প্রবাসের গল্প – ৭

ছাব্বিশ বছর পরে এই প্রথম কানাডাতে এক বাংলাদেশী গায়ে হলুদের অনুষ্টানে গেলাম। আমার বন্ধু স্বপ্নার ছেলে ফায়সালের গায়ে হলুদ। খুব সুন্দর ছিল অনুষ্টান। ফায়সার আর আয়শাকে অনেক সুন্দর মানিয়েছে, মাসাল্লাহ। আল্লাহ্‌ ওদের দুজনকে আজীবন একসাথে সুখে শান্তিতে বাঁচিয়ে রাখুক। খাবার খুব সুন্দর। সব চাইতে মজার ছিল রসগোল্লা। একটা রসগোল্লার ভেতরে অন্য আর একটা রসগোল্লা। স্বপ্নার তিন ছেলে । সবাই খুব ট্যালেন্টেড মাশাল্লাহ। স্বপ্না আর দুলাভাই অনেক আদর করেন আমাকে। স্বপ্না আমাকে একটা সবুজ শাড়ি উপহার দিয়েছে। ছেলের গাঁয়ে হলুদের আমার বন্ধু রানু এসেছিল, লাবু ভাই, এশা, রাজীব। আজ দুপুরে আমি গেছিলাম কাজে। কাজ থেকে সোজা গেলাম স্কারবোরো হারমনি হলে গাঁয়ে হলুদের অনুষ্টানে। বাইরে কনকনে শীত। একটা লেদার জ্যাকেট পরে বাসের জন্য অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে ভাবলাম বাসাতে ফিরে যাই। যেয়ে একটা লম্বা ঘুম দেই। তারপর ভাবলাম স্বপ্না ও রানু দুইজনেই আমাকে অনেকবার বলেছে যেতে, অনেকদিন পরে রানুকে দেখবো, কথা হবে আর ওদের ছেলেদের বউদের সাথেও দেখা হবে ইত্যাদি ভেবে বাসে উঠলাম কিন্তু স্টপ মিস করেছি । এত শীতে আবার ফিরতি বাসে উঠতে হবে। এশাকে ফোন দিলাম। রাজীব এসে আমাকে নিয়ে গেল। অনেক দূর থেকে অনেক শীতে অতঃপর গাঁয়ে হলুদের অনুষ্টানে পৌছুলাম। আমার লেদার জ্যাকেটটা যথারীতি হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রেখে স্কার্ট থেকে শাড়িতে পোষাক বদলে নিলাম। স্বপ্না আমার জন্য শাড়ী কিনেছে, ব্লাউজ কিনেছে একেবারে ফিটফাট। আমি আগে কখনও গাঁয়ে হলুদের অনুষ্টানে যাইনি। ছবি দেখেছি শুধু। এই প্রথম গেলাম। অনেক মেহমান সেখানে। সবাই স্বপ্না, দুলাভাই ও ছেলেদের বন্ধুবান্ধব কিছু আত্মীয় স্বজন, কিছু অফিসের সহকর্মী। ছেলেমেয়েরা নাটক করলো, নাচ, গান, অভিনয়, সবকিছু খুব চমৎকার ।

তারপর এলো ঘরে ফেরার পালা। আমি যথারীতি জ্যাকেট রাখার জাগাতে এসে দেখলাম আমার লাল স্কার্ফ একাকী ঝুলছে। আমার ১০০ ডলারের লেদার জ্যাকেট নাই। কে যেন নিয়ে গেছে। হতে পারে ভুল করে নিজের জ্যাকেট ভেবে নিয়ে গেছে।

এই অনুষ্টানে সবাই মোটামুটি বাংলাদেশী মেহমান ছিল। বাইরের কেউ বলতে একজন সিকিউরিটি গার্ড। যে সম্ভাব্য সব জাগাতে খুজেও পেলোনা।

LeatherJacket_n LeatherJacket1
রানুদের সাথেই আমার ফেরার কথা ছিল। ফিরে এলাম। পথে সবাই মিলে লেদার জ্যাকেট সম্পর্কে বেশ কৌতুক করলাম। তিন বছর আগে আমি বিয়ে প্রতারণার কারণে ত্রিশ হাজার ডলারের একটা ধাক্কা খেয়েছি। তারপর আমার অফিসের মালিক আর্থিকভাবে দেওলিয়া হয়ে যাবার ফলে আট হাজার ডলারের বকেয়া বেতন পাইনি। এমন এক সময় যখন আমি ঋণের পাহাড়ে হাসিমুখে বসে আছি তখন লেদার জ্যাকেট হারিয়ে ভাবলাম — পরিক্ষা করার জন্য আল্লাহ্‌ বারে বারে আমাকেই কেন বেছে নেন? আল্লাহ্‌র উপরে অনেক রাগ করেছি আমি কাল রাতে । সিরিয়াস রাগ। রাতে বাসায় ফিরে নামায পড়িনি। সকালে ফজরের নামাযের সময়ে উঠিনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে অনেক মন খারাপ ছিল।

আজ ভেবেছি আমি কিছুই করবোনা। কোন কাজ করবোনা। এশার বাসাতে যেয়ে রানুদের সাথে বসে বসে আড্ডা দিবো। হঠাৎ স্বপ্নার ফোন পেলাম। আমার লেদার জ্যাকেট পাওয়া গেছে!!!!

স্বপ্নার এক আত্মীয়া ভুল করে জ্যাকেটটা নিজের ভেবে নিয়ে গেছে। সে যখন পার্টিতে আসে তখন তার জ্যাকেটটা গাড়িতে ফেলে আসে। পার্টি শেষে ভুল করে আমার জ্যাকেটটা নিয়ে যায়। পরে সে বুঝতে পারে যে ভুল করে অন্য কারু জ্যাকেট নিয়ে এসেছে তখন স্বপ্নাকে ফোন করে।
লেদার জ্যাকেটের অকস্মাৎ হারিয়ে যাওয়া ছিল নিছক একটি ভুল বা অন্যমনস্কতা। যারা পেয়েছেন তারা জ্যাকেটটি আমার বাসাতে এসে ফিরিয়ে দিয়ে যান। অন্যমনস্কতার কারণে দুঃখ প্রকাশ করেন।

ভুল সবাই করে। আমিও অনেক সময় অনেক ভুল করি। মানুষ মাত্রই ভুল করবে। যারা তাদের ভুলকে স্বীকার করে এবং ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয় তারাই সত্যিকারের মানুষ। আমি আমার ভুল স্বীকার করি। আমি আমার ভুল সুদ্ধ করার জন্য অনেক পথ হেটে যেতে পারি। আমার ভুলের কারণে যদি কারু ক্ষতি হয় তাহলে আমি অনুতপ্ত হই ও ক্ষতিপূরণের চেস্টা করি। যে মিস্টি মেয়েটি আমার জ্যাকেটটি ভুল করে নিয়ে যায় সে তার মিষ্টি হাসি ও লজ্বা মেশানো সুন্দর দীঘল কালো চোখ আমার চোখে রেখে বলেছে – আমি দুঃখিত।

স্বপ্নার ফোন পাবার আগে আমি আল্লাহ্‌র সাথে বোঝাপাড়া করছিলাম। আল্লাহ্‌ সবসময় আমাকে বিস্মিত করেন। মিষ্টি মেয়ে তোমাকে ধন্যবাদ।   প

 

২ thoughts on “প্রবাসের গল্প – ৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.