পাহাড়ে জঙ্গি আস্তানা, হতবাক স্থানীরা

চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর ইউনিয়নের লটমণি ও সাতকানিয়ার কাঞ্চনার ছনখোলা এলাকার দুর্গম পাহাড়জুড়ে ‘সামরিক প্রশিক্ষণ’ গ্রহণ করে আসছিল জঙ্গিরা। লটমণি পাহাড়ের একটি খামার বাড়িতে আস্তানা গড়ে তোলে প্রশিক্ষণার্থীদের বিমান ছিনতাইয়ের কৌশল, অস্ত্র প্রশিক্ষণ সহ গেরিলা ট্রেনিং দেওয়া হতো।

এই দাবি র‌্যাবের হলেও অথচ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে স্থানীয়রা এর কিছুই কখনো টের পায়নি। হঠাৎ করে রোববার বিপুল সংখ্যক র‌্যাব ও গণমাধ্যম কর্মীদের দেখে তাদেরও জিজ্ঞাসা কি এমন হতো এখানে? তাদের উৎসুক দৃষ্টি আরো জোরালো হয় যখন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হেলিকপ্টারে চেপে ঢাকা থেকে উড়ে আসেন র‌্যাবের অতিরিক্ত মহা পরিচালক কর্নেল এ কে আজাদ, পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদসহ পাঁচ র‌্যাব কর্মকর্তা।

বাঁশখালীর সাধনপুরের লটমণি পাহাড় থেকে ড্রামে ভর্তি অবস্থায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গুলি ও প্রশিক্ষণের নানা সরঞ্জামসহ পাঁচজনকে আটকের কথা জানিয়ে রোববার দুপুরে ঘটনাস্থলে সংবাদ সম্মেলন করেন র‌্যাবের পরিচালক (আইন ও গণমাধ্যম) কমান্ডার মুফতি মাহমুদ।

আটক জঙ্গিরা হলেন- মোবাশ্বের হোসেন (১৭), আবদুল খালেক (২১), আমিনুল ইসলাম (২২), হাবিবুর রহমান (১৯), আমির হোসেন ইসহাক (২৫)। শনিবার বিকেল থেকে রাতভর অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে বলে দাবি করে র‌্যাব।

Ctg bashkhali  photo 6বাঁশখালী সদর থেকে ১৩ কিলো মিটার দূরে দুর্গম পাহাড়ের মাটির গর্ত থেকে বেশ কিছু অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- তিনটি এ কে ২২ রাইফেল, ছয়টি বিদেশি পিস্তল,  একটি রিভলবার, তিনটি দেশিয় বন্দুক, তিনটি চাপতি, ৭৫১ রাউন্ড গুলি, ২২টি এ কে ২২ রাইফেলের ম্যাগজিন,  ৯টি পিস্তলের ম্যাগজিন সহ প্রশিক্ষণে ব্যবহার করা দড়ি, জুতা ও পোষাক।

ব্রিফিংয়ে মুফতি মাহমুদ বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন এলাকার দরিদ্র পরিবারের ছেলেদের টার্গেট করে জঙ্গিরা। এরপর আরবি শিক্ষা দানের কথা বলে নানা কৌশলে ও ভিন্ন পথ ব্যবহার করে তাদেরকে দুর্গম এ এলাকায় আনা হয়। এরপর ইসলামিক শিক্ষার পাশাপাশি তাদেরকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের ওপর হামলার দৃশ্য দেখিয়ে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করা হতো।’

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারী উপজেলায় আটক ১২ জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সাধনপুরের লটমনি পাহাড়ে এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সন্ধান পায় র‌্যাব, এমন দাবি করে কমান্ডার মুফতি মাহমুদ বলেন, ‘বাঁশখালীর লটমণি পাহাড়ে জনৈক মাওলানা মোবারক ও আজিজের মালিকানাধীন গরু-ছাগল-ভেড়া-মুরগির খামারের আড়ালে এই আস্তানা গড়ে তোলা হয়েছে। খামারকে কেন্দ্র করে রাতের আধাঁরে আশপাশের পাহাড়ে তারা সামরিক প্রশিক্ষণ নিত।’

প্রশিক্ষণার্থীদের গেরিলা প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি বিমান ছিনতাই করার প্রশিক্ষণও এখানে দেয়া হতো দাবি করে র‌্যাব কর্মকর্তা মুফতি মাহমুদ বলেন, ‘আটক জঙ্গিদের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত বহু ভিডিও পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আল কায়েদা, আইএস, আল আজহারি, আল শাবাব ও হিজবুল্লাহর বিভিন্ন কর্মকান্ডের ভিডিওচিত্র দেখিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।’

Ctg bashkhali  photo 8স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান খন্দকার মো. ছমিউদ্দিন বাংলামেইলকে বলেন, ‘২০১০ সালে সাধনপুরের এসব পাহাড়ি এলাকা সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আওতায় চলে আসায় সাধারণ মানুষের যাতায়াত কমে যায়। এছাড়া এসব এলাকায় সবসময় বন্য হাতি চলাচল করে। হাতির উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য স্থানীয়রা প্রতি রাতেই পটকা ফোটায়। সেজন্য প্রতি রাতে হওয়া শব্দগুলো গুলির না পটকার? তা বুঝা যায় না।’

তিনি আরো বলেন, ‘শনিবার রাতে মোট ১১জনকে আটক করেছিল র‌্যাব। এরমধ্যে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় স্থানীয় ৬জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়।’

সংবাদ সম্মেলন শেষে মুফতি মাহমুদ  বলেন, ‘হাটহাজারীতে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষ করে বাঁশখালীর সংরক্ষিত বনাঞ্চলে দুই মাস সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। প্রশিক্ষণার্থীরা ভিন্ন পথ ব্যবহার করে এসব এলাকায় আসতো। এ এলাকায় কয়েকটি ফায়ারিং রেঞ্জ ও বাংকারের দেখা মিলেছে। এর মাধ্যমে বুঝা যায় তারা সামরিক প্রশিক্ষণই নিচ্ছিল।’

তবে র‌্যাবের এতসব দাবির প্রেক্ষিতে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, জঙ্গি প্রশিক্ষণের ব্যাপারে তারা কিছুই অবগত নয়। চট্টগ্রাম-বাঁশখালী সড়কের সাধনপুর থেকে অন্তত ৩কি.মি দূরে গহীন পাহাড়ে যেতে যেতে এ প্রতিবেদকের কথা হয়, দিনমজুর রফিকের সাথে। তিনি বলেন, ‘অস্ত্র হাতে নিয়ে পাহাড়ে কাউকে কোনসময় দেখিনি। পাহাড়ে কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নেই। র‌্যাব যাদের ধরেছে, তার মধ্যে একজনকে চিনি, যিনি বাবুর্চির কাজ করতেন। অন্য চারজনকে কখনো এ এলাকায় দেখিনি।’

এদিকে পাহাড়ে ‘জঙ্গি আস্তানা’র সন্ধানের পর র‌্যাব সদর দপ্তর থেকে হেলিকপ্টারে করে ঘটনাস্থলে আসেন উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আটক জঙ্গিদের চেয়ে সেই হেলিকপ্টার দেখতে উৎসুক মানুষের ঢল নামতে দেখা গেছে। পাহাড়ে হেলিকপ্টার, বিপুল সংখ্যক র‌্যাব ও সাংবাদিক দেখে পাহাড়ে বসবাস করা মানুষগুলো অবাক বনে গেছেন। এদের বেশ কয়েকজনের কাছে এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে, সবাই একবাক্যে ‘কিছুই জানি না’ বলে জবাব দেন।

সংবাদ বিফ্রিংয়ে উপস্থিত সাংবাদিকরা র‌্যাব কর্মকর্তা মুফতি মাহমুদকে প্রশ্ন করেন, আটক জঙ্গিরা কোন সংগঠনের? তাদের অর্থায়নে কে? নেতা কে? কতদিন ধরে তারা এখানে অবস্থান করছিল? ইত্যাদি নানা প্রশ্নের কোন জবাব দেননি র‌্যাব কর্মকর্তা মুফতি মাহমুদ।

তিনি শুধু বলেন, ‘হাটহাজারীতে জঙ্গি আটকের সূত্র ধরে অভিযান পরিচালনা করে এসব উদ্ধার করা হয়েছে। এ অভিযান এখনো চলমান রয়েছে। কৌশলগত কারণে সবকিছু বলা যাচ্ছে না। পরে সবকিছু বিস্তারিত জানানো হবে।’

এদিকে আটককৃতদের সাথে সাংবাদিকরা কথা বলতে চাইলেও র‌্যাবের কর্মকর্তারা সে সুযোগ দেননি। সংবাদ ব্রিফিংয়ের আগ থেকেই আটককৃতদের খামারের একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়। সংবাদ ব্রিফিং শেষে স্বল্প সময়ের জন্য ফটোসেশন করে তাদেরকে ফের একই কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়।

৫ thoughts on “পাহাড়ে জঙ্গি আস্তানা, হতবাক স্থানীরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *