‘জঙ্গি আস্তানার’ সরঞ্জামে সেনা ব্যাটেলিয়ন চালানো সম্ভব

চট্টগ্রাম : নগরীর হালিশহর আবাসিক এলাকার কে ব্লকের ভেতর আরেকটি আবসিক এলাকার নাম ‘গ্লোডেন আবাসিক কমপ্লেক্স এলাকা’। এই আবাসিকের এক নম্বর গলির গোলাম মাওলা লেনের ১/৯৯ নম্বরে ‘ভিয়া ম্যানশন’ নামে পাঁচতলা একটি ভবন। এই ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটের ভেতর র‌্যাব আবিষ্কার করেছে জঙ্গিদের বিশাল আস্তানা। যেখান থেকে উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ বোমা, বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও জঙ্গি প্রশিক্ষণের সরঞ্জাম। যা দিয়ে সেনাবাহিনীর একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাটেলিয়ন পরিচালনা করা সম্ভব বলে জানান র‌্যাবের ডিজি বেনজির আহমেদ।

শুক্রবার রাত থেকে এই এলাকাটি ঘিরে রাখে র‌্যাব। আশপাশের ভবনের ছাদে ও নিচে র‌্যাব কড়া পাহারা বসায়। দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকা এই ভবনটি শনিবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে র‌্যাব সদস্যরা অবমুক্ত করেন। সেখানে প্রবেশ করে দেখা যায়। ভিয়া ম্যানসনের দ্বিতীয় তলায় সুন্দর গোছানো একটি ফ্ল্যাট। যার তিনটি বেডরুম, একটি ড্রইং ও একটি ডাইনিং রুম এবং একটি কিচেন রুম রয়েছে। তবে ফ্ল্যাটে ঢুকে বুঝার উপায় নেই যে এই বাসায় মিলেছে বিশাল জঙ্গি আস্তানা।

মূল ধরজা থেকে বাম পাশে অবস্থিত ড্রইং রুমের বুক সেলফে সারি সারিভাবে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন ইসলামী সাহিত্য ও ইসলামী লেখকদের বই। নিচে সারিবদ্ধভাবে সোফাসেট। এর পাশের বেড রুমেই মিলেছে বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জাম, বোমা ও জঙ্গি প্রশিক্ষণ সরঞ্জাম। এর পরের বেড রুমে থাকার জন্য খাট বিছানো রয়েছে। মাঝখানে ডাইনিং রুমে ডাইনিং টেবিল, আর কিচেন রুম। দরজার ডান পাশে অবস্থিত আরেকটি বেড রুম। তবে এতসব বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে মাঝখানে সেই বেড রম থেকেই। সেখান থেকে যে পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে তা দিয়ে কমপক্ষে দুই হাজার শক্তিশালী বোমা তৈরি সম্ভব হবে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। এছাড়া যে পরিমাণ প্রশিক্ষণ সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে তা দিয়ে সেনা বাহিনীর একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাটেলিয়ন পরিচালনা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

বিপুল বোমা, বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও বিস্ফোরক এবং প্রশিক্ষণ সরঞ্জাম উদ্ধারের পাশাপাশি সেখান থেকে মাওলানা সগীর বিন ইসমাঈলের ‘ফাযারালে জিহাদ’ একটি বই, শিবিরের সংবিধান, বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম লিপিবদ্ধ আকারে নোট বুক, ডায়েরি এবং প্রশিক্ষণ কোর্সের সনদপত্র। উদ্ধার হওয়া সনদপত্রের মধ্যে যে চারজনের নাম পাওয়া গেছে তা হল- ফরিদুপুরের সোহেল হোসেন, পটুয়াখালীর শফিকুল ইসলাম, বাগেরহাটের লিমন ও হবিগঞ্জের মাসুদুল ইসলাম। তারা কক্সবাজার উশু একাডেমি নামের একটি ইসলামী প্রতিষ্ঠান থেকে তিন মাসের আরবি সাহিত্যের একটি কোর্স গ্রহণ করেন কলে সনদপত্রে উল্লেখ রয়েছে।

04

এছাড়া সেখান থেকে শিবিরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দলিল, সাংগঠনিক প্রতিবেদন, আর্থিক খরচের হিসাব বিবরণী, মহিলা ছাত্র সংস্থার সাংগঠনিক কার্যক্রমের বেশ কিছু কাগজপত্র উদ্ধার করা গেছে। আগের দুই জঙ্গি আস্তানা থেকে শিবিরের কোন কিছু উদ্ধার করা সম্ভব না হলেও এই আস্তানা থেকে শিবিরের কাগজ-পত্র ও দলিল উদ্ধার করার পেছনে জঙ্গি কার্যক্রমে শিবির সম্পৃক্ত কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে ডিজি বেনজির আহমেদ বলেছেন, ‘সব কিছু মাথায় রেখে তদন্ত করা হবে। এখন স্পষ্ট করে কারো না বলা যাবেনা।’

র‌্যাবের তালিকা অনুযায়ী, উদ্ধার হওয়া বোমা ও সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে-১২ বোর শর্ট গানের গুলি ১২টি, ‘ইম্প্রেসিভ এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস’ বিভিন্ন ধরণের বোমা ২২টি, বোমা তৈরির স্টিল বোতল ১২৩৫ পিস, বোমা তৈরির খালি পাইপ ২৪ পিস, অ্যালুমোনিয়াম ডাস্ট ৫৯ কেজি, সোডিয়াম ১৭ কেজি ৬শ’ গ্রাম, এ্যামোনিয়াম নাইট্রিক জিআর ৩ কেজি ৮শ’ গ্রাম, সালপার (২৫০ গ্রাম) এক কেজি, অ্যামোনিয়াম নাইট্রিক এক কেজি ওজনের ৬ কেজি, ম্যাগনেসিয়াম পাউডার ৫শ’ গ্রাম ওজনের এক পিস, নাইট্রিক পিউরিপাইড ৫ শ’ গ্রাম ওজনের ১৩পিস, সালপার ১০ কেজি, গাউন পাউডার ৫শ’ গ্রাম, পটাশিয়াম ক্লোরাইড ৩৫ কেজি, বিভিন্ন ধরণের স্টিল বল ৫ কেজি, নাইট্রোবেনজেনি ৫ লিটার, ইডি সালপাইড ৪ কেজি, পিইটিএন ৫ শ’ গ্রাম, সোডিয়াম এভাইড ১শ’ গ্রাম, চেয়ার কোল ২ কেজি, লাইফ স্মোক এমকে-৮ ওরেঞ্জ ৪ পিস, বেয়নট স্মোক সিগ্যানাল ওরেঞ্জ-এইচ ডব্লিউ এক পিস, বেয়নট স্মোক সিগ্যানাল ওরেঞ্জ-কেএমএ-৪৩ দুই পিস, প্লোটিং ওরেঞ্জ স্মোক সিগন্যাল-আইএফএফ-২০৩ দুই পিস, বেয়নট স্মোক সিগ্যানাল ওরেঞ্জ (চায়না) দুই পিস, স্মোক সিগন্যাল ওরেঞ্জ ৪ এম আই এন ১১ পিস, বেয়নট স্মোক সিগ্যানাল কে-৩৫ দুই পিস বেয়নট স্মোক সিগ্যানা জেএইচথ্রি দুই পিস, উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন রকেট প্যারাস্যুাট প্লেয়ার দুই পিস, মাস্ক এক পিস, গ্লাভস এক পিস, সিরিঞ্জ এক পিস, ব্লেন্ডোর মেচিন এক পিস, জঙ্গল বুট ৮৬ জোড়া, পিটি সু ৯৭ জোড়া, নাইলন বেল্ট ৯৬ জোড়া, মোজা ১৮৫ জোড়া।

শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে হালিশহর এলাকার গোল্ডেন আবাসিক এলাকার ১ নম্বর সড়কের গোলাম মাওলা লেইনের ১/১৯ নম্বর ভিয়া ম্যানশনের ২য় তলা থেকে এসব উদ্ধার করা হয়। মার্কিন প্রবাসী এক ব্যক্তির মালিকানাধীন পাঁচতলা এই ভবনটিতে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ভাড়া নিয়ে বসবাস করছিলেন ফয়জুল হক ও তার পরিবার।

স্থানীয় রানা নামে এক যুবক  জানান, আমেরিকা প্রবাসী স্বন্দ্বীপের এক ব্যক্তি কয়েক বছর আগে পাঁচতলা বাড়িটি তৈরি করেন। তবে তিনি তার ছেলে বিয়ে উপলক্ষে একবার এই বাড়ীতে আসলেও আর কখনো আসেননি। তার শ্যালক সোহাগ বাড়িটির দেখাশোনা করেন। তবে র‌্যাবের অভিযানের সময় তাকে পাওয়া যায়নি।

ওই ভবনের তৃতীয় তলার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা  জানান, র‌্যাব যাদের আটক করেছে তারা কে ব্লকের একটি বাসা থেকে গত এক ফেব্রুয়ারি থেকে এই ফ্লাটে উঠেছেন। সেখানে ফয়জুল, তার বোন রহিমা, বৃদ্ধ পিতা মাওলানা আবুল কালাম ও মা মোরশিদা খাতুন এবং একটি ১৩ বছরের কাজের মেয়েকে নিয়ে থাকতেন। তবে তারা সারাদিন বাসার মধ্যেই বসে থাকতেন। খুব কম প্রয়োজনেই বাসা থেকে বের হতেন। বিশেষ প্রয়োজনে ফয়জুলের বৃদ্ধ পিতা আবুল কালামকে বাইরে যেতে দেখতেন বলে জানান তারা। গত পরশুও কয়েকটি মিনি ট্রাকে করে কয়েকজন যুবক এই ফ্ল্যাটে আসাবাবপত্র ও বিভিন্ন জিনিসপত্র আনেন।

এ প্রসঙ্গে আটক ফয়জুলের মা মোরশিদা আক্তারের কাছে জানতে চাইলে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে  বলেন, ‘আমরা হালিশহর কে ব্লক থেকে গত মাসের এক তারিখ এই ফ্ল্যাটে উঠেছি। আমার ছেলে একটি মেডিকেলে চাকরি করে। গত পুরশু তার এক বন্ধুর কিছু মালপত্র এখানে রেখে যায়। পরে কালকে রাতে দেখি র‌্যাব আমাদের বাসা ঘিরে রেখেছে। আমার ছেলের সঙ্গে আমার মেয়েকেও আটক করেছে।’

তবে আটক ফয়জুলের দাবি, ‘আমি এসব কিছু জানিনা। এসব র‌্যাবই করেছে।’

তবে ফয়জুলের বন্ধু হিসেবে র‌্যাব যার নাম পেয়েছে, সেই পারভেজকে আটক করতে পারেনি র‌্যাব। অভিযানের আগেই ওই বাসা থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় পারভেজ। বাঁশখালীর লটমণি পাহাড়ে খামারের আড়ালে জঙ্গি প্রশিক্ষণের মূল হোতা মাওলানা মোবারকের নেটওয়ার্কের সন্ধান করতে গিয়ে এই পারভেজের সন্ধান পায় র‌্যাব। যার সূত্র ধরেই বাসর ভেতর জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মেলে বলে জানিয়েছেন র‌্যাব-৭ এর সহকারি পরিচালক ওবায়দুল ইসলাম খান।

শুক্রবার রাত থেকে র‌্যাবের ৭ একাধিক অভিযান দল বাঁশখালী ও হাটহাজারী থেকে আটক ‘জঙ্গিদের’ দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে এসব বিস্ফোরক সরঞ্জাম উদ্ধার করে। এসময় ভাই-বোনসহ চারজনকে আটক করে র‌্যাব। এ খবর পেয়ে সকালে হেলিকপ্টারে করে ঢাকা থেকে উড়ে আসেন র‌্যাবের ডিজি বেনজির আহমেদ, অতিরিক্ত ডিজি (অপারেশন) কর্নেল জিয়াউল আহসান, র‌্যাবের গণমাধ্যম ও আইন শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ। এসময় সঙ্গে ছিলেন, র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে.কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ।

শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে র‌্যাবের ডিজি বেনজির আহমেদ বলেন, ‘দেশবিরোধী নাশকতার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। চলমান নাশকতায় পেট্রোবোমা মেরে মানুষ হত্যাকারীরা এসব জঙ্গি কার্যক্রমকে উসকে দিচ্ছে। এখান থেকে যে পরিমাণ বিস্ফোরক ও জঙ্গি প্রশিক্ষণ সরঞ্জাম সামগ্রী উদ্ধার করা হয়েছে তা দিয়ে সেনাবাহিনীর একটি পূণাঙ্গ ব্যটেলিয়ন পরিচালান করা সম্ভব হবে।’

Ctg-photo-3তিনি আরো বলেন, ‘হাটহাজারী, বাঁশখালী এবং আজকে যাদের ধরা হয়েছে তারা সবাই একই সূত্রে গাঁথা। তারা দেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র বানানোর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। তারা এই রাষ্ট্রকে আফগানিস্তান বানাতে চায়। কিন্তু র‌্যাবের গোয়েন্দা তৎপরতার কারণে তাদের সেই চেষ্টা বারবার নসাৎ হচ্ছে।’

‘আটকদের কাছ থেকে ফ্লাস্ক আকৃতির বোমা তৈরির সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। যে কেউ এ ধরনের একটি বোমা হাতে নিয়ে ঘুরলে মনে হবে, শিশুদের স্কুলের ফ্লাস্ক। অথচ এটা মারাত্মক প্রাণঘাতী বিস্ফোরক। কৌশল পাল্টিয়ে তারা এসব করলেও র‌্যাবের সাম্প্রতিক এই অভিযানের ফলে দেশ একটি ভয়াবহ সহিংসতা কিংবা ধ্বংশযজ্ঞ থেকে এই যাত্রায় বেঁচে গেছে। জঙ্গি বিরোধী র‌্যাবের অভিযান আরো জোরদার করা হয়েছে। এটি অব্যাহত থাকবে।’-বলেন বেনজির আহমেদ।

এক প্রশ্নের উত্তরে র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, ‘চট্টগ্রামে দুই জায়াগা থেকে আগে যাদের ধরেছি, তাদের সঙ্গে আল-কায়েদা কিংবা আইএসআইএস (আইএস) নেটওয়ার্ক আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদের সঙ্গে অবশ্যই শক্তিশালী নেটওয়ার্ক আছে। এত বড় আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মযজ্ঞ করতে অবশ্যই আর্থিক সাহায্য, গ্লোবাল রিলেশন প্রয়োজন। এ সব জঙ্গিদের দেশীয়, আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে কাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, কোনও দলের সঙ্গে যোগাযোগ আছে কিনা সব কিছু আমরা খতিয়ে দেখবো।’

উল্লেখ্য, এরআগে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারীর আলিপুর মাদ্রাসা থেকে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে ১২জনকে আটক করা হয়েছিল। এসময় তাদের কাছ থেকে ৬২ জিবি জঙ্গি প্রশিক্ষণের ভিডিও উদ্ধার করা হয়েছিল।

তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত ২১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে বাঁশখালীর দুর্ঘম লটমণি পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও জঙ্গি প্রশিক্ষণ সরঞ্জামসহ পাঁচজনকে আটক করে র‌্যাব।

৫ thoughts on “‘জঙ্গি আস্তানার’ সরঞ্জামে সেনা ব্যাটেলিয়ন চালানো সম্ভব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *