শ্রমের মর্যাদা – এই রচনা মুখস্ত করতে করতে ছোটবেলাতে অনেক কস্ট সহ্য করতে হয়েছে। জোর করে আমাকে দিয়ে কিছু করানো যায়না। ছোটবেলায় আমি টেক্সট বই পড়তে চাইতামনা। অনেক কারণে —
এই টেক্সট বই কেনো পড়ছি বুঝতে পারতাম না । অর্থাৎ এই বই পড়ে সেই অভিজ্ঞতা দিয়ে আমার জীবনে কি কি কাজে লাগবে সেটা বুঝিনি বা কেউ বুঝিয়ে দেয়নি বা বইয়ের কোথাও লেখা পাইনি।
এই টেক্সট বই যে স্কুলে পড়ানো হতো সেইসব শিক্ষকদের আচরণ আমার পছন্দ হয়নি। আমি স্কুল খুব অপছন্দ করতাম। স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকার আচরণের কারণেই আমি স্কুল অপছন্দ করতাম। ছোটবেলায় আমার মনে হতো আমার সাথী গরু টুটুর সাথে সময় কাটালে আমি অনেক কিছু শিখতে পারি স্কুলে সময় কাটানোর চাইতে।
টেক্সট বই পড়ার জন্য আমার বাসার অভিভাবকেরা যে চাপ দিতেন সেটাও আমার অনেক অপছন্দের ছিল। আমি বুঝতাম না ওরা টেক্সট বইকে বেশী ভালবাসে নাকি নিজেদের সন্তানকে।
এই প্রসংগে সুরা আর রাহমান মনে পড়ে গেলো। আল্লাহ্ পরম করুনাময়। আল্লাহ্ আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন । সৃষ্টি করেছেন মানুষ। শিখিয়েছেন বর্ণনা। চাঁদ ও সূর্য যার যার হিসাবে সে সে চলে। তৃণলতা ও বৃক্ষাদিও সেজদা করে। সবার উপরে আকাশ সমুন্নত। প্রতিনিয়ত রক্ষা করে চলেছে ভারসাম্য। ভারসাম্য রেখে চলো। কারুকে প্রতারণা করোনা [তাহলে এই ভারসাম্য বা দাঁড়িপাল্লা একদিকে ঝুকে যাবে – তখন অসাম্য হবে, অপরাধ হবে] প্রতিটি সৃষ্টির জন্য আল্লাহ্ রিজিক রেখেছেন। ফলমুল ও বহিরাবরণাবৃত খেজুরবৃক্ষ আর আছে পুষ্টিকর শস্য ও সুগন্ধি ফুল। প্রকৃতি ও মানুষ – তোমরা উভয়ে তোমাদের জন্য দেওয়া আল্লাহ্র কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে?
পশুরা স্কুলে যায়না। প্রকৃতি স্কুলে যায়না। আল্লাহ্ যখন প্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন তাখন ভারসাম্য রক্ষার মেকানিজম প্রকৃতিকে শিখিয়েই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ্ সব কীট, পতঙ্গ, পশু, পাখিকে তাদের যার যার টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা কৌশল শিখিয়েই সৃষ্টি করেছেন। শুধুমাত্র মানুষকে আল্লাহ্ দিয়েছেন মগজ যা দিয়ে মানুষ এই প্রকৃতি থেকে এই কীট, পতংগ, পশু, পাখী থেকে শিখে নেবে টিকে থাকার কৌশল আর কিভাবে ধ্বংস না করে সৃষ্টিকে রক্ষা করেই ভারসাম্য রক্ষা করা যায় সেটা শেখার কৌশল। মানুষ যখন তার মগজ দিয়ে টিকে থাকার কৌশল শিখতে চায় তখন উলটা শেখে তা হলো নিজে টিকে থাকবো অন্যকে ধ্বংস করে। স্কুলের কাজ হলো – এই শিক্ষা দেওয়া – একে অন্যকে ধ্বংস করে নয় – এঁকে অন্যের সাথে মিলেমিশে একে অন্যকে রক্ষা করা একে অন্যকে প্রতিরক্ষা করার জন্য সবাই মিলে সমাজ গড়ে তোলা । ঐক্যবদ্ধ হলে সমাজ শক্তিশালী হয়। সমাজ দীর্ঘজীবি হয়। সমাজ সমৃদ্ধশালী হয়। মানুষের শিখা শুরু হয় মায়ের পেট থেকে। মায়ের ডিম ও বাবার বীর্য থেকে ভ্রুণের সূত্রপাত ঘটে। এখানেও আমরা দেখি প্রকৃতি কিভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে ভ্রূনের সৃষ্টি করেছে। সেই ভ্রুণ মায়ের গর্ভে বড় হয়। মায়ের শরীরের ভেতরে এই ভ্রূণ মানুষের আকৃতি লাভ করে। জীবন পায়। মায়ের খাবার থেকে সে খাবার খায়। মায়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে। তারপর একদিন পৃথিবীতে আসে। তখন বাবার কাজ শুরু হয় । মায়ের জন্য আর সন্তানের জন্য বাবা বাইরে যান, পরিশ্রম করেন, খাবার সংগ্রহ করে আনেন পরিবারকে রক্ষা করার জন্য। মানুষের প্রতিটি প্রচেস্টা থেকেই অনেক শিক্ষা গ্রহন করা যায়। মানুষের স্কুল শুরু হয় মায়ের গর্ভ থেকে। বাইরে এসে মাবাবার বেঁচে থাকার প্রচেস্টা দেখে শিশু বেঁচে থাকার প্রচেস্টার কৌশল শিক্ষা করে। এই শিশু বড় হয় বাইরে যায় এবং প্রকৃতি সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহন করে। ঘরের চারিপাশ থেকে যা কিছু শেখা সম্ভব নয় সেইসবকিছু শেখার জন্য শিশু স্কুলে যায়। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের কাজ হলো শিশুকে সেইসব অভিজ্ঞতা শেখানো যা শিখে শিশু নিজেকে ও সমাজের সবাইকে ধবংস থেকে রক্ষা করতে পারবে। যেসব অভিজ্ঞতা, কলা, কৌশল শিখে শিশু বড় হবে এবং সমাজকে গড়তে পারবে অন্যকে শিক্ষা দিতে পারবে। ধংস নয় শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্য হলো সৃষ্টিকে রক্ষা করা ও সমৃদ্ধশালী করা। পাঠ্যপুস্তকের কাজ সেটাই।
শিশুর প্রথম স্কুল মায়ের গর্ভ। শিশুর দ্বিতীয় স্কুল মাবাবার সংসার। শিশুর তৃতীয় স্কুল বাইরের স্কুল যেখানে শিশু পাঠ্যপুস্তক থেকে অন্যদের অভিজ্ঞতা শিক্ষা লাভ করে। পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও অনেক অনেক বই আছে যেখানে অনেক লেখক পৃথিবীর অনেক অভিজ্ঞতা, বেঁচে থাকার কলা কৌশলের কথা লেখা আছে, সেইসব বই থেকে সেইসব অভিজ্ঞতার কথা জানা যেতে পারে, শেখা যেতে পারে, নিজের জীবন ও অন্যের জীবনকে সুন্দর করার জন্য সেইসব অভিজ্ঞতা শিখে তা প্রয়োগ করা যেতে পারে। এই হলো শিক্ষালাভের মূল উদ্দেশ্য।
স্কুলের শিক্ষকের কাজ হলো পাঠ্যপুস্তকে লেখা লেখকের অভিজ্ঞতাগুলোকে জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করে সৃষ্টিকে রক্ষা করা যাবে বিদ্যার্থীকে বুঝিয়ে দেওয়া। সেজন্য বলা হয় মায়ের পরে মাবাবা ও শিক্ষকের স্থান।
শিক্ষা লাভের মূল উদ্দেশ হলো আল্লাহ্র সৃষ্টিকে রক্ষা করা এবং আগামীদিনের প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী ও পৃথিবীকে সুন্দর রাখার কৌশল ও অভিজ্ঞতার কথা লিখে রেখে যাওয়া। নতুন শিশুদের এইসব কলা কৌশলগুলোকে শেখানোর জন্য একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকা নিজেকে প্রশিক্ষিত করেন।
একটি সমাজকে ধংবসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সবার কিছু কিছু দায়িত্ব রয়েছে। মায়ের পেটে যখন ভ্রূণ বড় হয় মা যদি তখন মাদকদ্রব্য সেবন করেন বা সিগারেট পান করেন তাহলে শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ নানাভাবে ব্যাহত হয়। ভ্রুণ যখন মায়ের গর্ভে ধীরে ধীরে বড় হয় তখন যদি বাবার দ্বারা বা সংসারের অন্যদের দ্বারা মায়ের উপরে শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন চলে তাহলেও পেটের ভেতরে বড় হতে থাকা শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশের উপরে তার ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। মায়ের পেটের স্কুলে শিশুর সৌন্দর্য বিঘ্নিত হয়। শিশুর শিক্ষা ও মায়ের সাথে তার সম্পর্কের গভীরতা বিঘ্নিত হয় । বাইরের চাপগুলো মায়ের মাধ্যমে শিশুর কাছে এসে পৌছালে শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে যে প্রভাব পড়ে সেগুলো মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত শিশুর সাথে থেকে যায়। শিশুর জন্মের পরে যদি মাবাবার সংসারে বিভিন্ন ধরনের কলহ, নির্যাতন, নিপীড়ন দেখে শিশু বড় হয় তখন সেগুলোও শিশুর মানসিক বিকাশের ভারসাম্য রক্ষাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। শিশু যখন বাইরের স্কুলে আসে তখন সে শিক্ষকের আচরণ অবলোকন করে। শিক্ষকের নিপীড়ন ও পক্ষপাতিত্ব। সেটাও শিশুর মনে প্রভাব বিস্তার করে এবং শিশুর মানসিক বিকাশে ব্যাপকভাবে ক্ষতি করে। সংসার, সমাজ ও দেশ গড়ার কারিগর হিসাবে সেই শিশুকে যেহেতু আমরা বড় করতে পারিনি তাই সংসার, সমাজ ও দেশ গড়ার কাজে সেই শিশু অংশ নেবে সেটা প্রত্যাশা করতে পারিনা।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সংসার, সমাজ, দেশ গড়ার কোন সম্পর্ক নাই। বিভিন্ন পর্যায়ে যার যার টিকে থাকার জন্য টাকা আয়ের ব্যবস্থা করতে দুর্নীতির সাথে সম্পর্ক আছে। সেজন্য আমি স্কুল পছন্দ করিনি। শিক্ষক শিক্ষিকাতে পছন্দ করিনি। আমি পড়তে শিখেছি বাংলাদেশের বস্তি থেকে। বাংলাদেশের রাস্তা থেকে। বাংলাদেশের রিকসাওয়ালা থেকে। বাংলাদেশের খালবিল থেকে। বাংলাদেশের রেললাইন থেকে। বাংলাদেশের রাজমিস্ত্রি থেকে। বাংলাদেশের মেছোদের কাছ থেকে। বাংলাদেশের বৃক্ষ থেকে, ফুল থেকে, ফল থেকে, পাখিদের কাছ থেকে, পশুদের কাছ থেকে, পিঁপড়াদের কাছ থেকে, জলপিঁপিঁর কাছ থেকে, মাছদের কাছ থেকে, রাস্তায় বসে থাকা কুকুরের কাছ থেকে, সাবধানে বাচ্চাকে মুখে করে মা বিড়াল নিরাপদে চলে যেতে দেখে আমি শিক্ষা নিয়েছি বাচ্চাকে কিভাবে রক্ষা করতে হয়। এইসব শেখার জন্য আমি স্কুলে যায়নি। স্কুল থেকে আমি শিখেছি নিষ্টুরতা, পক্ষপাতিত্ব, অসভ্য আচরণ, নোংরামী, নোংরা রাজনীতি। ন্যায় শিখিনি। প্রকৃতিকে রক্ষা করতে শিখিনি। সমাজকে রক্ষা করতে শিখিনি। স্কুল থেকে আমি কিছু শিখিনি।
নিজের সংসার, নিজের সমাজ, নিজের দেশ কিভাবে রক্ষা করতে হবে তা স্কুল থেকে আমি শিখিনি। নিজেকে অসহায় ভেবেছি। নিজেকে অসম্পুর্ন ভেবেছি। শুধু নিজেকে বাঁচাতে শিখেছি। স্বার্থপরতা শিখেছি। সেজন্য নিজেকে বাঁচিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে এসেছি। বাচ্চাকে মুখে করে সাবধানে নিরাপদে সরিয়ে এনেছি সেই মা বিড়ালের মত । আমি শুধু এইটুকু শিখেছি। আমার এই ব্যর্থতার জন্য আমি আমার নিজের দোষ স্বীকার করছি। শ্রমের মর্যাদা দিতে শিখিনি। মুখস্ত করে আমি কিছু শিখতে পারিনা। পরীক্ষার খাতায় লেখার পরে ভুলে গেছি আসলে শ্রমের মর্যাদা কাকে বলে বা কেন আমি এই রচনা পড়েছিলাম, আমার মনে হয়েছে আমি এই রচনা পড়েছিলাম পরীক্ষার খাতায় ঠীকভাবে উত্তর লেখার জন্য। লিখতে পারিনি। ভাল নম্বর পাইনি। ৩৩ পেলেই পাস করা যায়। অন্য ক্লাসে উঠা যায়। সেজন্য আমি ৩৩ নম্বর পাবার জন্য যেটুকু মুখস্ত করা লাগে করেছি। ৩৩ করে করে পেয়ে পাস করেছি। প্রমোশন পেয়েছি। স্কুল থেকে বের হতে ৩৩ এর বেশী কিছু লাগেনা।
যেকোন সমাজের অর্থনীতি গড়ে উঠে চলে সেই সমাজের সব ধরনের শ্রমের সমন্বয়ে। শ্রম দুই ধরনের – দক্ষ বা অদক্ষ শারীরিক শ্রম (স্কিল্ড বা আনস্কিল্ড ক্যাপিটাল) ও মানসিক শ্রম (ইনটেলেকচ্যুয়াল ক্যাপিটাল)। ঘরের গৃহকর্মী থেকে শুরু করে দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সবাই এই অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। শ্রমের মর্যাদা যদি দিতে হয় তাহলে ঘরের গৃহকর্মী থেকে শুরু করে দেশের সকল মানুষ যারা এই অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত আছে তাদের সবার শ্রমের মর্যাদা দিতে হবে। শ্রমের মর্যাদা অর্থ শ্রমের মূল্যায়ন। একজন গৃহকর্মীর শ্রমের বিনিময়ে আপনি যে সুখ ভোগ করছে সেই সুখের যদি মূল্যায়ন করা যায় তাহলে সেই সুখের মূল্য দিয়েই সেই গৃহকর্মীর পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা সম্ভব। আর যদি এই গৃহকর্মীর শ্রমের মূল্যায়ন করে পারিশ্রমিক দেওয়া হয় তাহলে সে সমাজের অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে একজন ক্রেতা হিসাব অংশ নিতে পারে এবং অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারে। একজন গৃহকর্মীর শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করে তার সঠিক পারিশ্রমিক দিলে তার ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং আপনার তৈরি পন্য যা বাজারে বিক্রি হচ্ছে তা কেনার সামর্থ থাকবে। এইভাবে একটি সমাজে সব ধরনের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা যায়। সেটাই সুরা আর রাহমানে বলা হয়েছে।
ওজন ঠিক করো ও ওজনে কারুকে কম দিওনা। ভেবে দেখুন। আবার ভেবে দেখুন। আল্লাহ্র কোন কোন নির্দেশ আপনি ঠিকভাবে পালন করছেন ?
Who are you
sister
Md Azizul liked this on Facebook.
Anjana Alam liked this on Facebook.
Jahangir Kabir liked this on Facebook.