প্রবাসের গল্প – ৩

কানাডাতে এসে আমি যখন সিকিউরিট গার্ডের কাজ করতাম তখন আমার প্রথম কাজের জাগা ছিল একটা কলেজের পার্কিং এ। সেখানে দুইজন সিকিউরিট গার্ড ছিল। একজন তামিল আর আমি। আমাদের সুপারভাইজার ছিল ত্রিনিদাদের লোক। আফ্রিকান ত্রিনিদাদিয়ান কানাডিয়ান। তার নাম ছিল জর্জ। খুব ভোরে উঠে যেতে হতো। দুইটা বাস বদল করে। অনেক অনেক দুরের একটা কলেজে। তামিল সিকিউরিটি গার্ডের নাম সিভা। সিভা আমাকে বললো – তুমি এত কস্ট করে বাসে করে আসো তার চেয়ে আমি প্রতিদিন ভোরে তোমাকে গাড়িতে করে নিয়ে আসবো । তুমি রেডি হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি রেডি হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম আর সিভা এসে আমাকে নিয়ে যেতো। সীভা দুইটা কাজ করতো। সকাল সাতটা থেকে বিকাল তিনটা সিকিউরিটি গার্ডের কাজ আর বিকেল চারটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত ফ্যাক্টরীতে কাজ।

সিভার বউ কাজ করতোনা। সিভার ছোট ছোট দুই মেয়ে তাদের দেখাশোনা করতো। সীভার মতে, মেয়েদের ডেকেয়ারে রেখে সিভার বউ যদি কাজ করে তাহলে সে যে ডলার আয় করবে তা ডেকেয়ারে দুইটা বাচ্চার জন্য খরচা হয়ে যাবে অথবা তার চেয়ে বেশী খরচা হয়ে যাবে। তারপরে আছে বাচ্চাদের দেখাশোনা করার ব্যাপার। সিভার মতে তার মেয়েরা মায়ের কাছেই ভালভাবে লালিত পালিত হবে। সেজন্য সিভা নিজে দুইটা কাজ করে। সকাল ছয়টার সময় বের হয় আর রাত বারোটার সময় ঘরে ফিরে।

সিভা প্রতিদিন জর্জকে আর আমাকে কফি কিনে দিতো। আমি বারন করেছিলাম। বলেছিলাম তুমি দুইটা কাজ করে কস্ট করে টাকা আয় করে আমাদের জন্য খামাখা কফি কিনে ডলার নস্ট করোনা। সিভা দেশে মাবাবাভাইবোনদের জন্যও ডলার পাঠাতো। সিভার বাড়ি জাফনাতে। সিভার কাছ থেকে আমি প্রভাকরণ আর এল টি টি ই সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারি। প্রতিদিন সকালে ওর গাড়িতে করে কাজে যাবার সময় সিভা জাফনার গৃহযুদ্ধের কথা বলতো।

শ্রীলংকাতে তামিলদের সাথে সিনহলীদের গৃহযুদ্ধের আগুন লাগিয়েছিল ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। তামিলদের সাথে সিনহলীদের এত বিভেদ না থাকলেও ভারতের ইন্দিরা গান্ধী চেয়েছিল বাংলাদেশের মতই শ্রীলংকাকে নিয়ন্ত্রন করতে। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী একজন দেশপ্রমিক ভারতীয় যিনি বিভাজন ও শাসনে বিশ্বাসী যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রতিবেশী দেশগুলোকে ভারতের বাজার বানিয়ে ভারতকে স্বনির্ভর করার। বাংলাদেশকে ভারতের বাজার বানিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে কিন্তু শ্রীলংকাতে গৃহযুদ্ধ এখনও চলছে। শ্রীলংকার তামিল টাইগারদের অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষন দিয়ে ইন্দিরা সাহায্য করে গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দেবার পরে এই ইন্দিরা গান্ধীর ছেলে রাজীব গান্ধী এই তামিল টাইগারদের আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরনেই প্রান হারায়। ফ্রাঙ্কেন্সটাইনের দৈত্যের মত ঘটনা ঘটে। ফ্রাঙ্কেন্সটাইন একজন সায়েন্টিস্ট একটি দানবের সৃষ্টি করে যে নাকি সৃষ্টি হবার সাথে সাথে প্রথমে তার সৃষ্টিকর্তাকেই ধবংস করে। শ্রীলংকার চা সিনহল টি জগত বিখ্যাত। চা বাগানে কাজ করার জন্য বৃটিশরা ভারতের তামিলনাড়ু থেকে তামিল মানুষদের ধরে বেধে নিয়ে যায় শ্রীলংকার চা বাগানে কাজ করানোর জন্য। সেই সময় থেকেই ভারতের তামিলরা শ্রীলংকাতে বসবাস করছে। ভারতের তামিল নাড়ুতে শ্রীলংকার তামিলদের ট্রেনিং দেওয়া হয় এবং এলটিটিই (The Liberation Tigers of Tamil Eelam (LTTE)  এর সৃষ্টি হয় শ্রীলংকার তামিল এলাকাগুলোতে স্বাধীনতা ঘোষনা করার জন্য। তামিলদের অনেক দাবী ছিল। প্রথমে স্বায়ত্ব শাসনের দাবী ছিল পরে তা স্বাধীনতার দাবীতে রুপ নিলে সিনহলীরা ব্যাপক মিলিটারী তৎপরতা চালায় তামিল এলাকাগুলোতে। গনহত্যা, ধর্ষন, লুট সব কিছু হয়। ফলে তামিলরা শ্রীলংকা ছেড়ে সাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেইসব দেশে কনভেনশন রিফুউজী হিসাবে বসবাস করা শুরু করে। শ্রীলংকার তামিলরা খুব সুন্দর মানুষ। ঐক্যবদ্ধ। দেশপ্রেমিক। ভদ্র। সভ্য। অমায়িক। বুদ্ধিমান মানুষ।

সীভা ছিল তামিল। ভদ্র, সভ্য ও অমায়িক ছেলে। আমরা যে কলেজের পার্কিং এ সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করতাম সেই কলেজে শ্রীলংকার তামিল যারা পড়ালেখা করতো তারা সবাই সিভাকে চিনে। সিভা তাদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিতো। একজন তামিল আমাকে বলেছিল আমি কেনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কলেজে ভর্তি হচ্ছিনা। কিছুদিন আমি সরকারের সাহায্য নিয়ে যদি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে তিন বছর পড়া করে একটা ব্যাচেলর ডিগ্রী নিয়ে অফিসে কাজ শুরু করি তাহলে এইভাবে আমাকে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করতে হবেনা। একজন তামিলই সর্ব প্রথমে কানাডাতে আমাকে এই বুদ্ধি দেয়। তামিলরা আমাকে সব সময়ই অনেকভাবে সাহায্য ও সহযোগীতা করেছে। আমি এই কমিউনিটির কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।

যাইহোক আমাদের সুপারভাইজার জর্জ প্রতিদিন সকালবেলা মাগনা মাগনা কফি পান করার জন্য একবার আসতো। তার আমাকে বলতো – তোমাকে লাঞ্চে নিয়ে যাবো।
আমি তোমার সাথে লাঞ্চে কেনো যাবো ?
সিভা বলে – ওর সাথে তুমি লাঞ্চে যাবেনা। ও খারাপ লোক।
আমি জর্জকে বললাম – জর্জ তুমি প্রতিদিন সিভার কাছ থেকে মাগনা কফি খাও। তোমার লাঞ্চের ডলার কি আমাকে দিতে হবে ?? তাইলে আমি লাঞ্চ করুম না তোমার সাথে। আমার কাছে কোন ডলার নাই।
জর্জ হাসে । সিভা হাসে। বলে – না, না, আমি তোমাকে লাঞ্চ করাবো। আমি বললাম – থাক আমি কারু টাকাতে লাঞ্চ খাইনা। আমি বাসা থেকে লাঞ্চ নিয়া আসি। এইখানে খাই। জর্জ হাসে। বলে সেই লাঞ্চ খাওয়া না। তখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম – তাইলে কি লাঞ্চ খাওয়া ?? তখন বলে – I want to take you out for lunch or dinner … ও হেইয়া!! আমি বললাম্ তোমার ভুড়ির সাইজটা যাইয়া আয়নাতে দেখো। তুমি এত ভুড়িওয়া কালো মোষ । তোমার লগে আমি লাঞ্চে ডিনারে যামুনা ।

যাই হোক সেই কলেজের পার্কিং থেকে আমাকে বদলী করা হলো অন্য একটা পার্কিং এ। সেটা এখানকার পাবলিক বাসের পার্কিং। এখানেও খুব ভোরে কাজে যেতে হতো । একদিন খুব ভোরে কাজে যাবার জন্য বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছি। এক সোমালিয়ান এসে বলে তুমি এইখানে কেনো দাঁড়িয়ে আছো ? আমি বললাম – বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। তোমার সমস্যা কি?

ওর সমস্যা হলো ও ড্রাঙ্ক। সে প্রশ্ন করে – তোমার নাম কি? আমি পালটা প্রশ্ন করি – আমার নাম দিয়া তুমি কি করবা ?? মনে মনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। এর আগে ড্রাঙ্ক মানুষের সাথে কথা বলিনি। নির্জন ভোর রাত। চারিদিকে কেউ নাই। আমি এক ড্রাঙ্কের মুখোমুখী দাঁড়িয়ে আছি। আমার পড়নে সিকিউরিটি গার্ডের জ্যাকেট। নিজেই নিজের সিকিউরিটি নিয়া ভয়ে কাপাকাপি শুরু করে দিলাম। এখানকার বাসের নিয়ম হলো এরা যাত্রীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সাহায্য করে। এই ড্রাঙ্কের সাথে কথা বলার সময়ে একটা বাস এসে দাঁড়ালো। তখন আমি বাসে উঠে পড়লাম। মনে মনে ভাবলাম – আল্লাহ্‌ বাচায়ছে। বাসের জানালা দিয়ে দেখলাম সেই ড্রাঙ্ক তখনও কথা বলছে একা একা হাত নেড়ে নেড়ে।

১০ thoughts on “প্রবাসের গল্প – ৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *