ববির হঠাৎ সরে যাওয়ার নেপথ্যে

ঢাকা: দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে মেয়র প্রার্থী হয়ে জাপা চেয়ারম্যানের বিশেষ উপদেষ্টা ববি হাজ্জাজ বহিষ্কার হন। তারপরও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকার ঘোষণা দেন তিনি। এজন্য মাঠে দু’সপ্তাহ প্রচারণাও চালিয়েছেন পুরোদমে। তার পেছনে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীসহ নজরে পড়ার মতো লোকজন ছিলে। অনেকে তার মধ্যেও সম্ভাবনা দেখতে শুরু করেছিলেন।

কিন্তু গত ৯ এপ্রিল হঠাৎ করেই সংবাদ সম্মেলন করে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলেন ববি। সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীদের সঙ্গে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করতে না পারার দায় নির্বাচন কমিশনের ঘাড়ে দিয়ে তিনি নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তের ব্যাপারে মোটা দাগে এটুকু বললেও সংবাদ সম্মেলনের পুরো বক্তব্যে অনেক কিছুর দিকেই ইঙ্গিত করেছেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমার ওপর চাপ আসছে। এ চাপ কেমন আমি বোঝাতে পারবো না। কিছু ডকুমেন্টস দেখানো যায় না।’

এদিকে ববির মনোনয়ন প্রত্যাহরের পরই বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে, মূলত জাপার পক্ষ থেকে সরকারের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে (যদিও এ ব্যাপারে সরকার দলেরও চিন্তাভাবনা ছিল)। কেননা উত্তরে জাপার জরিপ বলছে, সেখানে তাদের দলীয় প্রার্থী কোনভাবেই বিজয়ী হতে পারবেন না। কারণ হিসেবে ওই জরিপে আরও উঠে এসেছে, জাপার অনেক নেতাকর্মীই ববির পক্ষ নিয়ে কাজ করছে। এমননি উত্তরের ২৬টি থানার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে ২৫টি থানার দায়িত্বশীল নেতারা তার পক্ষ নিয়েছে।

অবশ্য শুরুতেই ববির পক্ষ হয়ে কাজ করার অপরাধে জাপার ভাইস চেয়ারম্যান এটিএম গোলাম মাওলা, জাপার সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক আহমেদসহ এক ছাত্রসমাজের নেতারা দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। জানা যায়, পাশাপাশি আরও একটি তালিকা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। শুধু তিনজনকে বহিষ্কার করেই জাপার নীতিনির্ধারণী ফোরাম ক্ষান্ত হয়নি; উত্তরের সব থানার কমিটি ভেঙে দেয়ারও হুমকি দেয়া হয়েছিল বলে জাপার একটি সূত্র জানিয়েছে।

অবশ্য এ হুমকির বিষয়টি কোনভাবেই স্বীকার করেননি উত্তরের সভাপতি প্রেসিডিয়াম সদস্য এসএম ফয়শাল চিশতী। তিনি এক কথায় বলেছেন, ‘এ কথা সত্য নয়’।

আরও জানা যাচ্ছে, তৃণমূল নেতাকর্মীরা যখন ববির পক্ষে কাজ করতে মাঠে সক্রিয় হয় তখন বেশ বিপাকে পড়েন জাপার মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, পানি সম্পদ মন্ত্রী আনিছুল ইসলাম মাহমুদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য এসএম ফয়সাল চিশতী, যুব সংহতির সভাপতি অ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভুইয়াসহ আরও অনেক নেতা। তারা এরশাদকে বিষয়টি জানালে তিনি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের নির্দেশেই প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গা থেকে ওই রাতে ফোন করা হয় ববিকে।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা ফোনে ববির বাবা ধনকুবের ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরকে যুদ্ধাপরাধী বানানো এবং দুদকের মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেয়া হয়। আর এ ঘটনা ঘটে তার মনোনয়ন প্রত্যাহারের আগের দিন মধ্যরাতে। ফলে ওই রাতেই তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন।

সূত্র জানায়, নির্বাচনের মাঠকে নিজের দখলে নিতে ববি প্রথম থেকেই ছক আঁকতে শুরু করেন। তিনি জাপা ছাড়াও বেছে নেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনেক অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ‘ক্ষুধার্ত’ নেতাকর্মীদের । এছাড়া দলের বাইরে থেকে একজনকে মেয়র প্রার্থী করায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তৃনমূল নেতাকর্মীদের অনেকে ক্ষুব্ধ। আর সেই সুযোগটি কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন ববি হাজ্জাজ।

শুধু তা-ই নয়, উত্তর সিটি করপোরেশনের কয়েকজন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতার সঙ্গে তার বৈঠক করার কথাও জানা গেছে। বিষয়টিও পরে ফাঁস হয়ে গেলে জানতে পারেন শীর্ষ নেতারা।

অপরদিকে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বাইরে এবং কোণঠাসা থাকায় দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মী নিজেদের প্রার্থীর বাইরে ও রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য অনেকেই আশ্রয় খোঁজেন ববির কাছে।

ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের অসন্তোষ ও বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতাকে পুঁজি করেই শুরু থেকে এগুতে থাকেন তিনি। এই দু’দলের তৃণমূল নেতাদের পেছনে টাকা ঢেলে পক্ষে কাজ প্রতিশ্রুতিও আদায় করেন।

অপরদিকে আওয়ামী লীগের একটি সূত্রে জানা গেছে, মাঠ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আনিসুল হকের পক্ষে আহামরি সাড়া নেই। ববির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে তিনি ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ ভোট পেতে পারেন বলেও আওয়ামী লীগের একটি মাঠ জরিপে উঠে আসে। আর এমনটি টের পেয়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের অনেক নেতা দিনে আনিসের সাথে আর রাতে ববির সাথে কাজ করেছেন বলে দাবি করছে একটি সূত্র।

তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা মাঠ পর্যায়ের এ জরিপ মানতে রাজি নন ।

তৃণমূল পর্যায়ে উত্তরের ক্যান্টেনমেন্ট থানা, মিরপুর থানা, পল্লবী থানা, খিলক্ষেত থানার অনেক জাপার নেতারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শুধু ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতারাই নয় এমনকি বিএনপির নেতা, ছাত্রদল ও যুবদলের নেতারাও ববির সঙ্গে কাজ করেছেন তার মনোনয়ন প্রত্যাহারের আগের রাত পর্যন্ত।

তবে এ বিষয়টি একেবারেই গুজব ও মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন জাপার মহাসচিব জিয়াউদ্দন আহমেদ বাবলু। তিনি বলেন, ‘এসব মিথ্যে কথা। সেতো আমাদের পার্টির কেউ না। তাহলে আমরা তাকে কেন প্রত্যাহার করার জন্য চাপ দিবো। আমাদের যে প্রার্থী আছেন তার বিজয়ের ব্যাপারে জাপা শতভাগ আশাবাদী।’

৯ thoughts on “ববির হঠাৎ সরে যাওয়ার নেপথ্যে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *