মেধাবীরা সম্পদ নয় বোঝা!

শেখ জাহিদুজ্জামান

শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। এ কথাটি কতোটুকু সত্য কম বেশি প্রায় আমাদেরই সকলেরই জানা। সবাই বলে থাকে শিক্ষিত মানুষ নাকি অনেক কিছু করতে পারেন। তারা সমাজে সম্মান, অর্থ-বিত্ত, গাড়ি-বাড়ি সব কিছুরই মালিক হয়ে থাকেন। তবে একটি প্রশ্ন যারা শিক্ষিত নন তাদের পক্ষে কি সমাজের জন্য কিছুই করে না। কথাটি এখন হয়তো কারো কাছে সমীচিন বলে মনে হচ্ছে। তবে এখন এ কথা সত্য যে, শিক্ষিত জাতিগোষ্ঠি এখন সমাজের বোঝায় পরিণত হয়েছেন। কেননা তাদের এই শিক্ষা এখন আর কোন কাজে আসে না আর আসলেও বা সেটার মূল্যই বা কে দেয়। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন একটি নিয়মতান্ত্রিক এবং ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন হবে এটাই স্বাভাবিক। একটি জাতিকে প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত করে তুলতে হলে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরির্বতন ছাড়া কোনো ভাবেই তা সম্ভব নয়।
নতুন শিক্ষা নীতির আলোকেই বর্তমানে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। পরিবর্তন এসেছে সব শ্রেণির সিলেবাস কারিকুলামে। পরীক্ষায় সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়েছে। এখন শিক্ষা আগের যে কোন সময়ের তুলনায় প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে এ নিঃসন্দেহে বলা যায়। মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ চালু, টেলিভিশনে দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের পাঠদান কর্মসূচী ইত্যাদি। কিন্তু প্রশ্ন একটাই? মেধার বিকাশ কি ঘটেছে? সেই মেধার কতোটুকু প্রতিফলন হয়েছে? দেশ তথা সমাজের জন্য এই মেধার সঠিক কি ব্যবহার হয়েছে? আমাদের এই মেধাবী শিক্ষার্থীদের কি হবে? এই মেধাবী সম্পদগুলোকে নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। বিশেষ করে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর বিষয়টি আরো জোরালোভাবে আমাদের সামনে উঠে আসে। কোথায় ভর্তি হবে, উচ্চশিক্ষা বন্ধ হয়ে যাবে, উচ্চ শিক্ষা অনেকেই গ্রহণ করতে পারবে না, অনেকেই ঝরে যাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান সংকুলান হবে না, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে হলে প্রচুর অর্থ লাগবে ইত্যাদি ইত্যাদি নানান কথা।
প্রশ্ন হচ্ছে, মেধাটা কী? মেধা কি আকাশ থেকে পড়ে? নাকি চর্চার মাধ্যমে মেধার বিকাশ ঘটে? একটা কথা জোর দিয়ে বলতে পারি, আমাদের শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট মেধাসম্পন্ন ছিল কিন্তু তাদের মেধা বর্তমানে ছিনতাই করা হচ্ছে। আর সেগুলো নোট/গাইড বই ও কোচিং এর মাধ্যমে। এই শিক্ষার্থীদের মেধা এক শ্রেণির শিক্ষিত মানুষ সমূলে নষ্ট করে দিচ্ছে নোট/গাইড বই ও কোচিং এর মাধ্যমে। শিক্ষিত মানুষদের একটি অংশ মেধা সম্পন্ন প্রজম্ম তৈরি হোক সেটা চান না। যদি চাইতো তাহলে নোট, গাইডবই প্রকাশ করত না এবং কোচিং সেন্টার গড়ে উঠতো না। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করতো না। নোট, গাইড বই ও কোচিং শিক্ষার ফলে সহজে পরীক্ষায় পাস করা যায় কিন্তু প্রকৃত বিদ্যা অর্জন করা যায় না। নোট/গাইড বই, কোচিংবিহীন লেখাপড়া করলে/করানো হলে মেধার বিকাশ ঘটবে, নচেৎ আদৌ নয়। শিক্ষাকে বর্তমানে পণ্যে পরিনত করা হয়েছে। নোট, গাইড বই ও কোচিং এর মাধ্যেমে শিক্ষাকে অর্থ দিয়ে আমাদের কিনে নিতে হচ্ছে। যাদের অর্থ আছে তারা অর্থ দিয়ে নোট/গাইডবই ও কোচিং এর মাধ্যমে শিক্ষা কিনে নিচ্ছে। আর যাদের নেই সেটা তো বলাই বাহুল্য। এই শিক্ষা আসলে প্রকৃত শিক্ষা নয়, কেননা সিংহভাগ শিক্ষার্থী পাস করার জন্য লেখাপড়া করছে প্রকৃত জ্ঞাণ অর্জনের জন্য নয়।
এছাড়া আমাদের শিক্ষার্থীদের যখন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয় তখন আমাদের আমলা তান্ত্রিক সুশিল সমাজের শিক্ষাবিদরা মুখে অনেক বড় বড় কথা বলেন। আমাদের শিক্ষার্থীরা দেশের ভবিষ্যত, তারাই দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিবেন। আরো শত শত নানা অভিনব বাক্যের মাধ্যমে তারা শ্রোতাদের বাহবা গ্রহণ করেন।
এমনি অবস্থায় মেধাবী কাকে বলা যাবে? এর সংজ্ঞা কি? কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি মেধাবী তৈরি করে থাকেন? যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরি করে তাহলে তারা বেছে বেছে শিক্ষার্থীদের তাদের প্রতিষ্ঠানে কেন ভর্তি করায়? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি ধনী গরিব বিবেচনা না করে ভর্তি করিয়ে সকল শিক্ষার্থীকে জিপিএ ৫ পাইয়ে দিতেন তাহলে সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কৃতিত্ব বলা যেতে পারতো। এতো শিক্ষার নামে মানুষকে এক প্রকার ধোকা দেয়া।অন্যদিকে গ্রাম ও শহরের প্রায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই সরকারী এমপিওভূক্ত। এমপিওভূক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারী সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে জনগণের অর্থে। জনগণের অর্থে সুযোগ সুবিধা ভোগ করবেন অথচ যথার্থ জনগণকে সেবা দিবেন না তাকি হওয়া উচিৎ? শিক্ষকেরা মানুষ গড়ার কারিগর, সম্মানের ও শ্রদ্ধার পাত্র, দায়িত্ব অবহেলা করে সেবা না দিয়ে অর্থগ্রহণ করতে তারা বিবেকের বাধা অনুভব করবেন না এ কেমন কথা। তাহলে শিক্ষিত মানুষদেরকে সাধারণ মানুষ সম্মান করবে কেন? সরকারের উচিৎ শহর ও গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমানভাবে সেবা নিশ্চিত করা। শিক্ষার্থীদের যথার্থ শিক্ষা দিতে না পারলে শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা সঙ্কুচিত করা উচিৎ।
সরকার জনগণের অর্থের আমানতদার, যেনতেনভাবে সরকারী অর্থ খরচ করার অধিকার সরকারের থাকতে পারেনা। উচ্চ মাধ্যমিকে বই বিতরণে ধনী গরীব নির্বিশেষে সকলকে বই প্রদান সমীচীন হতে পারেনা। অভিভাবকদের আয় অনুযায়ী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেডিকেল কলেজে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বেতন নির্ধারণ করা উচিত। গরীব মানুষের সন্তানেরা কম বেতনে লেখাপড়া করবে। এটি হওয়া কি জরুরী নয়? অন্যদিকে ধনীর-দুলালীরা ক্ষমতার জোরে কম বেতনে পড়ালেখা করেন। তবে মেধাবী কাকে বলা হবে? যারা মেধার চর্চা না করে কোচিং করে পরীক্ষায় বেশি নম্বর পায় তাদেরকে! নাকি যারা ক্ষমতার জোরে নাম করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করেন তাঁদের কে। এমনও দেখেছি একজন প্রথম শ্রেণির প্রকৌশলী জীবনে সফলতা অর্জন করতে পারেনি, তবে একজন ৩য় শ্রেণির প্রকৌশলী সফলতা অর্জন করেছে, সুনাম অর্জন করেছে। আবার এমনও দেখা গেছে, কোন পরীক্ষায় জিপিএ ৪/৩ পাওয়া শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। এই ক্ষেত্রে কাকে মেধাবী বলা যাবে? মনে রাখতে হবে, মেধা চর্চার বিষয়, নম্বরের বিষয় নয়।
এই সুন্দর পৃথিবীকে কল্যাণকর কিছু যে বা যারা দিয়েছেন তাঁদের বেশিরভাগই ডিগ্রী বিহীন ও নম্বর বিহীন মানুষ। কবি গুরু, জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম, পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ভারতের লালবাহাদুর শাস্ত্রী, ভারত মাতা ইন্ধিরা গান্ধী, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ও জন মেজর. বাংলাদেশের চিত্রশিল্পী প্রয়াত এস এম সুলতান, শিক্ষাবিদ (প্রয়াত) আবুল ফজল, কবি সুফিয়া কামাল, সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও জহুর আহমেদ চৌধুরী খুঁজলে এমন অনেক উদাহরণ মিলবে।
আবারো বলি, আমাদের শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের অন্তরায় হচ্ছে নোট/গাইড বই এবং কোচিং ব্যবস্থা। পারিপর্শ্বিকতায় অভিভাবকরা সে পথে ঝুঁকতে বাধ্য হন। বাধ্য করা হয়। জাতির কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে মেধা ও বুদ্ধি সম্পন্ন সুশিক্ষিত প্রজন্ম প্রয়োজন। তা করতে হলে মেধা চর্চার সকল ব্যবস্থা উন্মুক্ত করতে হবে।পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীকে মেধাবী বলা কতটুকু সমীচীন? সেটা বিবেচনার বিষয়। লক্ষ্যনীয় আমাদের দেশে মেধাবীদের মূল্যায়ণ কখনো হয়নি, হবার সম্ভাবনাও দেখছি না। এ পর্যন্ত অনেক মেধাবী আমলা দেখেছি, তারা জাতিকে কিছুই দিতে পারেননি শুধু ‘জি হুজুর জি হুজুর’ ছাড়া। বরং বিভিন্ন নথিতে মেধার প্যাচ লাগিয়ে দেশ ও জাতির উন্নয়ন কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত করেছে। মেধাসম্পন্ন মানুষ নিজ নিজ বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয়। মেধা আপেক্ষিক বিষয় মেধা চর্চার পথ সুগম করতে হবে। শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিকতা সম্পন্ন বিবেকবান শিক্ষিত মানুষ সৃষ্টি করা দরকার। শিক্ষার্থীকে মেধাবী বলা হচ্ছে এমন প্রায় ৯০% ইংরেজীতে একটি আবেদনপত্র লেখার যোগ্যতা অর্জন করেনি। অনেকেই বাংলায় লিখতেও পারে না। সে মেধাবী দেশবাসীর কি কল্যাণে আসবে? সিংহভাগই দেশ ও জাতির বোঝা।
এদের বিরাট একটা অংশ লাখ লাখ টাকা দিয়ে সরকারী চাকুরী পেতে চায়। হচ্ছেও তাই। চাকুরীর সার্কুলার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি মহল অগ্রিম টাকা নিয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়, সে অনুযায়ী চাকুরীও হচ্ছে। মেধাবীরা চাকুরী পায়না, মেধার মূল্যায়ণ নেই। মেধাবী শব্দ নিয়ে বাড়াবাড়ি করার প্রয়োজন আছে কী আর? এই মেধাবীদের অধিকাংশ নিয়োগ পরীক্ষায় পাস করে না, অনেক ক্ষেত্রে পাস করায় ও না, পাস করলেও নিয়োগ পত্র পায় না। কারণ চাকুরী হয় অর্থের বিনিময়ে, মেধার ভিত্তিতে নয়। মেধার বিকাশ ও মূল্যায়ণ জরুরী। মেধাসম্পন্ন জাতি পেতে হলে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা কেনার ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। চাকুরীর বেলায় মেধা ও যোগ্য ও নিরীহদের মূল্যায়ণ করতে হবে, না হলে জাতি অন্ধাকার পথে তলিয়ে যাবে। ঘুষবিহীন গরীব মানুষের যোগ্য সন্তানের চাকুরীর নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
তবে এটাও জানি আমার এই কথা গুলো হয়তোবা কোন কাজে আসবে না কারণ কথার মূল্যায়ন এখন আর হয় না।

সাংবাদিক এবং কলামিস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *