ অক্টোবর মারা যান তিনি।
পাটিলের মৃত্যুর পরে উপযুক্ত সাক্ষ্যের অভাবে ধামাচাপা পড়ে যায় সালমান মামলা। ২০১১-এ সালমানের বিরুদ্ধে আরও কঠিন ধারা প্রয়োগের আর্জি জানান সরকারি আইনজীবী। সেই শুরু। একের পর এক মিথ্যা সাক্ষ্য, মিথ্যা দাবি। যেমন, চূড়ান্ত সাজা ঘোষণার মাসখানেক আগে সালমানের গাড়ির চালক অশোক সিংহ আচমকা দাবি করে বসেন সে রাতে সালমান নন, তিনিই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। (মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য গতকাল অশোককে তিরস্কার করেছে আদালত।) সালমানও আদালতে বলেন, সেই রাতে বারে বসে মদ খাননি তিনি। সালমানের আইনজীবীর বক্তব্য ছিল, ‘যে সাদা রংয়ের পানীয়টি সালমান খাচ্ছিলেন, সেটা আদপেই বাকার্ডি রাম নয়। শুধুই পানি।’ আইনজীবী বলতে থাকেন, সালমান নার্ভের অসুখে ভুগছেন। তিনি যে কত সাধারণ-দরদি, তার ভূরিভূরি তথ্য-প্রমাণ পেশ করা হয়।
কিন্তু গতকাল মুম্বাই নগর দায়রা আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে আনা সাতটি অভিযোগেই দোষী সাব্যস্ত হন সালমান। পৌনে বারোটায় এই রায় দিয়ে বিচারক জানান, একটা দশে সাজা ঘোষণা হবে। সরকারি আইনজীবী আরও এক বার দাবি করেন, সলমনকে সর্বোচ্চ সাজা, অর্থাৎ ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হোক। সালমানের আইনজীবীরা নানা কারণ দেখিয়ে বলতে থাকেন, সাজা তিন বছরের বেশি যেন না হয়। বাংলাদেশ সময় ১টা ৪০মিনিটে বিচারক ঘোষণা করেন, পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলো সালমানকে। তাঁকে আর্থার রোড জেলে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাঁকে জেলে যেতে হয়নি।
সালমানের আইনজীবীরা তৎক্ষণাৎ ছোটেন বম্বে হাইকোর্টে। অন্তর্বর্তী জামিনের আপিল করা হয়। দশ মিনিটের শুনানির পরেই জামিন মঞ্জুর হয়। বিচারপতি বলেন, যেহেতু গোটা বিচারপর্বেই সালমান জামিনে ছিলেন এবং নিম্ন আদালতের রায়ের কপি এখনও হাতে পাননি, তাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে আরও সময় দরকার। বিচারপতি বলেন, সালমানের আইনজীবীর সওয়াল শুনে তাঁর মনে হয়েছে যে ৮ তারিখের মধ্যেই সালমান রায়ের কপি পাবেন। তাই ওই দিন পর্যন্ত তাঁর জামিনের মেয়াদ বাড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি। তবে, এ জন্য সালমানকে নিম্ন আদালতে নতুন করে বন্ড দাখিল করতে হবে। দুই দিনের জামিন নিয়ে ৫ বছর জেলে থাকার প্রস্তুতি নিতে রাত আটটার দিকে বাড়ি ফেরেন সালমান।
২০০২ সালের সেই রাতে ঘটনাস্থল থেকে চম্পট দেওয়ার সময়ও ভেঙে পড়েছিলেন সালমান। শুধু বন্ধু ও প্রতিবেশী ফ্রান্সিস ফার্নান্দেজকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘আমায় বাঁচাও ভাই।’ এরপর ২০০৭ সালে সালমান বলেছিলেন, ‘জেলে গেলেও আমি কাঁদব না।’
সালমান কিন্তু কথা রাখতে পারলেন না। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি কেঁদেছেন। আট বছর আগের সালমান আর এই সালমানে যে বিস্তর পার্থক্য। বলতেই হয়, ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়। কারণে-অকারণে বদলায়।’ বদলায় না শুধু নিয়তি!
Mukter Hossan liked this on Facebook.
Hossain Shahid Sarwardy liked this on Facebook.
Mohammed Anam liked this on Facebook.
Singer Boy Tanvir liked this on Facebook.
Hi Mizan liked this on Facebook.