অপরাধ ফিল্টার

আমাদের সমাজে অপরাধ প্রতিষ্টিত করা অনেক সহজ। ন্যায় প্রতিষ্টা করার কোন প্রচেষ্টা নেই। আমাদের সমাজ ব্যক্তিকেন্দ্রীক সমাজ। অর্থাৎ যার যার ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধার জন্য অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে ধীরে ধীরে অন্যায়কেই ন্যায় হিসাবে প্রতিষ্টিত করে ন্যায়কে সম্পুর্নভাবে অদৃশ্য করে দেওয়া হয়েছে। একজন মানুষ ৩০-৪০ বছর কাজ করে যখন পেনসন পান তখন সেই পেনসনের টাকা উঠানের জন্য ঘুষ দিতে হয়। যে ঘুষ নেয় সে যখন পেনসনের টাকা উঠাতে যাবে তখনও ঘুষ দিয়েই উঠাবে। কলেজে ভর্তি হতে গেলে কলেজের ভর্তির ফর্ম নেবার জন্য টাকা দিতে হয়। বাংলাদেশের মিনিস্ট্রিগুলোতে ঘুষ না দিলে কোন কাজই হয়না। সবাই যার যার কাজ করিয়ে নেবার জন্য যখন ঘুষ দেয় তখন এইটা চিন্তা করে যে “আমার কাজটা তো হোক” – নিজের কর্ম সমাধা করার জন্য ঘুষ দেয় এবং অন্যায়কে প্রতিষ্টিত করে। পরবর্তীকালে এইটা প্রতিষ্টিত হয় যে “ঘুষ না দিলে এই কাজ হবেনা”। জমি রেজিস্ট্রি করাতে গেলে মিনিস্ট্রিতে ঘুষ দিতে হয়। যারা ঘুষ দিবে তাদের জমি রেজিস্ট্রি হবে যারা ঘুষ দিবেনা তাদের জমি রেজিস্ট্রি হবেনা। যাদের ঘুষ দেবার ক্ষমতা নাই তারা কিছুই করতে পারবেনা। যারা ঘুষ নেয় তারা কি বেশী অপরাধি নাকি যারা ঘুষ দেয় তারা ? কেউ যদি কারুকে ঘুষ না দিতো তাহলে সরকারী অফিসের আমলারা কিভাবে গুলশান, বনানী, বারিধারা, লন্ডন, আমেরিকাতে বাড়ি বানাতো ? গ্রামের বাড়িতে বিশাল বাগান, পুকুর, ধানী জমি, আর জমিদারী কিভাবে বানাতো ? অমুক ব্যক্তি খুব সৎ সেক্রেটারী ছিল। তার গুলশানে বাড়ি, আমেরিকাতে বাড়ি, ছেলেমেয়েরা সব ডাক্তার, জজ, বারিস্টার, গ্রামের বাড়িতে বিশাল সম্পদ, কিন্তু বেতন ছিল মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। উনি খুব সৎ ছিলেন। সাড়া জীবনে কোনদিন কারু কাছ থেকেই ঘুষ নেন নাই। এইসব বাড়িগাড়িজমজমা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচা সবই আকাশ থেকে টপ টপ করে ঝরেছে। সৎ হইলেই এই রকম আকাশ থেকে সব সম্পদ ঝরে। এক তো চুরি করে সবা বানিয়েছে তার উপরে মিথ্যা দিয়ে এই চুরি ঢেকেছে। সমাজে এইভাবে অন্যায় প্রতিষ্টিত হয়েছে। ঘুষের প্রচলন প্রতিষ্টিত হয়েছে।

চাকুরী পেতে গেলে ঘুষ দেওয়া লাগে। শিক্ষাগত যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতার জন্য কেউ চাকুরি পায়না। চাকুরী পেতে গেলে মামা থাকতে হয় আর টাকা থাকতে হয়। বিদেশে যেতে গেলে প্রচুর পরিমানে টাকা দেওয়া লাগে। বিদেশে যেয়ে চাকুরী করে সেই টাকা উঠানোর কোন খবর থাক বা না থাক আদম ব্যাপারীদের হাতে প্রচুর পরিমান টাকা দিয়েই তবে প্লেনে উঠার সুযোগ পাওয়া যেতে পারে। অনেকে সে সুযোগও পায়না। টাকা দেবার পরে আদম ব্যপারী প্রতারক আনোয়ার পারভেজের মত হাওয়া হয়ে যায়। যে যত সুন্দর করে মিথ্যা কথা বলতে পারে সে তত বেশী অন্যায়কে প্রতিষ্টিত করতে পারে। সমাজের মানুষ মিথ্যা কথা অনেক বেশী পছন্দ করে। সেজন্য রাজনীতিবিদেরা ভাল ব্যবসা করছে। সমাজের সকল প্রকার দুর্নীতি ও অন্যায়ের প্রতিনিধি হলো রাজনীতিবিদেরা।  এরা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে জনগনকে প্রভাবিত করে। রাজনীতিবিদেরাই দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও আমলাদের প্রতিনিধি হিসাবে দেশের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অপরাধের বীজ বপন করে প্রতিদিন। অপরাধকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসাবে সমাজে প্রমোট করে ও প্রতিষ্টিত করে। জনগনকে দিবারাত্র শাখের করাতের উপরে রেখে দেয়। অপরাধ ভিত্তিক সমাজে অন্যায়ই এখন ন্যায় হিসাবে প্রতিষ্টিত। অন্যায় করা এবং করানো একটি স্বাভাবিক নিয়ম। তাহলে অস্বাভাবিক কি?

আমাদের আইন আদালত ও আইনরক্ষাকারী সংস্থা সমাজে প্রতিষ্টিত অপরাধ রক্ষার জন্য অপরাধীদের হয়ে কাজ করে। আইন আদালত ও আইনরক্ষাকারী সংস্থা এখন অপরাধ প্রচার, অপরাধের প্রসার, অপরাধ রক্ষা ও প্রতিষ্টিত অপরাধ প্রয়োগ সংস্থা হিসাবে কাজ করে থাকে। যারা অপরাধ করেনা তাদেরকে সেজন্য পুলিশ গ্রেফতাঁর করে ভুয়া মামলা দিয়ে টাকার জন্য গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির পরিবারের উপরে চাপ প্রয়োগ করে। টাকা না দিলে এই ব্যক্তিকে ক্রশফায়ারে দেওয়া হবে বলে ব্ল্যাকমেইল করে। এই পরিবারের যদি টাকা থাকে তাহলে তারা টাকা দেয় এই পরিবারের সদস্যের জীবন বাঁচানোর জন্য । এবং অপরাধীর অপরাধ কর্মে উৎসাহিত করে, অপরাধ প্রতিষ্টিত করে। পুলিশ যখন একটি পরিবারের নিরীহ সদস্যকে গ্রেফতার করে এবং গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির পরিবারকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা পেয়ে যায় তখন

“নিরীহ ব্যক্তিকে গ্রেফতার”,
নিরীহ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভুয়া মামলা,
ক্রশফায়ারের ভয় দেখিয়ে নিরীহ ব্যক্তির পরিবারের উপরে চাপ প্রয়োগ,
ব্ল্যাকমেইল,
টাকা আদায়,

এই প্রক্রিয়াতে টাকা আদায় একটা স্বাভাবিক ব্যবসায়িক কর্মকান্ড হিসাবে সমাজে প্রতিষ্টিত হয়ে গেছে। টাকা না দিলে ছেলেকে মেরে ফেলবে এই ভয়ে যেভাবেই হোক এই পরিবার টাকা যোগার করে। এই পরিবারের ছেলেকে বাঁচানো এইখানে বড় কথা । ছেলে যখন পুলিশ কাস্টোডিতে থাকে, নির্যাতন করে পুলিশ যখন ছেলের নখ উঠীয়ে নেয় তখন ছেলেকে জীবিত ফিরে পাবার জন্যই মাবাবা পরিবারের সদস্যরা মরিয়া হয়ে যায়। তাদের এই আবেগ ও সন্তানের জীবন বাঁচানোর প্রচেস্টা যে সমাজে অন্য একটি অপরাধ প্রতিষ্টিত করছে এটা ভেবে দেখার মত মন মানসিকতা তখন থাকেনা। পুলিশ ও আইন আদালত সেটা জানে। সেদিন এক পুলিশের ছেলের হাত কেটে দেওয়া হয়েছে। সেদিন এক পুলিশের মেয়ে তার মাবাবাকে হত্যা করেছে। এইসব কিছুই আমাদের সমাজে খুব স্বাভাবিক বিষয়।

আমাদের গর্ব আমাদের টাইগার্স। আমাদের টাইগার্সরা যদি ভারতকে হারিয়ে ক্রিকেট চ্যাম্পিয়ন হয় তাহলেই আমরা বিশ্বের গর্বিত জাতি হতে পারবো। আমরা আর কিছু চাইনা। অপরাধের মাধ্যমে সমাজে আমরা বিভিন্ন ধরনের শ্রেনী তৈরি করেছি। অপরাধ ঢাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের ঢাকনা তৈরি করেছি। শহরের নীচে দিয়ে বহমান নর্দমা ঢাকার জন্য রাস্তার উপরে যেমন ঢাকনা থাকে তেমনি সুশীল সমাজ এই শহরের অপরাধ নর্দমা ঢাকার ঢাকনা হিসাবে কাজ করে। আমরা প্রতিদিন মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেই। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেই, প্রমোট করি, প্রতিষ্টিত করি তারপর অন্যায়ের শিকার হয়ে মানব বন্ধন করি তারপর যার যার ঘরে ফিরে টাইগার্সদের বিজয় উপভোগ করি। গর্বিত হই। পুলিশ কাস্টডিতে চলে ভাইয়ের নখ উপরে নেবার নির্যাতন, ভাইয়ের চিৎকার, নির্জন ঘরের কোনে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে বোনের কান্না, শুখিয়ে যাওয়া নদীর হাটুজলে ভাসে বাবার লাশ, আমরা আমাদের ফ্লাট স্ক্রিন টিভিতে বসে টাইগার্সদের স্পেস বলিং দেখি, ভারতের তৈরি পপকর্ন খাই আর ভারতের পন্য বর্জনের জন্য ফেসবুকে স্টাটাস লিখি। জীবন যেখানে যেমন। অনাদিকাল থেকে আমরা অন্যায়কে প্রতিষ্টিত করে আসছি। না করলে কোন কাজ হবেনা। অপরাধ করার পরে জুম্মার নামায পড়লেই বেহেস্তে যাওয়া যাবে। ইহজগতে না হয় নরকে থাকলাম পরকাল ঝরঝরে হলেই চলবে।

৩ thoughts on “অপরাধ ফিল্টার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *